আন্দোলন দমনে নির্বিচার হত্যা মানবতাবিরোধী অপরাধ: বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা, গণগ্রেপ্তার, অবৈধ আটক, নিপীড়ন ও নির্যাতন সংবিধান, সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা ও বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য বিভিন্ন মানবাধিকার দলিলের স্পষ্ট লঙ্ঘন বলে মনে করেন দেশের কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিক। তারা বলেছেন, আন্দোলন দমনে নির্বিচার হত্যা মানবতাবিরোধী অপরাধ।
আজ মঙ্গলবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে 'হত্যা, অবৈধ আটক ও নির্যাতনের বিচার চাই' শিরোনামে বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজের ব্যানারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তারা এসব কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল, ড. শামসুল হুদা, সামিনা লুৎফা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মির্জা তাসলিমা সুলতানা উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলন থেকে তারা হত্যা, গণগ্রেপ্তারসহ নির্যাতনের ঘটনার সঠিক তদন্ত ও জড়িতদের শাস্তিসহ ১১টি দাবি তুলে ধরেন।
অন্য দাবিগুলো হলো-
- প্রতিটি হতাহতের এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অস্ত্রের ব্যবহার ও বল প্রয়োগের বিষয়ে জাতিসংঘের উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে তদন্ত করতে হবে;
- ইতোমধ্যে সংগৃহীত ছবি, ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে চিহ্নিত হামলাকারীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে;
- সরকারকে হতাহতের শিকার ব্যক্তিদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করতে হবে।
- সকল নিহত ও আহত নাগরিকের সম্মানে রাষ্ট্রীয়ভাবে যথাযথ মর্যাদায় শোক ঘোষণা করতে হবে;
- দায় মেনে নিয়ে প্রত্যেক নিহতের পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে। আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে;
- অবিলম্বে আটক শিক্ষার্থীদের মুক্তি দিতে হবে এবং শিক্ষার্থী গ্রেপ্তারের চলমান প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে হবে এবং সেখানে অস্ত্রধারী ও প্রভাব বিস্তারের রাজনীতি বন্ধ করতে হবে;
- 'তথাকথিত' ডিবি হেফাজত থেকে কোটা আন্দোলনের সমন্বয়কারীদের মুক্তি দিতে হবে। এভাবে জোর করে উঠিয়ে নেওয়া আর বেআইনি হেফাজতের ব্যাখ্যা দিতে হবে এবং এর সাথে জড়িত সকলকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করতে হবে;
- ভয় দেখানোর সংস্কৃতি থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে। কারফিউ ও সেনা প্রত্যাহার করতে হবে, সাঁজোয়া যান সরিয়ে নিতে হবে, হেলিকপ্টারের পাহারা থামাতে হবে, ব্লক রেইড, গণগ্রেপ্তার, ছাত্র-অভিভাবক হয়রানি বন্ধ করতে হবে;
- ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পূর্ণ মাত্রায় খুলে দিতে হবে এবং
- সহিংসতা দমনের নামে বিরোধী মত দমন করা যাবে না।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, কোটা সংস্কারের দাবিতে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনরত নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর গত ১৬ জুলাই থেকে পুলিশসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন বাহিনী ও ছাত্রসংগঠনের কর্মীরা নজিরবিহীন সহিংস দমন-পীড়নের তাণ্ডব চালিয়েছে। এতে দুই শতাধিক নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন, ছয় হাজারের বেশি নাগরিক গুরুতর আহত হয়েছেন। যাদের বেশিরভাগই সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন কলেজ ও স্কুলপড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রী এবং খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ।
আহতদের মধ্যে ৬১৫ জন দৃষ্টি হারানোর আশঙ্কায় আছেন। নিহতদের মধ্যে রয়েছে নয় শিশু, যাদের বয়স ৪-১৬ বছরের মধ্যে। এদের মধ্যে চার শিশু নিজ বাড়িতে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। হতাহতের মধ্যে কয়েকজন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সংবাদকর্মীও রয়েছেন।
তারা বলেন, দেশের বেসামরিক নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ দমনের জন্য জাতিসংঘের লোগো সম্বলিত সাঁজোয়া যান রাস্তায় নামানো হয়েছিল, সেনাবাহিনী ও সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীকে নিয়োজিত করা হয়েছিল, কারফিউ জারি করে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল এবং হেলিকপ্টার থেকে টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও অভিযোগমতে গুলি ব্যবহার করা হয়েছিল, যা দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন।
শিক্ষার্থী আন্দোলনের সমন্বয়ক ও কর্মীদের অনেককে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে বা অবৈধভাবে আটক রেখে তাদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে এবং হচ্ছে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতাল থেকে জোর করে ডিবি পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে সমন্বয়কারীদের। নিরাপত্তার অজুহাতে বেআইনিভাবে তথাকথিত ডিবি হেফাজতে রেখে আন্দোলন প্রত্যাহারের বিবৃতি ডিবি কার্যালয় থেকেই তাদের দিয়ে পাঠ করানো হয়েছে। আটক রেখে এমন বিবৃতি পড়ানোর ঘটনা সংবিধান ও আইনের সরাসরি লঙ্ঘন।
এসব ঘটনায় প্রাণহানির দায় প্রধানত সরকারের বলেও মনে করেন বক্তারা।
তারা আরো বলেন, এভাবে নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা, গণগ্রেপ্তার, অবৈধ আটক, নিপীড়ন ও নির্যাতন সংবিধান, সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা ও বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য বিভিন্ন মানবাধিকার দলিলের (যেমন- ১৯৬৬ সালের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত চুক্তি, নির্যাতন বিরোধী চুক্তি) স্পষ্ট লঙ্ঘন। আন্দোলন দমনে নির্বিচার হত্যা মানবতাবিরোধী ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারযোগ্য অপরাধ।