এ বছর সৌদি আরবে হজের সময় গরমে এত হাজির মৃত্যুর কারণ কী?
সৌদি আরবে চলতি বছরের হজ পালন করতে গিয়ে শত শত লোক মারা গেছেন যাদের অধিকাংশের মৃত্যুই প্রচণ্ড গরমের কারণে হয়েছে। সৌদি আরবে হজের সময় তাপমাত্রা ৫১ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে।
এ বছর ১.৮ মিলিয়নেরও বেশি হাজির অংশগ্রহণে সৌদি আরবে হজ পালিত হয়েছে। হজে মৃত্যুর ঘটনা আগে ঘটলেও এ বছরের তীব্র গরমে হাজিদের আরও ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়।
বার্তা সংস্থা এএফপি একজন আরব কূটনীতিকের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, হজের সময় মিশরের ৬৫৮ জন নাগরিক মারা গেছেন। ইন্দোনেশিয়া জানিয়েছে, দেশটির ২০০ জনেরও বেশি নাগরিক মারা গেছে। ভারতের প্রায় ৯৮ জন নাগরিক মারা গেছে বলে জানা গেছে।
পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, জর্ডান, ইরান, সেনেগাল, তিউনিসিয়া, সুদান এবং ইরাকের স্বায়ত্তশাসিত কুর্দিস্তান অঞ্চলও হাজিদের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়রা হাসপাতালে নিখোঁজদের সন্ধান করছে।
এএফপির রিপোর্ট অনুযায়ী, যারা মারা গেছেন তাদের অর্ধেকেরও বেশি অনিবন্ধিত হাজি এবং তারা অনিয়মিত রুটের মাধ্যমে হজে অংশ নিয়েছিলেন। তারা সৌদি সরকারের দেয়া শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত তাঁবু এবং এসি বাসের মতো সুবিধা নিতে পারেননি।
শুক্রবার (২১ জুন) জর্ডান বেশ কয়েকজন ট্রাভেল এজেন্টকে আটক করার কথা জানিয়েছে যারা মক্কায় হাজিদের অনিবন্ধিত ভ্রমণে সহায়তা করেছিল। মিশরও একই ধরনের তদন্ত চালাচ্ছে।
সৌদি আরব সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হজে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়ালেও অনিবন্ধিত হজযাত্রীদের জন্য দেশটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। হাজিদের মৃত্যুর বিষয়ে সৌদি আরব এখনো কোনো মন্তব্য করেনি।
সৌদি আরবে হজের সময় গরমে এত হাজীর মৃত্যুর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রচণ্ড গরম
সৌদি আরবে ভয়াবহ তাপপ্রবাহের কারণে হাজিদের মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। তাপপ্রবাহ পানিশূন্যতা থেকে হাজিদের রক্ষা করতে সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সতর্কতা সত্ত্বেও অনেকেই তাপজনিত সমস্যা যেমন হিটস্ট্রোক বা সানস্ট্রোকে ভুগেছেন।
আইশা ইদ্রিস নামে একজন নাইজেরিয়ান হাজি বিবিসিকে জানিয়েছেন, প্রচণ্ড গরমের জন্য তাকে ছাতা ব্যবহার করতে হয়েছিল এবং ক্রমাগত জমজমের পানি দিয়ে নিজেকে ভিজিয়ে রাখতে হয়েছিল।
হিটস্ট্রোকে মারা যাওয়া নাইম নামের এক হাজির ছেলে বিবিসিকে তার মায়ের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেছেন, মায়ের সাথে হঠাৎ করেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় তারা অনেক খোঁজাখুঁজি করার পর জানতে পারেন যে তার মা হজের সময় মারা গেছেন।
প্রচণ্ড গরম, কঠোর শারীরিক পরিশ্রম এবং তীব্র রোদের মধ্যে বিস্তীর্ণ খোলা জায়গায় অবস্থান করার কারণে হাজিরা এই বছরের হজের সময় ঝুঁকির মধ্যে ছিলেন, বিশেষ করে যারা বয়স্ক বা যাদের স্বাস্থ্য সমস্যা ছিল।
১৪০০ সাল থেকে হজের সময় তাপজনিত মৃত্যুর ঘটনা রেকর্ড করা হচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে জানিয়েছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা পরিস্থিতি আরও খারাপ করছে। ক্লাইমেট অ্যানালিটিক্সের কার্ল- ফ্রিডরিখ স্লিউজনার বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, প্রাক-শিল্প পর্যায়ে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধির কারণে হজের সময় হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি পাঁচ গুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে।
অতিরিক্ত ভিড় এবং অপর্যাপ্ত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা
বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, সৌদি কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনার জন্য হজের সময় নির্দিষ্ট এলাকায় সংকট দেখা দিয়েছে। উপযুক্ত শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা অভাব থাকার পাশাপাশি, অতিরিক্ত ভিড়ের মধ্যে পর্যাপ্ত তাঁবু না থাকা সহ দুর্বলভাবে পরিচালিত আবাসন এই বছরের হজের সময় প্রধান সমস্যা ছিল।
ইসলামাবাদ থেকে হজ করতে আসা আমিনা বলেন, "মক্কার গরমে আমাদের তাঁবুতে কোনও এয়ার কন্ডিশনার (শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা) ছিল না। কুলারগুলোতেও বেশিরভাগ সময় পানি থাকত না।"
তিনি জানিয়েছেন, যথার্থ শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অভাবে তাঁবুর ভেতরে তীব্র গরমের অনুভূতি হওয়ার পাশাপাশি শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা থেকে আসা হাজি ফৌজিয়া জানিয়েছেন, তাঁবুতে ভিড় ও অতিরিক্ত গরমের কারণে অনেকেই অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন।
সমালোচনা সত্ত্বেও সৌদি স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাজিদের সুস্থতার জন্য বরাদ্দকৃত সম্পদের ওপর জোর দিয়েছেন। একটি সরকারি বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, হাজিদের জন্য ১৮৯টি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ৬ হাজার ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট মোবাইল ক্লিনিক এবং ৪০ হাজার চিকিৎসক-নার্স, প্রশাসনিক কর্মী এবং স্বেচ্ছাসেবকদের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
পরিবহণ ব্যবস্থা
হাজিদের প্রায়ই প্রচণ্ড গরমের মধ্যে দীর্ঘ দূরত্বে হেঁটে যেতে হয়েছে, যার জন্য অনেকেই রাস্তার প্রতিবন্ধকতা এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছেন।
একটি বেসরকারি গোষ্ঠীর হজ সংগঠক মুহাম্মদ আছা বলেছেন, গ্রীষ্মকালে একজন হাজিকে প্রতিদিন কমপক্ষে ১৫ কিলোমিটার হাঁটতে হয় যার জন্য তাকে হিটস্ট্রোক, ক্লান্তি এবং পানিশূন্যতার ঝুঁকিতে পরতে হয়।
তিনি জানিয়েছেন, সৌদি নিয়ন্ত্রকরা হজ নিয়ন্ত্রণ করলেও তারা হাজিদের সাহায্য করে না। হজের সময় তাদের যেসব তাঁবু দেয়া হয়েছে সেগুলোতে প্রবেশের জন্য যে রাস্তা ব্যবহার করা লাগে সেটির ইউটার্ন বন্ধ থাকায় হাজিদের তাঁবুতে পৌঁছানোর জন্য গ্রীষ্মের গরমে আড়াই কিলোমিটার হাঁটতে হয়েছে৷
তিনি আরো জানিয়েছেন, এই রুটে জরুরি পরিস্থিতিতে সাহায্য আসতে ৩০ মিনিট সময় লাগতে পারে এবং এই রুটে পর্যাপ্ত পানিরও ব্যবস্থা নেই।
অনিবন্ধিত হাজি
হজ পালনের জন্য হাজিদের একটি বিশেষ হজ ভিসার প্রয়োজন হয়। তবে কিছু ব্যক্তি যথাযথ কাগজপত্র ছাড়াই হজে যোগ দেয়ার চেষ্টা করেন।
সৌদি কর্মকর্তারা এটি বন্ধ করার চেষ্টা করলেও অনিবন্ধিত ব্যক্তিরা এই বছরও হজে অংশ নেন। প্রায়ই এসব অনিয়মিত হাজি কর্তৃপক্ষকে এড়িয়ে চলে, এমনকি যখন তাদের সাহায্যের প্রয়োজন হয় তখনও। অনিবন্ধিত হাজিদের জন্য তাঁবুতে ভিড় বাড়ে যেটি হজে মৃত্যুসংখ্যা বাড়ার একটি কারণ।
ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় হজ ও ওমরাহ কমিশনের চেয়ারম্যান মুস্তলিহ সিরাদজ বলেন, "আমরা মনে করি, যারা হজ ভিসা ব্যবহার করছেন না তারা হজ এলাকায় অনুপ্রবেশ করেছেন।"
সৌদি সরকারের হজ ও ওমরাহ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির উপদেষ্টা সাদ আল-কুরাশি বলেন, হজ ভিসা ছাড়াই যারা হজ করতে এসেছেন তাদের অবশ্য দেশে ফিরে যেতে হবে। তিনি আরো বলেন, নিবন্ধিত হাজিদের নুসুক কার্ড ব্যবহার করে চিহ্নিত করা হয় যেটিতে বারকোড থাকে। যাদের কাছে এই কার্ড থাকে না তাদের অনিবন্ধিত হাজি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
বয়স্ক ও অসুস্থ হাজি
অনেক অসুস্থ ও বয়স্ক ব্যক্তি হজে অংশ নেন এবং তাদের অনেকেই হজের সময় মারা যান। এই বছর হজের সময় প্রচণ্ড গরমের জন্য অনেক বয়স্ক হাজি অসুস্থ হয়েছেন। বেশ কয়েকজন বয়স্ক ও অসুস্থ হাজি মারাও গেছেন।
তাদের অনেকেই বৃদ্ধ বা অসুস্থ হলে পবিত্র শহরে মৃত্যুবরণ এবং সমাধিস্থ হওয়ার আশায় হজ করতে যান।
হজ করতে গিয়ে কেউ মারা গেলে কী হয়?
হজের সময় কোনো হাজি মারা গেলে হজ মিশনে মৃত্যুর খবর রিপোর্ট করা হয়। মৃত হাজিদের পরিচয় নিশ্চিত করতে কব্জি বা গলায় থাকা আইডি ব্যবহার করা হয়। ডাক্তারের কাছ থেকে মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর সৌদি প্রশাসন ডেথ সার্টিফিকেট দেয়।
মক্কার মসজিদ আল-হারাম বা মদিনার মসজিদে নববীর মত প্রধান মসজিদে জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। মৃতদেহ গোসল করানো ও কাফনে মোড়ানোর পর সৌদি সরকারের দেয়া ফ্রিজারে করে সেটি পরিবহণ করা হয়। এই সময় সমস্ত খরচ সৌদি সরকার বহন করে।
দাফন প্রক্রিয়া তুলনামূলক সহজ। কোনো চিহ্ন ছাড়াই মৃত ব্যক্তিকে কবর দেয়া হয়। কখনও কখনও অনেক লাশ এক জায়গায় দাফন করা হয়।
কাকে কোথায় কবর দেওয়া হয়েছে সেটি সৌদি সরকারের কাছে তালিকা করা থাকে যাতে পরিবারগুলো চাইলে কবর দেখতে পারে। সৌদি সরকার বিভিন্ন সংগঠন এবং রেড ক্রিসেন্টের সাথে 'মর্যাদাপূর্ণ এবং সম্মানজনকভাবে দাফন প্রক্রিয়া' সম্পন্ন করে।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়