আস্থা ফেরানো, সুশাসন নিশ্চিতে জোর দেবে বিএসইসি
বিগত সময়ে পুঁজিবাজারে যেসব অনিয়ম হয়েছে, সেগুলো নিয়ে গভীর পর্যালোচনা করা হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নতুন চেয়্যারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ।
কেন সেটি করা হবে, সে বিষয়ের ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, "কোনো ছোট অনিয়মকে শুরুতে বন্ধ না করলে সেটি বাড়তে বাড়তে মহীরুহ হয়ে যায়। বর্তমানে অনেক কিছুতেই মহীরুহ অবস্থায় রয়েছি।"
"কেন সেই অনিয়ম বা মহীরুহ অবস্থা ঘটলো, সেটি নিয়ে কাজ করবো। অনেক রেগুলেশন আছে, কিন্তু কোনো লুপহোলসের (ত্রুটি) কারণে অনিয়ম হলে, সেটি খতিয়ে দেখে বন্ধ করা হবে, যেন এর আর পুনরাবৃত্তি না হয়,"— পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্ব নেওয়ার পর চতুর্থ কার্যদিবস গতকাল রোববার (২৫ আগস্ট) আগারগাঁওয়ে কমিশন ভবনে নিজের পরিকল্পনা তুলে ধরে গণমাধ্যমকে কথাগুলো বলছিলেন ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘদিন কাজ করা রাশেদ মাকসুদ।
এ সময় বিগত এক দশকে পুঁজিবাজারের নষ্ট হওয়া আস্থা ফেরানো ও সুশাসন নিশ্চিতে জোর দিয়ে স্বল্প ও মধ্য মেয়াদী পরিকল্পনাও তুলে ধরেন তিনি।
মার্কেটে 'সুশাসন বা গর্ভন্যান্স ও এনফোর্সমেন্ট বাড়ানো'কে প্রথম কাজ আখ্যা দিয়েছে তিনি বলেন, "গত কয়েক বছরে আস্তে আস্তে সুশাসন থেকে আমরা অনেক দূরে চলে গিয়েছি। সেই জায়গায় আসতে অনেক সময় লাগবে। আবার সেই জায়গায় ফিরতে পারবো না কি–না সেটিও দেখতে হবে।"
তবে পুঁজিবাজারের স্টেকহোল্ডাররা মিলে একত্রে কাজ করলে সুশাসন ও আস্থা ফেরানো সম্ভব হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
সবাইকে নিয়ম মেনে কাজ করতে হবে কাজ করার আহ্বান জানান নতুন চেয়ারম্যান। "তবে আস্থা তৈরি করতে গিয়ে আগে পাম্পিং বা আর্টিফিসিয়ালভাবে কিছু করা হবে না। ফান্ডামেন্টাল বেইজের ওপর ভিত্তি করে আস্থা ফেরানো হবে," বলেন তিনি।
নতুন কমিশনের কর্মপরিকল্পনা
নতুন কমিশনের কর্মপরিকল্পনাকে দুইভাগে ভাগ করে আগামী দিনে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে কমিশন।
মূলত, রেগুলেটর হিসাবে বিএসইসি কোর অপারেশন ও নন-কোর অপারেশনে কাজ করবে।
কোর অপারেশনে তিনটি বিষয়কে মুখ্য হিসাবে চিহ্নিত করেছে রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন কমিশন। যার সঙ্গে রয়েছেন দুই জন কমিশনার এটিএম তারিকুজ্জামান এবং মো. মহসিন চৌধুরী। পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিশনে এখনও দুটি পদ শূন্য রয়েছে।
নতুন চেয়্যারম্যানের কর্মপরিকল্পনার প্রথমটি হচ্ছে— ট্রান্সপারেন্সি বা স্বচ্ছতা। এটি মূলত, কমিশনের অভ্যন্তরীণ স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনা। বাজারে ম্যানুপুলেশন বা কারসাজি থেকে শুরু করে সবকিছু এখানে অন্তর্ভুক্ত থাকবে। কমিশনের কর্মকর্তারাও কোনো অনিয়মে জড়ালে, সেটি খতিয়ে দেখা হবে।
কমিশনের দ্বিতীয় কর্মপরিকল্পনা হচ্ছে— গভর্ন্যান্স না সুশাসন প্রতিষ্ঠা। আর এটি প্রতিষ্ঠায় তিন ধাপ মেনে চলবে কমিশন। এরমধ্যে প্রথমটি হলো– কমিশনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে, প্রত্যেকটি বিভাগের নিজ নিজ কাজ; দ্বিতীয়টি হলো– বাজারের অংশীজন ব্রোকার, ডিলার, মার্চেন্ট ব্যাংক ও অন্যান্যদের সুশাসন এবং তৃতীয়টি হলো– তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে সুশাসন নিশ্চিত করা।
তৃতীয় পরকল্পনা হচ্ছে— মার্কেট উন্নয়ন। রাশেদ মাকসুদ বলেন, "পাশ্ববর্তী দেশ এক সময় অনেক পেছনে ছিল। কিন্তু পুঁজিবাজারে এখন অনেক এগিয়ে গেছে। আমরা মধ্যমেয়াদে ইনটেনসিভ কাজ করবো।"
তিনি আরও বলেন, "পুঁজিবাজার নিয়ে তৈরি হওয়া রেগুলেশনগুলো অনেক ভালো, কিন্তু এনফোর্সমেন্ট হয়নি। আমরা আইনের যথাযথ এনফোর্সমেন্টে গুরুত্ব দেব।"
স্বতন্ত্র পরিচালকদের পুরস্কার
তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে স্বতন্ত্র পরিচালকরা নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও বিনিয়োগকারীর ওয়াচডগ। তারা নিরপেক্ষতা বজায় রেখে বিনিয়োগকারীর স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে। এই নিরপেক্ষ পরিচালকদের জন্য রিওয়ার্ড বা সার্টিফিকেশন বা পুরস্কারের ব্যবস্থা চালু করার ওপরেও জোর দিয়েছেন রাশেদ মাকসুদ।
তিনি বলেন, "তালিকাভুক্ত কোম্পানির সুশাসন প্রতিষ্ঠায় শক্তভাবে কাজ করবো, ইতোমধ্যে আমরা কাজ শুরু করেছি। তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ টুলস হচ্ছে স্বতন্ত্র পরিচালক। তাদেরকে নিয়ে বড় কাজ করবো।"
"যারা বিভিন্ন কোম্পানিতে স্বতন্ত্র পরিচালক আছেন, তারা কোম্পানির সাথে অ্যাফিলিয়েটেড (সংযুক্ত) কিনা, সেটি দেখা হবে। কোম্পানির সাথে লিংকড কোনো ব্যক্তি স্বতন্ত্র হতে পারে না। কিছু কিছু কোম্পানিতে ভালো স্বতন্ত্র পরিচালক আছে, আবার কিছু কিছু কোম্পানির খারাপ অবস্থায় রয়েছে।"
"…স্বতন্ত্র পরিচালকদের নলেজ গ্যাপ কীভবে দূর করা যায়, তাদের নিয়ে কাজ করা হবে। স্বতন্ত্র পরিচালকদের পুরস্কৃত করার বিষয়ও থাকতে হবে। সার্টিফিকেশন বা রিওয়ার্ড দেওয়া হবে। তারা কেন শুধুমাত্র বোর্ড মিটিং ফি'র বিপরীতে জনগণের বা কমিশনের ওয়াচডগ হিসাবে কাজ করবেন?"
"যেহেতু তারা দায়িত্ব পালন করবেন, সেটার রিওয়ার্ডও দিতে হবে। সেই রিওয়ার্ডের একটি মডেলে যেতে হবে," উল্লেখ করেন তিনি।
এটিএম তারিকুজ্জামান বলেন, "আগের পরিস্থিতি আর এখনকার পরিস্থিতি এক নয়। কমিশনের আর একক সিদ্ধান্ত হবে না। বাজারে কোনো বৈষম্য থাকবে না। আইন সবার জন্য সমান। প্রয়োগের ক্ষেত্রেও কোনো বৈষম্য হবে না।।"
তিনি বলেন, "দুর্নীতি চলবে না। অনিয়ম চলবে না। যে সমস্ত রুলস ও রেগুলেশন রয়েছে, তার রিভিউ করবো। যেন মার্কেট ফ্রেন্ডলি হয়। সর্বোপরি, বাজার উন্নয়ন ও আস্থা ফেরাতে কাজ করবে এই কমিশন।"
বিগত সময়ের অনিয়ম রিভিউ করতে, কমিটি কখন করা হবে— এমন প্রশ্নের জবাবে রাশেদ মাকসুদ বলেন, "মাত্র কাজ শুরু করেছি। দুই-তিনদিনের মধ্যেই কমিটি করে ফেলবো, সেটি বলা যাচ্ছে না, তবে শিগগিরিই করা হবে। ইতোমধ্যে কমিশনের কর্মকর্তাদের দায়িত্বে রি-শাফল (পুনর্বিন্যাস) করা হয়েছে।"