বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২৭, এখনও বিপৎসীমার উপরে গোমতীর পানি
দেশে চলমান ভয়াবহ বন্যায় মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত (২৭ আগস্ট) মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২৭ জনে দাঁড়িয়েছে বলে জানা গেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে।
বন্যায় দেশের ১১ জেলার ৭৪টি উপজেলায় ১২ লাখেরও বেশি পরিবার বর্তমানে পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়া সত্ত্বেও কুমিল্লার গোমতী নদীর পানি এখনও বিপৎসীমার ওপরে রয়েছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের (এফএফডব্লিউসি) তথ্য অনুযায়ী, কুমিল্লা পয়েন্টে গোমতী নদীর পানি গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত বিপৎসীমার ৩৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এদিকে, কুশিয়ারা ও মুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে নেমে গেলেও খুব ধীরগতিতে কমছে পানি।
এফএফডব্লিউসির নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান টিবিএসকে বলেন, "কুমিল্লার পানি আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মোটামুটি নেমে যাবে। আগামী কয়েকদিনে দেশের কোথাও নতুন করে বন্যার সম্ভাবনা নেই। গত ২৪ ঘণ্টায় নদীগুলোর পানি কমার হার বিগত দিনগুলোর চেয়ে বেশি ছিল। বন্যা পরিস্থিতি আগামী ২ দিনের মধ্যে অনেকটাই উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।"
আক্রান্ত ৫৭ লাখ মানুষ
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজারে বন্যায় ৫৭ লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
৫৪৫টি পৌরসভা বা ইউনিয়নে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ১২ লাখ ৩৮ হাজার ৪৮টি।
এরই মধ্যে ৩ হাজার ৮৩৪টি আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন ৪ লাখ ৬৯ হাজার ৫২৩ জন। এছাড়াও ২৮ হাজার ৯০৭টি গৃহপালিত পশু রাখা হয়েছে।
বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা বরাদ্দ, ২০ হাজার ৬৫০ টন চাল, ১৫ হাজার শুকনো খাবার বা অন্যান্য খাবারের প্যাকেট এবং শিশু খাদ্য ও পশুর খাদ্যে ৩৫ লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
বন্যাকবলিত এলাকায় মোট ৬৪৫টি মেডিকেল টিম চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে।
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ফেনী জেলায় মোবাইল ও টেলিযোগাযোগ সেবা পুনরায় চালু করা হয়েছে। এছাড়াও ফিল্ড হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ মানুষের দেওয়া ত্রাণসামগ্রী বিতরণ চলছে।
জেলা প্রশাসকদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, মেডিকেল টিম ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ৩ নং স্থানীয় সতর্ক সংকেত জারি
সোমবার বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরের জন্য ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত জারি করে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর এবং বাংলাদেশের তৎসংলগ্ন দক্ষিণাঞ্চলের নিম্নচাপটি ঘনীভূত হয়ে একটি সু-চিহ্নিত নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে এবং বর্তমানে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ ও নিকটবর্তী এলাকায় অবস্থান করছে। এর প্রভাবে, উত্তর বঙ্গোপসাগরে গভীর পরিচলন ঘটছে, যার ফলে সমুদ্র বন্দরসমূহ, উত্তর বঙ্গোপসাগর এবং বাংলাদেশের তৎসংলগ্ন উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে দমকা বা ঝড়ো হাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সমস্ত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।
গতকাল সন্ধ্যায় প্রকাশিত বিএমডি বুলেটিনে আরও বলা হয়— ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অনেক জায়গায় এবং রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ী দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া, দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি থেকে ভারি বর্ষণ হতে পারে।
খুলনায় প্লাবিত গ্রাম, মাছের ঘের, ফসলের মাঠ
গত ২২ আগস্ট খুলনার পাইকগাছা উপজেলায় উপকূল রক্ষার বেড়িবাঁধ ভেঙে ১৩টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। অন্তত ১৫,০০০ মানুষ এতে আক্রান্ত হন। এতে জেলার দাকোপ ও পাইকগাছা উপজেলায় প্রবল জোয়ারে বেশ কিছু গ্রাম, মাছের ঘের ও ফসলের ক্ষেত প্লাবিত হয়।
দাকোপ উপজেলার পানিখালী বাঁধ ভেঙে মাছের খামার ও গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। একইভাবে পাইকগাছার দিলুহাটী ইউনিয়নেও ওয়াপদা বেড়িবাঁধ ভেঙে আবাসিক এলাকায় পানি ঢুকেছে।
স্থানীয়রা জানান, বৃহস্পতিবার দুপুর ১টার দিকে দিলুহাটী ইউনিয়নের কালিনগরের ২২ নম্বর পোল্ডারের দক্ষিণ প্রান্তে ওয়াপদা বেড়িবাঁধ জোয়ারের সময় ভেঙে পড়ে।
৩০০ ফুটেরও বেশি বিস্তৃত এ ভাঙনে কালিনগর, হরিণখোলা ও দারুণমল্লিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সম্প্রতি রোপণ করা ধান ও বীজতলাসহ ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে।
প্লাবিত গ্রামগুলো হলো— কালি নগর, গোপী পাগলা, তেলিখালী, সৈয়দখালী, খেজুরতলা, সেনের বেড়, হাটবাড়ি, ফুলবাড়ি, বাগীরদানা, দুর্গাপুর, দারুল মল্লিক, হাবিখোলা ও নোয়াই।
এসব গ্রামের বাসিন্দারা উঁচু জায়গা, স্কুল ও আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে।
পাইকগাছার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজনীন বেগম জানান, "প্রায় দুই হাজার মানুষ স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন; তাদেরকে পর্যাপ্ত পরিমাণে ত্রাণসামগ্রী সরবরাহ করা হয়েছে।"
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা অসীম কুমার দাস জানান, "আকস্মিক বন্যায় মোট ৯৫০ হেক্টর আমন ধান, ২২৫ হেক্টর আমন ধানের বীজতলা এবং ২৫ হেক্টর জমির সবজি ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে।"
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) খুলনা পওর-২ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, "বাঁধ ভাঙ্গার খবর পেয়ে সেখানে ভেকু পাঠানো হয়েছে। এখন ভরা জোয়ারের কারণে কাজ করা যাচ্ছে না। ভাটা শুরু হলে সেখানে রিং বাঁধ দিয়ে জোয়ার মোকাবেলার চেষ্টা করা হবে।"
বাংলাদেশের বন্যা দুর্গতদের সহায়তায় ৩৩,০০০ পাউন্ড দিচ্ছে যুক্তরাজ্য
ফেনী, খাগড়াছড়ি ও নোয়াখালীতে ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় বাংলাদেশের জন্য ৩৩,০০০ পাউন্ড তাৎক্ষণিক মানবিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাজ্য।
ব্রিটিশ হাইকমিশনের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে— এই সাহায্য অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযান, খাদ্য, নগদ অর্থ স্থানান্তর, বিশুদ্ধ পানি, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত কাজে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।