ঢাকার নবাব পরিবার: নিলামেই নির্ধারিত উত্থান ও পতন
এটি মূলত গবেষক ও লেখক দেলওয়ার হাসানের 'ঢাকার নবাব পরিবার ও তৎকালীন ঢাকার সমাজ' বইয়ের পাঠপ্রতিক্রিয়া। বইটির বিষয়বস্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা শুধু ঢাকা নয়, বরং পুরো বাংলাদেশের তথা পূর্ব বাংলার মুসলমানদের নেতৃস্থানীয় অঞ্চল ছিল এই ঢাকা এবং একই সাথে ঢাকার নবাব পরিবার। ঢাকার এই নেতৃত্ব গড়ে উঠেছিল মূলত ঢাকার নবাবদের উত্থানের মধ্য দিয়ে, অর্থাৎ নবাবদের জয়যাত্রার সাথে সাথে ঢাকাও তার জয়যাত্রা বহাল রেখেছিল। এসব কথা কেবল ব্রিটিশ শাসনামলের জন্যই প্রযোজ্য এবং তা যে অর্থেই বলা হোক না কেন! '৪৭ পরবর্তী ইতিহাসে প্রমাণিত হয়েছে যে, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান ও অর্থনীতি শাস্ত্রের বিশ্ববিখ্যাত পণ্ডিত ইবনে খালদুনের 'কোনো শাসকগোষ্ঠী বা বংশের শাসন গৌরব ও ক্ষমতা শত বছরের বেশি সাধারণত স্থায়ী হয় না' এই তত্ত্ব সত্য।
পাঠক নিশ্চয়ই খেয়াল করে থাকবেন, এখানে 'ঢাকার নবাব' শব্দ দুটি খুব গুরুত্ব দিয়ে লেখা হয়েছে। এর কারণও আছে। আমরা যে নবাবদের ঢাকার হর্তাকর্তারূপে পাই, তাদের আগেও ঢাকায় নবাব ছিলেন; তারা মোগল নবাব হিসেবে পরিচিত। মজার বিষয় হলো, দুই নবাব পরিবারই বাংলায় ছিল বহিরাগত। ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে ইংরেজদের আগমন ও শাসনের সাথে মোগল নবাবদের পতন ত্বরান্বিত হয়েছিল এবং ঢাকার নবাবদের উত্থান নিশ্চিত হয়েছিল। এজন্যই লেখক দেলওয়ার হাসান লিখেছেন, 'ঢাকার ইতিহাসে আমরা দুটো নবাব পরিবারের সন্ধান পাই- একটি মোগল নবাব এবং আরেকটি ব্রিটিশ উপাধিপ্রাপ্ত ঢাকার নবাব'। আমাদের ইতিহাসের এই পাঠটি তাই সরল অঙ্কের মতোই জটিল।
২.
এই বইটি পড়ার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন আসতে পারে, কেন এরকম একটি বইয়ের প্রয়োজন হলো?
গ্রন্থকারের বয়ান দিয়ে শুরু করা যাক, 'ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে একদিকে যেমন ঢাকার পুরনো অভিজাত পরিবারগুলোর ক্রমাবনতি হতে থাকে, অপরদিকে তেমনি ধন-সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে ঢাকার নবাব পরিবারের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হতে থাকে এবং ক্রমান্বয়ে তারা পূর্ববঙ্গের সবচেয়ে ধনী ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীতে পরিণত হয়'।
বলাবাহুল্য, ঢাকার নবাব পরিবার প্রথমে ব্যবসায়িক সূত্রে ও পরবর্তীকালে জমিদারি সূত্রে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল।
গ্রন্থকার জানাচ্ছেন, 'মোগল নবাবদের বিলীয়মান সংস্কৃতির ক্ষীণ ধারার সাথে কোম্পানি সংস্কৃতির মিলন দূত হিসেবে কাজ করেছে ঢাকার নবাব পরিবার'। যার ফলে খাজা আবদুল গণির আমল থেকেই নবাব পরিবার ঢাকার সমাজ তথা পূর্ববঙ্গের সমাজে আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছিল। বলা চলে নবাব আবদুল গণির সময়কালেই সর্বোচ্চ উত্থান ঘটেছিল এই পরিবারের। একটি বহিরাগত পরিবার হয়েও ঢাকার লৌকিক সংস্কৃতিতে একটি নিজস্ব ধারার প্রবর্তন করেছিলেন তিনি। ঢাকার সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিবেশের পাশাপাশি ইসলামি সংস্কৃতির অকৃত্রিম পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও নবাবদের অবদান লক্ষণীয় বলে উল্লেখ করেছেন গ্রন্থকার।
এভাবে দেখা যায়, তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংযোগের ধারাটি কেবল ঢাকা শহরেই নয়, পূর্ব বাংলার বিস্তৃত অঞ্চলে কিছুটা জমিদারি সূত্রে এবং কিছুটা রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের পরম্পরায় সম্প্রসারিত হয়েছিল।
দেলওয়ার হাসান যথার্থই বলেছেন, 'ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যাহ্নকাল থেকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত এক শতাব্দীরও বেশিকাল ঢাকার নবাব পরিবার ঢাকা তথা পূর্ববঙ্গের সমাজজীবনে অসামান্য প্রভাব বিস্তার করেছিলেন'। গ্রন্থকারই জানিয়েছেন, 'প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানি শাসনের শেষের দিকে এ পরিবারের রাজনৈতিক ক্ষমতা ঢাকা ও পূর্ববঙ্গে সামাজিক প্রভাব বহুল পরিমাণে হ্রাস পায়। অবশেষে পাকিস্তানি শাসনের অবসান ঘটলে এ পরিবারের প্রভাব-প্রতিপত্তি নিঃশেষ হয় এবং ঢাকার সমাজের ওপর অবশিষ্ট নিয়ন্ত্রণ হারায়'। যে পরিবারটি এমন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিল, এরকম একটি পরিবারের ইতিহাস জানা আমাদের জন্য জরুরি বটে!
বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস চর্চায় ঢাকার নবাব পরিবারের উপস্থিতি অনিবার্য। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্যন্ত আমাদের জাতীয় ইতিহাসে নবাব পরিবারের সম্পর্ক অচ্ছেদ্য, সেটা যে অর্থেই হোক। আমরা যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের পরম্পরা লালন করছি এর সাথেও নবাব পরিবারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংশ্লেষ রয়েছে। ফলে আগ্রহী পাঠকদের কাছে এই পরিবারের তথ্যবহুল ইতিহাস গ্রন্থ প্রয়োজনীয় বটে!
৩.
নবাব পরিবারের উত্থানের গল্প জানিয়েছেন গ্রন্থকার- 'ঢাকার খাজা (তখনও নবাব উপাধি পায়নি) পরিবারের অসামান্য বাণিজ্যিক সাফল্য লাভের পর এ পরিবারের খাজা হাফিজউল্লাহ জমিদারি ক্রয় করতে শুরু করেন। এ সময় পূর্ব-বাংলার বেশিরভাগ মুসলিম জমিদার ঋণগ্রস্ত হওয়ায় এবং তাদের জমিদারির ভগ্নদশা হলে হাফিজউল্লাহ অনেক জমিদারি ক্রয় করতে সক্ষম হন'।
নিঃসন্তান খাজা হাফিজউল্লাহ মৃত্যুকালে সহোদর খাজা আলীমুল্লাহকে কয়েকটি উপদেশ দিয়েছিলেন, যথা- 'ব্যবসা থেকে পুঁজি প্রত্যাহার করে জমিদারিতে বিনিয়োগ করা, জমি যেন চরাঞ্চলে হয় এবং প্রজারা মুসলমান হলে নায়েব যেন হিন্দু হয়'। আলীমুল্লাহ এসব উপদেশ মেনেই ১৮২৫ থেকে ১৮৪৩ সাল পর্যন্ত পূর্ববঙ্গে একটি সমৃদ্ধ জমিদারি সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
উল্লেখ্য, ঢাকায় থিতু হওয়ার পূর্বে খাজা পরিবার সুদূর কাশ্মীর থেকে এসে সিলেটে বসতি গড়েছিলেন। সিলেটে থাকতেই ইউরোপীয়দের সঙ্গে, বিশেষ করে আর্মেনিয়ান, ফরাসি ও ওলন্দাজ ব্যবসায়ীদের সাথে ব্যবসা সূত্রে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন।
বৈষয়িক বিষয়ে অত্যন্ত চতুর খাজা আলীমুল্লাহ ১৮৩৫ সালে ফরাসিদের কাছ থেকে বর্তমান 'আহসান মঞ্জিল'টি কিনেছিলেন। তখন এটি ফরাসিদের কুঠি হিসেবে পরিচিত ছিল। ফরাসিদের আগে এটি জালালদি-ফরিদপুরের জমিদার শেখ এনায়েত উল্লাহর রাজকীয় বাসভবন ছিল, যা জমিদারের 'রংমহল' হিসেবে স্বীকৃত ছিল। এনায়েত উল্লাহর পুত্র মতিউল্লাহ এটি ফরাসিদের কাছে বিক্রি করেছিলেন।
খাজা আলীমুল্লাহর হাতেই নবাব পরিবারে একজন করে মোতাওয়াল্লী নির্ধারণের বন্দোবস্ত হয়। এরপর থেকেই এই পরিবারের একজন সদস্যকে মোতওয়াল্লী নিয়োগের নিয়ম প্রতিপালিত হয়ে আসছে। আলীমুল্লাহর পুত্র খাজা আবদুল গণি। আবদুল গণির পুত্র নবাব আহসান উল্লাহ্। আহসান উল্লাহর পুত্র হাফিজুল্লাহ ও সলিমুল্লাহ এবং কন্যা পরীবানু। সলিমুল্লাহর পুত্র নবাব হাবিবুল্লাহ ছিলেন সর্বশেষ নবাব। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, নবাব আবদুল গণির পরে আর এই পরিবারের কোনো কিছুরই বৃদ্ধি ঘটেনি। ইবনে খালদুনের তত্ত্ব এই পরিবারে কার্যকর হয়েছে।
অর্থ, বিত্ত, যশ, খ্যাতি ও প্রভাবের সাথে নবাব পরিবারের শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার কথাও জানিয়েছেন গ্রন্থকার দেলওয়ার হাসান।
তিনি লিখেছেন, 'উর্দু ও ফারসি ভাষায় নবাব পরিবারের যে কয়জন সাহিত্য সাধনার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন, তা বাংলা ভাষায় কেবল রবীন্দ্রনাথের পরিবারের সাথে তুলনা করা চলে'। ইতিহাসের অন্যান্য বিষয়ে যেসব কথা লিখেছেন, সেসব থিসিস অথবা অ্যান্টি-থিসিস দিয়ে হলেও কিছুটা গ্রহণযোগ্য, নিদেনপক্ষে বিতর্ক করার সুযোগ আছে। কিন্তু নবাব পরিবারের সাহিত্য চর্চা সম্বন্ধে গ্রন্থকারের এহেন মন্তব্য বইটির অন্যান্য বয়ানকেও প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাবে নিশ্চিত।
এই সুযোগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ঢাকা প্রসঙ্গে একটু আলাপ করা যাক। 'পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ' এবং 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা' বইতে সৈয়দ আবুল মকসুদ জানিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবদ্দশায় মাত্র দু'বার ১৮৯৮ ও ১৯২৬ সালে ঢাকায় এসেছিলেন এবং দুবারই নবাবদের আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন। এ গ্রন্থকারও জানিয়েছেন, শেষবার নবাবদের প্রমোদতরি 'তুরাগে' অবস্থান করেছিলেন। অর্থাৎ, নবাব পরিবারের সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যোগাযোগ ও সখ্য ছিল।
৪.
ঢাকা নগরীর গোড়াপত্তন ঘটে ১৬০৮ বা ১৬১০ সালে। এর আগে ঢাকা ছিল সুলতানি শাসনের অন্তর্ভুক্ত একটি স্থাপনা বিশেষ। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে সুবাদার ইসলাম খান রাজমহল থেকে ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তর করে জাহাঙ্গীরনগর নামকরণ করেন। এরপরে একাধিকবার রাজধানীর পরিবর্তন হয়েছে এবং পুনরায় ঢাকায় স্থিত হয়েছে। এসব জানা কথা, আমি বরং ভিন্ন আলাপে যাই। অনেকেই বলে থাকেন, অতীত ছিল ভালো, ছিল সুখের দিবস। আসলেই কী তাই? ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিককার কথায় দেলওয়ার হাসান লিখেছেন, 'এ সময়ে ঢাকা শহরে কলেরার প্রকোপ ছিল খুব বেশি। বিশেষত শুকনা মৌসুমে কলেরা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ত। ঢাকার বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করত শীতকালে।
এ সময় উদরাময় ও পানিবাহিত অন্যান্য রোগের প্রাদুর্ভাব ছিল ঢাকার সংবাৎসরিক ঘটনা'। বুড়িগঙ্গার পানি এতই দূষিত ছিল যে, কাছে যাওয়াও কঠিন ছিল। এসব মাত্র ২০০ বছর আগের ঢাকার চিত্র। অবশ্য এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন উঠতে পারে, আমরা কি পেছনে ফিরে যাচ্ছি নাকি ক্রান্তিকালের প্রসববেদনা সহ্য করতে হচ্ছে?
৫.
লেখক ও গবেষক দেলওয়ার হাসান রচিত 'ঢাকার নবাব পরিবার ও তৎকালীন ঢাকার সমাজ' বইটি পাঠক সমাবেশ থেকে চলতি বছরের (২০২৪) একুশে বইমেলায় বেরিয়েছে। কিন্তু গ্রন্থপাঠে ও গ্রন্থিত ভাষ্যে মনে হয়েছে এটি পুনর্মুদ্রণ বা পুনঃপ্রকাশ, যদিও ভূমিকা কিংবা কোথাও এরকম কিছুর উল্লেখ নেই। গ্রন্থকার দেলওয়ার হাসানের ইতিহাস নিয়ে অনেক কাজ আছে এবং দীর্ঘদিন ধরে লেখালেখি ও গবেষণায় ব্যাপৃত। আলোচ্য বইটিতেও তার গবেষণালব্ধ পরিশ্রমের লক্ষণ দৃশ্যমান। ঠিক এ কারণেই গ্রন্থকারের সমালোচনার পূর্বে এ কথাগুলোর উল্লেখ করছি।
ইতোপূর্বে ঢাকার নবাব পরিবার সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলামের 'ঐতিহাসিকের নোটবুক' বইতে 'নবাব পরিবারের উত্থান-পতন' শিরোনামে। ঐতিহাসিকের নোটবুক বইটি ২০১০ সালে বেরিয়েছে। প্রবন্ধটি নিশ্চয়ই আরও আগে লেখা হয়েছিল। ঢাকার নবাব পরিবার সম্বন্ধে অনেক লেখালেখি হলেও সিরাজুল ইসলামের মতো পাণ্ডিত্যপূর্ণ দ্বিতীয়টি চোখে পড়েনি। দেলওয়ার হাসানের বইতে দেশি-বিদেশি অনেক বই ও পত্রিকার তথ্যোল্লেখ থাকলেও সিরাজুল ইসলামের প্রবন্ধকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এজন্যই এ গ্রন্থপাঠে ও গ্রন্থিত ভাষ্যের সূত্রে আমার মনে হয়েছে, দেলওয়ার হাসানের বইটি সিরাজুল ইসলামের লেখার আগে গত শতাব্দীর শেষপাদে প্রথম প্রকাশ হয়েছিল। তবে সর্বসাম্প্রতিক প্রকাশনাতে 'নবাব পরিবারের উত্থান-পতন' প্রবন্ধ থেকে তথ্যোল্লেখ করা যেতো, কিন্তু তা অনুপস্থিত।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ওপরে পিএইচডি করা অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম একজন যশস্বী ইতিহাসবিদ, তার সুনির্দিষ্ট শিরোনামে লেখা সুস্পষ্ট মতামতকে গ্রহণ ও যুক্ত না করার ফলে 'ঢাকার নবাব পরিবার ও তৎকালীন ঢাকার সমাজ' বইটি অসম্পূর্ণ ও কিছু ব্যাখ্যাহীন তথ্যের ওপরে রচিত হয়েছে বলে মনে হয়েছে।
আরেকটি বিষয় হলো, অনুপম হায়াৎ সম্পাদিত 'নওয়াব পরিবারের ডায়েরিতে ঢাকার সমাজ ও সংস্কৃতি' শিরোনামীয় বই থেকেও তথ্যোল্লেখ চোখে পড়েনি।
যাই হোক, নবাবী আলাপে ফিরে যাই। 'বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উত্থান বা পতন পারিপার্শ্বিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত'। শুধু ঢাকার নবাব নয়, পূর্বের ও পরের সকল প্রভাববিস্তারকারী ব্যক্তি ও পরিবারের জন্যই এটি নির্মমভাবে সত্য।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম নিশ্চিত করে জানিয়েছেন যে নামের আগে খাজা যুক্ত হয়েছিল মূলত 'কোজা' থেকে। কাশ্মীর থেকে ভাগ্যেন্বেষণে নবাবদের পূর্বপুরুষেরা প্রথমে সিলেটে ও পরে ঢাকায় থিতু হয়েছিলেন। ছোট ছোট ব্যবসার পাশাপাশি সুদের ব্যবসাই ছিল প্রাথমিক উত্থানের সোপান। এভাবেই বণিক থেকে ধনিক শ্রেণিতে উন্নীত হয়েছিল নবাব পরিবার। ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে একটি নিলামের মাধ্যমে বরিশাল অঞ্চলে প্রথমবার তালুক কিনে জমিদারি লাভ করেছিলেন এবং শতবর্ষ পরে অপর একটি নিলামের মাধ্যমে ইস্টার্ন রেলওয়ে তথা ব্রিটিশ সরকারের কাছে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ তালুক বিক্রির মাধ্যমে জমিদারির পতনের দ্বার উন্মোচন করেছিলেন।
প্রথম নিলামে বিক্রেতা সরকার ও ক্রেতা হাফিজউল্লাহ এবং দ্বিতীয় নিলামে বিক্রেতা নবাব সলিমুল্লাহ ও ক্রেতা সরকার। এই দুই নিলামের মাঝখানে আমরা দেখতে পাই খাজা আলীমুল্লাহর ঘোড়া ও হীরা, নবাব আবদুল গণির আহসান মঞ্জিল, দান-দরবার, শান-শওকত এবং নবাব সলিমুল্লাহর মুসলমান সমাজের নেতৃত্ব লাভ ও বিশাল ঋণ নিয়ে মৃত্যুবরণ। প্রথম নিলামেরও পূর্বাপর ছিল।
সিরাজুল ইসলামের মতে, 'চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পুরাতন আভিজাত্যকে এমন ক্ষণস্থায়ী করে তোলে যে এ বন্দোবস্তের প্রথম দশ বছরের মধ্যে বাংলার প্রতিটি বড় জমিদারি ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায়'। মোগল শাসনামল জগৎ শেঠ, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়, মহারাণী ভবানীর জন্য অনুকূলে থাকলেও ব্রিটিশ শাসনামল তাদের জন্য হয়ে উঠেছিল চরম প্রতিকূল। তাই নতুন দৃশ্যপটে নতুন ভূমিকা পালনের জন্য উদ্ভব হয় নতুন পরিবারের, ঢাকার নবাব পরিবার ছিল তেমনি একটি নতুন পরিবার।
দুনিয়াতে সম্পদের এরকম হাত বদল প্রাচীন রীতি। এই বাংলাতেও এর অসংখ্য নজির আছে। কাশিমবাজারের রাজ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন একজন মুদি দোকানি। নড়াইলের জমিদার কালিশংকর ছিলেন রাণী ভবানীর একজন লাঠিয়াল ও নায়েব। ভূ-কৈলাশের ঘোষাল রাজের প্রতিষ্ঠাতা গোকুল ঘোষাল ছিলেন একজন বেনিয়া, তথা ব্রিটিশ কোম্পানির দালাল। কলকাতার ঠাকুর, দেব, দত্ত, মল্লিক, দে পরিবারও বেনিয়া থেকে ধনকুবের হয়েছিলেন। ফলে বহিরাগত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও সুদের কারবারি প্রথমে বেনিয়া এবং পরে জমিদারি লাভ করবে, এটাই স্বাভাবিক বলা চলে।
সিরাজুল ইসলামের ভাষ্যে, 'যুক্তবাংলায় যেসব দেশি লোক রাতারাতি ধনকুবেরে পরিণত হয়েছিলেন, তারা ছিলেন ইংরেজ সাহেবদের সহচর বেনিয়া মুৎসুদ্দি'। এদের নিয়েই সাংবাদিক ও লেখক ভবানীচরণ বন্দোপাধ্যায় ১৮২৫ সালে নববাবুবিলাস এবং ১৮৩১ সালে নববিবিবিলাস লিখেছিলেন। বর্তমানকালেও সরকারের আনুকূল্য ব্যতিরেকে ব্যবসায় ব্যুৎপত্তি অর্জন প্রায় অসম্ভব। সরকারের আনুকূল্যে যারা ধনে-মানে বড় হয়, সরকারের সাথে বোঝাপড়ার সংকটে শূন্য হাতে ফিরতি টিকেটও নিশ্চিত হয়। এটা সম্ভবত আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য নিয়ম। লিও তলস্তয় যথার্থই লিখেছেন, রাজত্ব, রাজনীতি, ক্ষমতা এসব যে শত বছরের স্বপ্ন মাত্র!'
দেলওয়ার হাসানের পরিশ্রমলব্ধ গ্রন্থটিতে নবাবদের উত্থান ও পতনের পূর্বাপর বিশ্লেষণের ঘাটতি থাকলেও নতুন পাঠকের চিন্তার খোরাক জোগাবে, এতে সন্দেহ নেই। তবে খানিক বিভ্রান্তির সুযোগও আছে।
লেখক: অনুসন্ধিৎসু পাঠক ও রাজনৈতিক কর্মী।