বৈষম্যবিরোধী গ্রাফিতিতে রাঙা হয়ে ওঠা বারুদপোড়া মিরপুর
রংপুরে আবু সাঈদ গুলির মুখে বুক পেতে দেওয়ার পর অনন্যার ভয়ডর হঠাৎই উবে গিয়েছিল। মাকে বুঝিয়েছিলেন, সাঈদ ভাইয়ের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার দায়িত্ব এবার তাদেরকে নিতে হবে। ব্যাগে মরিচের গুঁড়া ভরে বেড়িয়ে যাচ্ছিলেন, মা পেছন থেকে ডেকে খুন্তিও ধরিয়ে দিয়েছিলেন। জমানো কিছু টাকা ছিল, তা দিয়ে পানি, বিস্কিট, হেক্সিসল, মাস্ক কিনে আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিলি করেছেন।
দিন দুই পরে সেবিকা থেকে হয়ে উঠেছিলেন প্রটেস্টার বা প্রতিবাদী। আগে থেকেই আন্দোলনে যুক্ত বন্ধুরা একটা কাঠের লাঠি দিয়েছিলেন। সেটি নিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি প্রতিদিন ছিলেন রাস্তায়। সবদিন সববেলাতেই ছিল উৎকণ্ঠা। ধাওয়া আর পালটা ধাওয়ায় সময় পার হয়েছে। টিয়ারগ্যাসের ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করেছে।
রাতে বাসায় ফিরে ফোনে ফোনে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন, পরদিনের কর্মসূচি জেনেছেন। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন ঘটলে বিজয় মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন। ৬ আগস্ট সকালে আবার তুলে নিয়েছিলেন লাঠি, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করেছেন। ৭ আগস্ট সারাদিন ঝাড়ু হাতে জঞ্জাল সরানোর কাজ করেছেন মিরপুর ১০ নম্বর গোলচক্কর ও ২ নম্বরে মিরপুর থানার আশপাশে।
৮ আগস্ট বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় মেট্রো স্টেশনের কাছে চলে এসেছেন। হোয়াটসঅ্যাপে পরামর্শ সভা হয়েছে দুদিন আগেই। মেট্রোরেলের পিলার ও দেয়ালে যত অশালীন শব্দ বা বাক্য রয়েছে, সেগুলো মুছে দিয়ে তার বদলে গ্রাফিতি বা দেয়ালচিত্র আঁকা হবে। এতে সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনের চেতনাও ধরা থাকবে।
অনন্যার হাতে এখন রং-তুলি। দলে তারা আটজন। সকালে এসে তারা পিলারের গায়ে চার ধর্মের চারজন প্রতিনিধির অবয়ব এঁকে বুঝিয়েছেন দেশটি সবার। আরেকপাশে এক বালিকাকে দেখা যাচ্ছে দেশের পতাকা বুক দিয়ে আগলে রাখতে, সে বলছে, দিস ইজ মাই মাস্টারপিস (হবেকি'র সুবোধ সিরিজেও এমনটি দেখা গেছে)।
অনন্যাকে বিদায় জানিয়ে মিরপুর সাড়ে দশের দিকে এগিয়ে যেতেই একটি গ্রাফিতিতে চোখ আটকে গেল। এটির কাজ অর্ধেক শেষ হয়েছে তবে লেখাটা পড়া যাচ্ছে — পাহাড় থেকে সমতল বাংলাদেশ সবার। অঙ্কনকারীদের একজনকে শুধিয়ে জানলাম, ভাবনাটি সুমিষ্ট চাকমার।
মিরপুর বাংলা কলেজের এ ছাত্র এগিয়ে এসে বললেন, 'পাহাড়ের আদিবাসীদের কথা আমরা অনেক সময় মনে রাখতে পারি না, অথচ পাহাড়ের লোকও বৈষম্যের শিকার, নিগ্রহের শিকার। শুধু সমতলের বৈষম্য দূর করে মুক্তি আসবে না, সবখান থেকে বৈষম্য বিভেদ দূর করতে হবে।'
এরপর বিইউবিটির সুরাইয়া আক্তারের দলের সঙ্গে দেখা হলো। তারা বড় একটি লাল বৃত্ত এঁকেছেন সূর্যের প্রতীকে। মাঝখানে লিখেছেন কাকতাল ব্যান্ডের একটি গানের কথা: রক্ত গরম মাথা ঠান্ডা। ব্যাপারটি তিনি বুঝিয়ে বললেন, 'এখন মাথা ঠান্ডা রেখে ভালো-মন্দ বিবেচনা করা দরকার। আমরা নির্যাতন, নিপীড়নের শিকার হয়েছি। কিন্তু তা-ই বলে একই অন্যায় যদি আমরাও করি, তবে আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে পারব না।'
তিতুমীর কলেজের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী সানজানা হকের নেতৃত্বে কাজ করছে ১০-১২ জনের একটি দল। তারা প্রায় ২০ ফুট দীর্ঘ এক দেয়ালে গ্রাফিতি করছেন। আবু সাঈদ, মুগ্ধ, প্ল্যাকার্ড, পোস্টার, পতাকা — আন্দোলনের বিভিন্ন প্রতীক ও দৃশ্যপট স্থান পাচ্ছে গ্রাফিতিটিতে। এর মাঝখানে বড় করে লেখা হবে: ২৪ আমার স্বপ্ন দেখার অনেক বড় আকাশ।
এ প্রসঙ্গে বিএফ শাহীন কলেজের শিক্ষার্থী সঞ্চিতা স্নিগ্ধা বললেন, 'এই বছরটা আমাদের আকাশ অনেক বড় করে ফেলল। আমরা এখন বিশ্বাস করতে শিখেছি, অন্যায়ের বিচার হয়, আন্তরিক থাকলে চাওয়া পূরণ হয়।
'বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে মানুষে মানুষে বিভেদ ঘুচে গিয়েছে। আমরা এখন বড়দের সম্মান করতে পারছি। আমরা বুঝতে পারছি ট্রাফিক পুলিশকে বা একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মীকে কতটা স্ট্রাগল করতে হয়। এতে পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা বাড়ছে।'
স্নিগ্ধা জানালেন, কাছের এক দোকানদার চাচা কিছুক্ষণ আগে তাদেরকে মোড়া আর পানি দিয়ে গিয়েছেন। বলেছেন, 'বসে বসে আঁকো মা।'
এশা, উষা দুই বোন আইইউবিতে পড়ে। সকাল সাড়ে সাতটা থেকে গ্রাফিতি আঁকার দলে যোগ দিয়েছেন। আন্দোলনের আগের ও পরের দিনগুলো তাদের কাছে আলাদা। আগে ক্লাস করে, অ্যাসাইনমেন্ট করে, ভিডিও গেইমস খেলে তাদের দিন পার হতো। আন্দোলনে যোগ দেওয়ার পর তারা অনেক নতুন বন্ধু পেয়েছেন। আন্দোলন তাদের এমনভাবে বেঁধে দিয়েছে যে, মনে হচ্ছে বহুদিনের চেনা। বড় ভাইয়া ও আপুদের সঙ্গে মিলে তারা খাঁচা এঁকেছেন, লিখেছেন: কারার ঐ লৌহ কপাট, ভেঙে ফেল কররে লোপাট।
শহিদ মিনারের সামনে ৩ আগস্ট একটি ছবি তুলেছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আলিফ। তাতে দেখা যাচ্ছে, একটি ল্যাম্পপোস্টের শীর্ষে দাঁড়িয়ে দুজন আন্দোলনকারীর একজন বাংলাদেশের পতাকা, অন্যজন ফিলিস্তিনের পতাকা ওড়াচ্ছেন। নিচে শত সহস্র মানুষ।
আলিফ বললেন, 'অবাক করা বিষয় হলো, ১৮ জুলাই ফিলিস্তিনের এক মুক্তিকামী জনতার হাতে একটি প্ল্যাকার্ড দেখা গেছে যাতে লেখা, বাংলাদেশ নিডস হেল্প। আমরা মুক্তি পেয়েছি, কিন্তু ফিলিস্তিন আজও [মুক্তির] প্রহর গুনছে। এই গ্রাফিতিটি দিয়ে আমরা তাদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষার প্রতিও শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।'
ইউনাইটেড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী প্রান্ত শাহরিয়ার বিশাল একটি বিশেষ রকমের গ্রাফিতি তৈরি করেছেন। বাংলাদেশের মানচিত্রের দুদিক থেকে দুটি শক্তি নিজেদের দিকে টানছে। এর একটি শুভশক্তি, অন্যটি অশুভ শক্তি।
বিশাল বললেন, 'গল্পগাথায় শোনা কালো রাক্ষুসে হাত দিয়ে অশুভ শক্তি বোঝানো হচ্ছে আর শুভ শক্তি বোঝানো হচ্ছে মুক্তিকামী জনতাকে দিয়ে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে অশুভ শক্তির হাত থেকে দেশ মুক্তি পেয়েছে, শুভ শক্তি বিজয়ী হয়েছে, গ্রাফিতিতে আমরা তা-ই ফুটিয়ে তুলছি।'
বিশালের গ্রাফিতি টিমের একজন সদস্য নওরীন জাহান। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'আন্দোলন আপনাকে কী উপহার দিল?' তিনি বললেন, 'সাহস। এটা আমার আগামী সব দিনের সঞ্চয়। আগে বন্ধুদের সঙ্গে দলবেঁধে বের হতাম, এবার দেখলাম ময়দানে এসেও দলবাঁধা যায়, ঘর থেকে দলবলে আসতে হয় না।'
মিরপুর ১০ নম্বরে মেট্রোরেল স্টেশন ও তার আশপাশে ছোটবড় মিলিয়ে ২০-২৫টি গ্রাফিতি আঁকা চলছে। এগুলোর মধ্যে যে-সব প্রতীক ও দৃশ্য বেশি গুরুত্ব পেয়েছে সেগুলো হলো শক্তি ও প্রতিবাদের প্রতীকে মুষ্টিবদ্ধ হাত, উদীয়মান সূর্য, আনন্দের প্রতীক হিসেবে ফুলের পাপড়ি, বুক পেতে দেওয়া আবু সাঈদ, মানচিত্র, পতাকা, সমবেত হাত, অগণিত জনতা ইত্যাদি।
মেট্রো স্টেশনের প্রবেশমুখের দেয়ালের গ্রাফিতিতে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ ফুঁড়ে নতুন সূর্য উঠছে। পাশে লেখা, দেশটির গন্তব্যস্থল: মুক্তি। আঁকিয়ে দলের সদস্য সাকিরা বললেন, 'এখান থেকে যে যেদিকে যাক, মুক্তিই হবে তাদের গন্তব্য।'
সাকিরা আরও বললেন, 'বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা অনেক ভেদাভেদ ঘোচাতে পেরেছি। দেয়াল ছিল মাদ্রাসার ছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের মধ্যে, প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে, সমতল ও পাহাড়ের মধ্যে — এ আন্দোলন আমাদের একই মঞ্চে দাঁড় করিয়েছে। আমরা হাতে হাত রেখে এগিয়ে চলার সুযোগ পেয়েছি।'
গ্রাফিতির ছবিগুলো রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে তুলেছেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর আলোকচিত্রী সৈয়দ জাকির হোসেন।