কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বন্ধ রাখায় আমদানি দায় মেটাতে বেসরকারি ব্যাংকের দিকে ঝুঁকছে বিপিসি
বাংলাদেশ ব্যাংক মে মাসের মাঝামাঝি থেকে ডলার সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ায় আমদানি দায় নিষ্পত্তি করতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) জ্বালানি তেল আমদানির জন্য বেসরকারি ব্যাংকগুলোে মাধ্যমে ঋণপত্র (এলসি) খোলার কার্যক্রম পুনরায় চালু করতে চায়।
একমাত্র রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জ্বালানি তেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানটির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণে ন্যূনতম বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বজায় রাখার জন্য ডলার সরবরাহ বন্ধ রেখেছে।
বিপিসি বার্ষিক সাত বিলিয়ন ডলার মূল্যের জ্বালানি তেল আমদানি করে। এটি সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে আমদানি এলসি খোলে। তবে বেশিরভাগ এলসি খোলা হয় সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংককে বিপিসির জন্য ডলার সরবরাহের ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দিয়েছে। তবে এসব ব্যাংক পর্যাপ্ত ডলারের জোগান দিতে পারছে না।
জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তাদের মতে, ১০–১২ জুন বিপিসি প্রতিদিন ২৫ মিলিয়ন ডলারের চাহিদা দিয়েছিল। কিন্তু এটি ব্যাংকগুলো থেকে দৈনিক চাহিদার অর্ধেকেরও কম ডলার পেয়েছে।
ফলে, বিপিসি সময়মতো বিদেশি সরবরাহকারীদের আমদানি দায় পরিশোধ করতে পারছে না। ১৩ জুন পর্যন্ত সংস্থাটির বিদেশি সরবরাহকারীদের কাছে বকেয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৫০ মিলিয়ন ডলার।
অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত অবশ্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না বলে মনে করেন না।
'কোনো জাতীয় প্রতিষ্ঠান বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে আমদানি করলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ কমবে। তবে এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি যে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো সরকারি আমদানি পরিচালনা করতে অক্ষম হয়ে পড়েছে,' টিবিএসকে বলেন তিনি।
'রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগ পর্যন্ত আমদানির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আমাদের ডলারের প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমে যাওয়া এবং ব্যয় বৃদ্ধির কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু সহায়তা প্রয়োজন হয়েছে।'
বেসরকারি ব্যাংকের দিকে ঝুঁকছে বিপিসি
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিপিসি বলেছে, ডলার সংকটের কারণে বেসরকারি ব্যাংকগুলো জ্বালানি আমদানির জন্য এলসি খুলতে চায় না। এটি আরও জানায়, ওয়ান ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, ইস্টার্ন ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক এবং এইচএসবিসি অতীতে এলসি খুলত, কিন্তু প্রায় দুই বছর ধরে তা বন্ধ করে দিয়েছে।
বিপিসি এখন অন্তত পাঁচটি বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে তাদের মাধ্যমে এলসি খোলার বিষয়ে আলোচনা করেছে বলে বিষয়টি নিয়ে অবগত একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে জানিয়েছেন।
পরিস্থিতি বিবেচনায় বিপিসি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে জ্বালানি তেল আমদানির এলসি খোলার উদ্যোগ নিয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। জুলাই মাসে সরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খোলা হবে বলে আশা প্রকাশ করেন একজন কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, ডলার সংকট কিছুটা কম হওয়ায় বেসরকারি ব্যাংকগুলো এলসি খোলার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
'আমরা একাধিক উৎস থেকে আমদানি দায় মেটানোর উদ্যোগ নিয়েছি। কারণ কেবল সরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে আমদানি দায় মেটাতে গেলে একটি বা দুটি ব্যাংকের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। অনেক সময় সরবরাহকারীদের পাওনা সময়মতো পরিশোধ সম্ভব হয় না। এতে সরবরাহকারীরা পণ্য সরবরাহে যেমন নিরুৎসাহিত হয়, তেমনি আন্তর্জাতিক বাজারে দেশের রেটিংও কমে যায়,' টিবিএসকে বলেন জ্বালানি সচিব মো. নূরুল আলম।
পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বেশ কয়েকটি সবল বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে জ্বালানি তেল আমদানির বিষয়ে আলোচনা চলছে বলে জানান তিনি। 'এতে খরচ একটু বাড়বে, তবে একক কোনো ব্যাংকের ওপর চাপ থাকবে না। আবার আমদানি দায়ও সময়মতো পরিশোধ করা যাবে। বিপিসির তহবিলের অভাব নেই। কিন্তু টাকা থাকলেও বৈদেশিক মুদ্রা সবসময় পাওয়া যাচ্ছে না।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের মূল লক্ষ্য জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।'
আমদানি কমাতে বাধ্য হয়েছে বিপিসি
বিপিসি প্রতি মাসে ১৬ থেকে ১৭টি কার্গোর মাধ্যমে প্রায় পাঁচ লাখ টন পরিশোধিত ও অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে। কর্পোরেশন এ বছর প্রায় ৬০ লাখ টন জ্বালানি তেল আমদানি করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তবে বিপিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার সরবরাহ বন্ধ রাখায় বিপিসি বাধ্য হয়ে আমদানি কমাচ্ছে। চলতি জুনে দরপত্র নিশ্চিত করা ছিল, এমন দুটি কার্গো তেল জুলাই মাসে সরবরাহের জন্য সরবরাহকারীদের বিপিসি অনুরোধ করেছে বলে জানান তিনি
বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে। এ সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বেশি পরিমাণ জ্বালানি তেল সংগ্রহ করলেও ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশ তা পারছে না।
'ডলার সংকটের কারণে বিপিসি এখন যতটা সম্ভব কম আমদানি করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। এতে বিপিসির কাছে জ্বালানি মজুত কম থাকছে,' নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই বিপিসি কর্মকর্তা বলেন।
বিপিসির পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড প্ল্যানিং) অনুপম বড়ুয়া টিবিএসকে বলেন, আমদানি পরিস্থিতি যা-ই থাকুক, সরবরাহে কোনো সমস্যা নেই। মজুতও যথেষ্ট আছে।'
ডলার সংকটে কঠিন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে বেশকিছু শর্ত বাস্তবায়ন সাপেক্ষে সাত কিস্তিতে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিচ্ছে বাংলাদেশ। প্রতি কিস্তি ছাড়ের আগে শর্তগুলোর বাস্তবায়নের অগ্রগতি দেখে নেয় আইএমএফ।
ঋণের তৃতীয় কিস্তি আগামী মাসেই ছাড়ের কথা রয়েছে। এ কিস্তি ছাড়ের আগে গত এপ্রিলের শেষ সপ্তাহের আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করে।
ওই সফরে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত পরিস্থিতি বিশেষভাবে পর্যালোচনা করে আইএমএফ প্রতিনিধি দল। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী চলতি জুন শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০.১৯ বিলিয়ন ডলার রাখার কথা ছিল।
কিন্তু এ লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে না বলে জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর আইএমএফ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ১৪.৭৫ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করে দেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকসূত্রে জানা গেছে, জুন শেষে কমিয়ে নির্ধারণ করা এ লক্ষ্য অর্জনেও হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংক বাংলাদেশ। যে কারণে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংক সরবরাহে লাগাম টেনে রেখেছে।