‘যাকে ধরে নিয়ে যান, তাকেই খাবার টেবিলে বসান—জাতিকে নিয়ে মশকরা করবেন না’: হাইকোর্ট
কাউকে আটকের পর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) কার্যালয়ে খাবার টেবিলের বসিয়ে ছবি ও ভিডিও প্রকাশের বিষয় নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট।
আদালত বলেন, 'কাউকে আটক করে ডিবি অফিসে নিয়ে খাবার খাওয়াচ্ছেন, সেসবের ছবি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানান মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। এটি কি জাতির সাথে মশকরা নয়? এটি আপনাদের কে করতে বলেছে? ডিবি অফিসে যাকে ধরে নিয়ে যান, তাকেই খাবার টেবিলে বসান। এভাবে জাতিকে নিয়ে মশকরা করবেন না।'
কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি না চালানোর নির্দেশনা চেয়ে এবং ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে (ডিবি) আটক থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে পরিবারের কাছে ফেরত দেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে– রিট আবেদনের ওপর শুনানির সময় সোমবার (২৯ জুলাই) এসব মন্তব্য করেন বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসেন দোলনের হাইকোর্ট বেঞ্চ।
শুনানির এক পর্যায়ে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাছান চৌধুরী বলেন, কোটাবিরোধী আন্দোলনের ছয়জন সমন্বয়ককে ডিবি হেফাজতে তাদের নিরাপত্তার জন্য রাখা হয়েছে। মিডিয়ায় দেখা গেছে তারা কাঁটাচামচ দিয়ে খাবার খাচ্ছেন। তখন আদালত এসব মন্তব্য করেন।
রিট আবেদনের পক্ষে শুনানিতে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নাম দিয়ে যে কার্যকালাপ হচ্ছে, তা মেনে নেওয়া যায় না। ৭১ সালে দেখেছি পাক হানাদাররা রাতের বেলা ব্লক রেড দিয়ে খুঁজতো মুক্তিবাহিনী আছে কি-না। যে দেশটা আমরা ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময় স্বাধীন করেছি, ২০২৪ সালে সেই দেশে রাত ২টা-৩টায় ব্লক রেড দিয়ে বাসায় ছাত্র আছে কি-না খোজা হয়। যদি ছাত্র থাকে তাহলে তাদের মোবাইল ফোন চেক করা হয়। রাস্তাঘাটেও ছাত্রদের ফোন চেক করা হয়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, কোন আইন বলে? কোন অধিকার বলে?- এটা করা হয়। ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন চেক করার অধিকার কারো নেই।
ব্যারিস্টার সারা হোসেন আদালতে বলেন, আমরা এসেছি আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের ওপর গুলি না করার নির্দেশনা চেয়ে। ছয়জনকে তুলে নেওয়া হয়েছে। কাউকে নিরাপত্তার স্বার্থে তুলে নেওয়া যায় না। তাদেরকে যেন মুক্তি দেওয়া হয়। বা কোর্টে প্রডিউস (হাজির) করা হয়। একজনকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিরাপত্তার নামে তুলে নিয়ে রাখা যাবে, এটা কোথায় আছে। সংবিধানের ৬১ অনুচ্ছেদে আধে হেফাজতে রাখা মানে বেআইনী। উচ্চ আদালতের অনেক নির্দেশনা আছে। এই আদালত নির্দেশ দিতে পারেন। তারা বলছেন, যে ছয়জন তাদের হেয়াজতে আছে। এখন প্রশ্ন হলে তাদের সম্মতি নিয়ে তাদের হেফাজতে রাখা হয়েছে কি-না। এ বিষয়ে যেকোনো ব্যক্তি আবেদন করতে পারেন। আমরা আমাদের বিবেকের তাগিদে এসেছি।
অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ মেহেদী হাছান চৌধুরী বলেন, উনারা কি নিশ্চিত করে বলতে পারবেন বিটিভি ভবন, মেট্রোরেলে, সেতু ভবনে আর হামলা হবে না। ছাত্র নিহতের ঘটনায় তদন্ত কমিশন হয়েছে। কেউ বেআইনী কাজ করলে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি বলেন, ৬ জনকে দেখেছি ডিবি অফিসে কাঁটাচামচ দিয়ে খাচ্ছে। তখন আদালতে উপস্থিত আইনজীবীরা উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। এসময় আদালত রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর উদ্দেশ্যে বলেন, জাতিকে নিয়ে মশকরা করবেন না।
অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোর্শেদ আদালতে বলেন, দুই দিক থেকে ইনজুরি হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও আক্রান্ত। এসময় আদালত বলেন, আটকের কথা বলে কি দিনের পর দিন রেখে দেবেন? এরপর শেখ মো. মোর্শেদ বলেন, যে ছয়জনের কথা এসেছে তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ আদালতে আসেননি।
তখন আদালত বলেন, আজকের প্রথম আলো দেখেন। তাদেরকে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।
অতিরিক্ত অ্যটর্নি জেনারেল মেহেদী হাছান চৌধুরী আরো বলেন, প্রতিটি ঘটনারই বিচার হবে। সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায়ে এনে শাস্তি নিশ্চিত করা হবে বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন।
আদালত এ বিষয়ে শুনানি নিয়ে মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) পরবর্র্তী শুনানি ও আদেশের জন্য দিন ধার্য করেছেন বলে জানান রিটকারীরা।
এর আগে সোমবার সকালে কোটা সংস্কারের দাবিতে কর্মসূচি পালনকালে আন্দোলনকারীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে গুলি না চালানোর নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়। একইসঙ্গে রিটে কোটা আন্দোলনের ৬ জন সমন্বয়কের ডিবি হেফাজত থেকে মুক্তির নির্দেশনা চাওয়া হয়।
জনস্বার্থে রিটটি দায়ের করেন সুপ্রিম কোর্টের দুই আইনজীবী আইনুন্নাহার সিদ্দিকা ও মনজুর আল মতিন। রিটে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শক, সেনাবাহিনী প্রধানসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়েছে।
আদালতে রিটের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না ও সারা হোসেন এবং আইনজীবী অনীক আর হক শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদেী হাসান চৌধুরী ও শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ শুনানিতে অংশ নেন।
রোববার (২৮ জুলাই) 'নিরাপত্তাজনিত কারণ' দেখিয়ে ডিবি হেফাজতে নেওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছয় সমন্বয়কের সঙ্গে এক টেবিলে বসে নাস্তা করার কয়েকটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেন ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়করা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন বলে তাদের ডিবি কার্যালয়ে এনে তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন– এরকম ক্যাপশন দিয়ে ফেসবুকে ছবিগুলো পোস্ট করেন ডিবি প্রধান হারুন-অর রশীদ।
গত শুক্রবার (২৬ জুলাই) কোটা সংস্কার আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদারকে হাসপাতাল থেকে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। পরে শনিবার (২৭ জুলাই) মো. সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহ ও নুসরাত তাবাসসুমকেও ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়।