রোদের ঘ্রাণ আর বাতাসের রঙ
চায়নিজ
সত্তরের দশকে সেবা প্রকাশনী থেকে যেসব রহস্য-রোমাঞ্চোপন্যাস বের হতো তার কয়েকটাতে দেখেছি নায়ক (মাসুদরানাসহ) সন্ধ্যেবেলা সময় কাটানো আর গলা ভেজানোর জন্য রাজধানীর অভিজাত এলাকা মগবাজারের বারে ঢুকছেন। মগবাজার কবে অভিজাত এলাকার তালিকায় ছিল সেটা আমি দেখিনি, তবে তার পশ্চিম দিকের পাড়ার আভিজাত্যের শেষ সময়গুলো দেখেছি। মগবাজারের বাজারীবার 'পিয়াসী' এখনো টিকে থাকলেও ইস্কাটনের পিপাসাবার টেকেনি।কেন টেকেনি জানি না। আইসক্রীম বা ফাস্টফুডের দোকানগুলো ব্যবসায় লোকসান দিয়ে একসময় উঠে যায় কিন্তু বারগুলো সাধারণত উঠে যায়না। যেমন, 'শ্যালেবার' গ্রীনরোড থেকে হাতিরপুল হয়ে এখন বাংলামোটরে এসে ঠাঁই গেড়েছে।
শ্যালের তখনকার মালিককে নিয়ে নানারকমের মজার গল্প প্রচলিত ছিল যেগুলোর সত্যাসত্য কখনো জানতে পারিনি। যেমন, প্রবাদে বলা 'দুধ বিক্রি করে মদ কেনা আর মদ বিক্রি করে দুধ কেনা'কে ভুল প্রমাণ করে তিনি নাকি সকালে যে দোকানের সামনে দুধ বিক্রি করতেন সন্ধ্যায় সেই দোকানে নাকি মদ বিক্রি করতেন। তিনি প্রায়ই নানা পর্যায়ের নির্বাচনে দাঁড়িয়ে যেতেন, সাধারণত 'একতারা' মার্কা নিয়ে। টিএসসি থেকে শহীদ মিনারের দিকে যেতে এক দেয়ালে তার একটা আহ্বান লেখা ছিল—
হাঁস-মুরগী-ছাগল-গরু
পালন সবাই করো শুরু
শ্বেতবিপ্লব সফল করো
দেশ ও জাতি গঠন করো
এই কবিতা পড়ে আমার এক বন্ধু কী করে শ্বেতবিপ্লব সফল করা যেতে পারে তার রূপরেখা বলেছিলেন। বিষয়টা শ্লীলতার সীমা ছাড়িয়ে যায় বলে এখানে আর বললাম না। সেই আমলে মেয়েদের পত্রিকা সাপ্তাহিক 'বেগম'-এর ঈদসংখ্যায় শ্যালেবারের বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম। বিজ্ঞাপনে তাদের লোগোতে একটা বৃত্তের ভেতরে লেজছাড়া বাংলা তালব্য-শ অক্ষরটা ছিল।মেয়েদের পত্রিকার ঈদসংখ্যায় মদের দোকানের বিজ্ঞাপন বেশ আগ্রহোদ্দীপক বিষয় ছিল।আমি অবশ্য বাংলাদেশের আর কোন পত্রিকায় কখনো মদের দোকানের বিজ্ঞাপন দেখিনি।
পিপাসা বার না টিকলেও পিজা গার্ডেনের পাশের গলিতে একটা চার/পাঁচতলা বাড়ি জুড়ে থাকা পাড়ার বার 'গোল্ডেনড্রাগন' এখনো টিকে আছে। গোল্ডেন ড্রাগন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পাড়ার ছেলেপিলে আর তাদের বন্ধুদের 'হাতেখড়ি' দিয়ে যাচ্ছে।টিকে আছে দিলুরোডের মুখের 'ওয়াইনইম্পোরিয়াম' দোকানটাও, যেখানে লিকার (liquor) বিক্রি হলেও কোনদিন 'ওয়াইন' (wine) বিক্রি হয় বলে শুনিনি। এর সাইন বোর্ডের নিচে লেখা 'এফএলশপ'-এর মানে বুঝতে আমার বহু বছর লেগে গিয়েছিল। বিশেষ দিনগুলোর দুয়েকদিন আগে থেকে দেখা যেতো লোকজন খাকি রঙা কাগজের ঠোঙ্গায় কী যেন নিয়ে দোকান থেকে বের হচ্ছে।
গোল্ডেন ড্রাগনের গলির মুখে একটা মজার দৃশ্য দেখা যায়। সেখানে শান্ত্রীদের মতো বেশকিছু রিকশা দুইপাশে দুই সারিতে দাঁড়িয়ে থাকে। আমার মতো সাধারণ কেউ রিকশাচালকদের কাউকে কোথাও যেতে অনুরোধ করলে তাঁরা সরাসরি না করে দেন। সম্ভাব্য যাত্রীকে এভাবে না করে দিয়ে দিনমান বসে থাকা রিকশার দল আমি পলাশীবাজারে আর রামপুরাবাজারে দেখেছি। নিশ্চয়ই ঢাকার অন্যত্রও এমন রিকশার দল মিলবে। গোল্ডেন ড্রাগনের সামনের ব্যাপারটা না হয় বোধগম্য—বেশি লাভের আশায় তাঁরা মাতাল যাত্রী ছাড়া অন্য কাউকে নিতে আগ্রহী নন্, কিন্তু পলাশী বাজার বা রামপুরা বাজারের 'স্থাণু' রিকশাচালকদের যুক্তিটা কী? কখনো জানতে পারিনি।
এক সময় এখনকার জনকণ্ঠ ভবনের উলটো দিকে সামনে অনেকটা খোলা জায়গা নিয়ে 'চপস্টিকস' নামের একটা চায়নিজ খাবারের দোকান ছিল। দোকানটার লোগোতে চপস্টিকস ছিল কিনা মনে নেই তবে বেশ রাজকীয় ভঙ্গীর একটা মোরগের ছবি ছিল। আমরা চায়নিজ খেতে পেতাম কালেভদ্রে। চায়নিজ খাওয়াটা খুব সাধারণ ব্যাপার ছিল না। পরিবারে বিশিষ্ট কোন অতিথির আগমন, কারো বিবাহ পরবর্তীকালে শ্যালিকাদের কর্তৃক নতুন দুলাভাইকে 'ছিল' মারা পর্ব ইত্যাদি না হলে চায়নিজ খাওয়া কপালে জুটতো না। সেখাবার খাওয়ার জন্য সবাই বেশ সেজেগুজে, গায়ে 'জেসমিন' বা 'ইন্টিমেট' সেন্ট মেখে যেতেন। খাবার চায়নিজ হলেও কেন যেন সবাই সেখানে ফুটফাট ইংলিশে কথা বলার চেষ্টা করতেন। ইংলিশ গ্রামার ভুল হবার ভয়ে আমার মতো বেশিরভাগ জন চুপ করে থাকতেন। চপস্টিকসের খাবার আমাদের ভালোই লাগতো, তবে দাম বেশি বলে মনে হতো। আরেকটু সামনে এগিয়ে গেলে হাতের ডানদিকে 'মিকাডো' আর প্রায় মগবাজার মোড়ের কাছে 'টাইকিং' নামের আরেকটা চায়নিজ রেস্টুরেন্ট ছিল। এরমধ্যে টাইকিং-এর খাবারের দাম কম আর মান নিম্ন ছিল।
হোঁচট খাবার মতো ভূতুড়ে নীলচে আলো-অন্ধকারের চায়নিজ রেস্টুরেন্টগুলোতে ব্যাকগ্রাউন্ডে আগে কী গান বাজতো ঠিক মনে নেই তবে আশির দশকের মধ্যভাগ থেকে আজতক জার্মান ব্যান্ড 'মডার্ন টকিং' ঢাকার চায়নিজ রেস্টুরেন্টগুলোতে দোর্দণ্ড প্রতাপে রাজত্ব করে যাচ্ছে। গত পঁচিশ বছর ধরে সারা দুনিয়ার মানুষ মডার্নটকিং-এর গান বিশেষ না শুনলেও ঢাকার চায়নিজ রেস্টুরেন্টগুলো একে অপরিবর্তনীয় আবহসঙ্গীত হিসেবে অলিখিত স্বীকৃতি দিয়ে আসছে। অভিজাত চপস্টিকস হোক বামধ্যবিত্তের মিকাডো, অথবা হাভাতে টাইকিং যে কোনটাতে সুড়ুৎসুড়ুৎ করে কুঁচো চিংড়ির গন্ধ মাখা থাইস্যুপ আর ওন্টন খেতে খেতে আমরা শুনতাম 'জেরোনিমোজ ক্যাডিলাক' অথবা 'ইউ'য়ার মাই হার্ট, ইউ'য়ার মাই সোল', কষ্টে ধরা ছুরি কাঁটা চামচ দিয়ে ফ্রায়েড রাইস আর ফ্রায়েড চিকেনকে কায়দা করতে করতে শুনতাম 'শেরি, শেরিলেডি', খাবারের শেষপ্রান্তে কাচের বোতলে স্ট্র লাগিয়ে ঝাঁজালো কোকাকোলায় চুমুক দিয়ে মাথা দুলিয়ে আমরাও অমন গলা চিপিয়ে গাইতাম—
"You're no good can't you see
Brother Louie Louie Louie
I'm in love set her free
Oh she's only lookin' to me
Only love breaks her heart
Brother Louie Louie Louie
Only love's paradise
Oh she's only lookin' to me"
২২ফেব্রুয়ারী, ২০২০