বিদেশ ফেরত রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের অনিশ্চিত জীবন
'১৬ বছর বিদেশে ছিলাম। সবাই মনে করে আমার অনেক টাকা। আসলে আমার কিছুই নেই। সাত সদস্যের পুরো পরিবার আমার ওপর নির্ভরশীল। করোনাভাইরাসের কারণে বিদেশের চাকরিটাও হারিয়েছি। দেশে কিছু একটা করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ। সংসারের খরচ যোগানোর জন্য নিজের স্মার্টফোনটাও বিক্রি করে দিয়েছি। না পারছি কাউকে বলতে, না পারছি সইতে।'
বুকভরা কষ্ট নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন রেমিট্যান্স যোদ্ধা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার অরুয়াইল গ্রামের বাসিন্দা ফারুক আহমেদ।
ফারুকের মতো দেশে আসা অধিকাংশ প্রবাসী করোনাভাইরাসের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। জীবিকার উৎস হারিয়ে এখন চরম অর্থকষ্টে দিনানিপাত করছেন তারা। সংসার চালাতে বাধ্য হয়ে তাদের অনেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়েছেন। ফলে কর্মহীনতা আর ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে প্রবাস ফেরতদের। আদৌ প্রবাসে যেতে পারবেন কি-না, সেটিও জানা নেই তাদের।
প্রবাস ফেরতদের নিয়ে করা একটি জরিপের ফলাফলের ওপর আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা- আইওএম প্রকাশিত 'র্যাপিড অ্যাসেসমেন্ট অব নিডস অ্যান্ড ভালনারেবিলিটিস অব ইন্টারনাল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল রিটার্ন মাইগ্র্যান্টস ইন বাংলাদেশ' শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে বিদেশ ফেরতদের প্রায় ৭০ শতাংশই জীবিকাহীন। আর একেকজন অভিবাসী গড়ে তার পরিবারের তিনজন সদস্যকে সহায়তা প্রদান করে থাকেন।
সম্প্রতি আইওএমের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২০২০ সালের মে এবং জুলাই মাসে বাংলাদেশের ১২টি উচ্চ অভিবাসনপ্রবণ জেলায় এই জরিপ পরিচালনা করা হয়। যার মধ্যে সাতটি জেলায় ভারতের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে উপার্জন ব্যবস্থা, সামাজিক সেবা ও স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক সহায়তার নেটওয়ার্কের অভাবে হাজারও অভিবাসী কর্মী প্রবাসে যে দেশে কাজ করছিলেন, সেখান থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন।
দেশের উচ্চ অভিবাসনপ্রবণ জেলাগুলোর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অন্যতম। এ জেলার প্রায় তিন লাখ মানুষ ইউরোপ-আমেরিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে থাকেন। এসব প্রবাসীর আয়েই চলে তাদের পরিবার। এ ছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিনটি উপজেলার সঙ্গে ভারতের সীমান্ত রয়েছে।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকে গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় ১৩ হাজার ৩৭ জন প্রবাসী এসেছেন। এদের অনেকেই বিদেশে চাকরি হারিয়ে একেবারে দেশে চলে এসেছেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে দেশেও কোনো কাজ পাচ্ছেন না। অথচ করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর আগেও এসব প্রবাসীই গড়ে ৪০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত উপার্জন করেছেন।
রেমিট্যান্স যোদ্ধা ফারুক আহমেদ জানান, আরব আমিরাতের দুবাই শহরে একটি প্রসাধনীর দোকানে সেলসম্যান হিসেবে কাজ করতেন। প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা বাড়ি পাঠাতেন। তিন মাসের ছুটি শেষে গত ১৯ মার্চ দুবাই যাওয়ার কথা ছিল তার। ফ্লাইট বন্ধ থাকায় যেতে পারেননি। এপ্রিলে দুবাই থেকে দোকান মালিক ফোন করে জানান, ব্যবসা মন্দা হওয়ায় তাকেসহ আরও কয়েকজনকে ছাঁটাই করা হয়েছে।
'আগে ছুটিতে দেশে এসে বিলাসবহুলভাবে চলাফেরা করতাম। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে যে নিদারুণ কষ্টে আছি, তা বর্ণনা করার মতো নয়। দুবাই যেতে না পেরে দেশেই কিছু করার চেষ্টা করেছি। অনেকের কাছে সাহায্য চেয়েও পাইনি। কারও কাছে ভিক্ষাও চাইতে পারছি না', যোগ করেন তিনি।
আরেক রেমিট্যান্স যোদ্ধা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উজেলার চারপাড়া এলাকার সোহেল রানা জানান, ওমানের মাস্কাট শহরে একটি বাসায় কাজ করতেন তিনি। বাড়িতে প্রতি মাসে ৩০-৪০ হাজার টাকা পাঠাতেন। মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে এক মাসের জন্য গত জানুয়ারিতে দেশে আসেন।
কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘ সাত মাসেও ওমানে যেতে না পারায় তার ইকামার (ভিসা) মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে। ফ্লাইট খুললেও ওমানে গিয়ে চাকরি ফেরত পাবেন কি না, সেটি নিয়েই এখন তার যত দুশ্চিন্তা। মালিককে অনেকবার ফোন করলেও রিসিভ করছেন না।
'পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি আমি। সংসার চালাতে কিছুদিন রাজমিস্ত্রির কাজ করার পর ঢাকায় একটি কাপড়ের দোকানে আট হাজার টাকা বেতনে চাকরি নিয়েছিলাম। কিন্তু কাপড়ের ব্যবসা মন্দা হওয়ায় চাকরিটা বেশিদিন টিকেনি। টাকার অভাবে বিয়ের উপযুক্ত বোনকেও বিয়ে দিতে পারছি না। এরই মধ্যে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। কীভাবে শোধ করব, জানি না', আক্ষেপ করে বলেন সোহেল।
সৌদিআরব ফেরত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার ইসলামপুর গ্রামের মো. আকতারুল ইসলাম জানান, ১১ বছর তিনি ওই দেশে ছিলেন। সেখানে দুই ভাইয়ের সঙ্গে ফার্নিচারের ব্যবসা করতেন। চার মাসের ছুটি শেষে মার্চে সৌদিআরব যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে দেশেই আটকা পড়ে আছেন। গত জুলাই মাসে ভিসার মেয়াদও ফুরিয়ে গেছে।
করোনাভাইরাস মহামারির এই সময়ে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের ঘুরে দাঁড়াতে প্রয়োজনীয় সহায়তার জন্য সরকারের কাছে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি বিশিষ্টজনদের। প্রবাসফেরত কল্যাণ সমিতিও আর্থিক সহায়তা দিয়ে প্রবাসীদের দুঃসময়ে পাশে দাঁড়ানোর জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রবাসফেরত কল্যাণ সমিতির সহ-সভাপতি শফিকুল আলম স্বপন বলেন, করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে প্রবাস থেকে আসা বাংলাদেশিরা চরম অর্থকষ্টে আছেন। অর্থের অভাবে দেশেও কোনো কিছু করতে পারছেন না তারা। সংসার চালাতে গিয়ে অনেকই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। প্রবাসফেরতদের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে সরকারি অর্থসহায়তা প্রয়োজন।
'প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের কারণেই দেশের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। কিন্তু মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে তাদের অনেকেই আজ অসহায়। দেশেও কোনো কাজকর্ম নেই, আবার বিদেশেও যেতে পারছেন না। এ অবস্থায় প্রবাসফেরতদের জন্য সুদমুক্ত বিশেষ ঋণ দিয়ে তাদের ব্যবসা করার সুযোগ করে দিলে হয়তো তারা পরিবার নিয়ে চলতে পারবেন,' বললেন জেলা নাগরিক ফোরামের সভাপতি পীযূষ কান্তি আচার্য।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক হায়াত উদ-দৌলা খাঁন বলেন, 'যেসব প্রবাসী দেশে ফিরে বেকার হয়ে পড়েছেন, তাদের জন্য চার শতাংশ সুদে এসএমই ও কৃষি ঋণ দেওয়া হবে। এজন্য ব্যাংকগুলোতে প্রবাসী ডেস্কও খোলা হয়েছে। যারা আমাদের সঙ্গে কিংবা ইউএনওদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের অসুবিধার কথা জানাবেন, তাদেরকে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।'