আমানতের সুদহার এক দশকে সর্বোচ্চ, অন্যদিকে প্রবৃদ্ধি ১০ মাসে সর্বনিম্ন
চলতি বছরের এপ্রিলে অধিকাংশ ব্যাংক গ্রাহকের আমানতে প্রায় ১২ শতাংশের কাছাকাছি সুদহার অফার করেছে ব্যাংকগুলো, যা এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে, এরকম উচ্চ সুদ হারেও গ্রাহকের আমানত প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে ৮.৬৩ শতাংশে— যা গত ১০ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।
ব্যাংকারা বলছেন, ব্যাংকগুলোতে যখন আমানতের সুদহার বাড়ছে, তখন আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া খুবই আশঙ্কার বিষয়। অনেক ব্যাংক আমানতের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। এছাড়া মূল্যস্ফীতি এবং মার্জার ইস্যুতে গ্রাহকরা আতঙ্কে থাকায় ব্যাংকে আমানত কম রাখছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের এপ্রিল শেষে ব্যাংকগুলোর আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬.৭৫ লাখ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮.৬৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি।
অথচ আগের মাস মার্চে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ১০ শতাংশ; এর আগের মাস ফেব্রুয়ারিতে ছিল প্রায় সাড়ে ১০ শতাংশ।
চলতি বছরের এপ্রিলে আমানতের প্রবৃদ্ধি যে পরিমাণে কমেছে, এর আগে এমন কম প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২০২৩ সালের জুনে। সেসময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৮.৪০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৪ সালে বেশকিছু ব্যাংক গ্রাহকের আমানতের ওপর ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ সুদহার দিয়েছে। যদিও এরপর অমানতের সুদহার উঠানামা করেছে, অধিকাংশ ব্যাংকে আমানতের সুদহার ছিল ১০ থেকে ১১ শতাংশের মধ্যে। তবে অধিক সংকটে থাকা দু-একটি ব্যাংকের সুদের হারে ছিল ভিন্ন চিত্র।
ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ব্যাংকখাতে গত কয়েকমাসে ঋণের সুদের হার বাড়ছে, যার কারণে ব্যাংকগুলো আমানতের রেট বেশি দিলেও আগের তুলনায় আমানতে প্রবৃদ্ধি অনেক কম হয়েছে। এর পিছনে তিনি বেশি কিছু কারণ উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, "গত আড়াই বছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এখনও মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশের মত। যার কারণে গ্রাহকরা ব্যাংকে আমানত না রেখে টাকা হাতে রাখছেন।"
তিনি বলেন, "বর্তমানে যে পরিমাণে ব্যাংকগুলোতে আমানতের সুদহার বেড়েছে— এমনটি হয়েছিল নব্বইয়ের দশকে। এছাড়া ২০০২-২০০৩ সালের দিকে আমানতের হার বেশি ছিল। ২০১৪ সালের দিকে বেশিকিছু ব্যাংক প্রায় ১৩ শতাংশ সুদে আমানত নিয়ে ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ সুদে ঋণ দিয়েছে।"
বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক টিবিএসকে বলেন, "আমানতের সুদহার বাড়ছে, অন্যদিকে প্রবৃদ্ধি কমছে— তার মানে হচ্ছে, ব্যাংকের গ্রাহকদের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে।"
"মার্জার ইস্যুতে বেশকিছু ব্যাংকের গ্রাহকের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এছাড়া পদ্মা, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক গ্রাহকের আমানত দিতে পারছে না, এমন কিছু নিউজ হওয়ায় গ্রাহকরা আস্থার সংকটে ভুগছেন।"
তিনি আরও বলেন, "তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো ১৫ শতাংশ সুদেও আমানত সংগ্রহ করছে। তারপরও তারা পর্যপ্ত আমানত পাচ্ছে না।"
উদাহরণ হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন, বেশকিছু ব্যাংক ৫ বছরে আমানতের দ্বিগুণ ফিরিয়ে দেবেন এমন অফারও করছে।
বেশিকিছু ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা বর্তমানে ১২ শতাংশ সুদেও আমানত সংগ্রহ করছে। তবে গ্রাহকের ঋণের সুদের হার ১৫ শতাংশের নিচেই রয়েছে।
বেশ কয়েকটি ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অন্তত দুটি বেসরকারি ব্যাংক এখন সাড়ে পাঁচ বছরে দ্বিগুণ টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমানত নিচ্ছে। ব্যাংক দুটি এ ধরনের আমানতে সুদ দিচ্ছে ১৩. ৪০ শতাংশ।
এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকে এক বছরের জন্যেও স্থায়ী আমানত হিসাব খোলা যায়। সেখানে মাসে মাসে মুনাফা পাওয়ার সুবিধাও রয়েছে। সেখানে দেখা যায়, কিছু কিছু ব্যাংক এক বছরে আমানতের ওপর সুদ দিচ্ছে ১১ থেকে ১২.৫০ শতাংশ হারে।
এছাড়া, বর্তমানে তারল্য সংকটে থাকা বেশিকিছু শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকও সাড়ে পাঁচ বছরে আমানতের দ্বিগুণ ফেরত দেওয়ার অফার করছে।
সাম্প্রতি ন্যাশনাল ব্যাংক 'সেঞ্চুরি ডিপোজিট স্কিম' নামে মাত্র ১০০ দিন মেয়াদী ডিপোজিট স্কিমে লোভনীয় সুদ অফার করছে। ব্যাংকটি ৫০ হাজার বা তার বেশি জমাকৃত পরিমাণের ওপর ৮০ ভাগ পর্যন্ত ঋণ সুবিধাও অফার করছে।
এক মাসে মানুষের হাতের টাকা বেড়েছে ৩,১৫৪ কোটি
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের এপ্রিল শেষে মানুষের হাতের টাকা পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২.৬৪ লাখ কোটি। অর্থাৎ, এক মাসের ব্যবধানে মানুষের হাতে টাকা বেড়েছে ৩,১৫৪ কোটি টাকা।
এছাড়া প্রতিবেদন বলছে, গত ৭ মাসে ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে টাকার পরিমাণ বাড়ছে। গত ২০২৩ সালের অক্টোবরে এর পরিমাণ ছিল ২.৪৫ লাখ কোটি টাকা।
রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, "কোভিডের সমেয় অনেক ব্যাংক আমানতের সুদহার ৩-৪ শতাংশে নামিয়ে এনেছিল। তারপরও মানুষ ব্যাংকে টাকা রেখেছে।"
"এখন অনেক গ্রাহক ব্যাংক থেকে টাকা তুলে অন্যত্র বিনিয়োগ করছেন। এখন কিছু ব্যাংক উচ্চ সুদে টাকা সংগ্রহে নামলেও আমানতকারীদের তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। এর একটি বড় কারণ হলো, গ্রাহকের মাঝে আস্থার সংকট। কিছু ব্যাংকের কারণে ব্যাংক খাত নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের আস্থার ঘাটতি তৈরি হয়েছে," যোগ করেন তিনি।