উদ্ধার থেকে মুক্তি: এক আহত মেছো বাঘের ফিরে যাওয়া
আনুমানিক রাত সাড়ে ৯টার দিকে খবর পাই মোটরসাইকেলের ধাক্কায় একটি মেছো বাঘ আহত হয়েছে। দর্শনা থানার অধীনে চাঁদপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। কুষ্টিয়া জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে এ ধরণের ঘটনা প্রায়শই ঘটে।
সৌভাগ্যক্রমে, এ এলাকায় কিছু বিজ্ঞানী, বন্যপ্রাণী প্রেমী ও প্রকৃতি প্রেমীদের এক বিশাল নেটওয়ার্ক আছে। তারা এ ধরণের পরিস্থিতি সামাল দিতে সবসময় প্রস্তুত থাকে।
দুর্ঘটনার খবর খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে। এক ঘণ্টার মধ্যেই শাহিন, ঝন্টু ও মামুনের নেতৃত্বে একদল যুবক ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়। তখন বাজে রাত সাড়ে ১০টা। আহত বিড়ালটিকে নিজেদের তত্ত্বাবধানে নিয়ে গন্তব্যে রওনা দেয় তারা।
মেছো বাঘ বা মেছো বিড়াল হচ্ছে ছোট প্রজাতির বন্য বিড়াল। এরা পানি খুব ভালোবাসে। এ ধরনের বন্য বিড়ালগুলোর মধ্যে পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত দুটি প্রজাতি বেঁচে আছে। এটি তাদের মধ্যে একটি। এরা উভয়চর প্রাণীর মতো জীবনযাপনে অভ্যস্ত। সাধারণত গঙ্গা নদীর দক্ষিণ থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত জলাভূমিতে এদের দেখা বেশি পাওয়া যায়। তবে গঙ্গা নদীর নিচে বদ্বীপের এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল তাদের বাসস্থান নয় বলে তাদের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। কারণ এ অঞ্চল তাদের বাসস্থান হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নয়। যার কারণে বন্য বিড়াল সংরক্ষণে এখানে সুযোগ সুবিধার অভাব রয়েছে।
বিড়ালটি আহত হওয়ায় আমাদের জন্য এটি একটি চ্যালেঞ্জ ছিল। বড় শালুয়া কলেজের শিক্ষক আহসান হাবিব শিপলু এবং পশুচিকিৎসক মান্নান হোসেন সেদিন রাতেই বাঘটির চিকিৎসা শুরু করেন।
পরের দিন, শাহিন ও ঝন্টু আহত বিড়ালটিকে আরো ভালো চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য বন বিভাগের কাছে হস্তান্তর করেন। পরে বন বিভাগ বিড়ালটির যত্ন ও চিকিৎসার দায়িত্ব আমার ওপর দেন। শাহিন, ঝন্টু এবং আমি এরপর তাকে নিয়ে উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে নিয়ে যাই। সেখানে প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ডা. শাওন হাসানাত বিড়ালটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে দেখেন এবং প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র লিখে দেন।
এ মেছো বিড়ালটির মাথায় গুরুতর আঘাত লেগেছিল এবং তার চোখ, মুখ এবং নাক থেকে ক্রমাগত রক্ত পড়ছিল। তার ডান চোখ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং একটি দাঁতও ভেঙ্গে গিয়েছিল। এছাড়া তার মুখের ভেতরে একাধিক জায়গা কেটে গিয়েছিল। প্রাণীটি শারীরিকভাবে খুব দুর্বল হয়ে পড়ছিল। মাথার আঘাতের ফলে স্নায়বিক জটিলতার আশঙ্কা ছিল, যদিও পরে সেই আশঙ্কা কেটে যায়।
বন বিভাগের অনুমতিতে, প্রাণীটিকে আমরা আমাদের পরিবেশবাদী স্বেচ্ছাসেবী ক্লাব 'পানকৌরি'তে নিয়ে আসি। আমরা সেখানে প্রাণীটির পুনর্বাসনকালীন চিকিৎসা শুরু করি।
ক্ষত দ্রুত নিরাময়ের জন্য পেনিসিলিন জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিকগুলোর পাশাপাশি ব্যথানাশক ওষুধও দিচ্ছিলাম। স্নায়বিক সমস্যা প্রতিরোধের জন্য 'নিউরো বি' দেওয়া হয়েছিল এবং চোখের ক্ষতের জন্য চোখের ড্রপ ব্যবহার করা হয়েছিল।
প্রথম কয়েকদিন ধরে বিড়ালটি শুধু স্যালাইনের পানি খেয়েছিল এবং অন্য কিছু খাচ্ছিলনা। সিরিঞ্জের মাধ্যমে সিদ্ধা মাছের স্যুপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু ফলাফল আশানুরূপ ছিল না। চার থেকে পাঁচ দিন পর এক রাত থেকে সে অল্প পরিমাণ সিদ্ধ মাছ খেতে শুরু করে।
কয়েক দিনের চিকিৎসার পর, সে শারীরিকভাবে সুস্থ হয়ে উঠলেও গুরুতর আঘাতের কারণে তার ডান চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলে। চোখের ড্রপ দেওয়া অব্যাহত থাকলেও চোখটি সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কম ছিল। তবে অন্য চোখে সে ভালো দেখতে পাচ্ছিল।
তাছাড়া আক্রান্ত চোখে সংক্রমণ রোধে ও সুস্থ চোখকে সুরক্ষিত রাখতে তার চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া হয়। এদিকে দাঁত ও মুখের আঘাতগুলো ধীরে ধীরে সেরে উঠছিল।
এ পর্যায়ে আমাদের প্রধান উদ্বেগ ছিল সে শারীরিকভাবে সুস্থ এবং ওষুধ সম্পন্ন করলেও সে আবার বনে ফিরে যেতে পারবে কি-না।
চিকিৎসার ১০দিন পর মোছো বাঘটি আবার আগের মতো খেতে শুরু করে। সে খাঁচা থেকে পালানোর চেষ্টা করতে থাকে। আমরা কাছে এলে আমাদের ভয় দেখানোর জন্য আওয়াজও করতো। আমি মাঝে মাঝে তার দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষা করার চেষ্টা করতাম। তাতে ইতিবাচক সারাও পেয়েছি। তারপরও আমি তাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম।
আমি এই বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুনতাসির আকাশের সঙ্গে আলোচনা করি। তিনি আমাকে জানান, অনেক প্রাণীই এক চোখ নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে। তিনি প্রাণীটিকে দ্রুত ছেড়ে আসার পরামর্শ দেন। কারণ এভাবে থাকলে সে বন্দী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যেতে পারে।
২০ জুলাই আমরা দুর্ঘটনাস্থলের কাছে বিড়ালটিকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। এসময় আমাদের সঙ্গে পানকৌরির সদস্য রিমেল, ইমরান, রাইহান, সিপুল এবং সোহাগ ছিলেন। দুর্ঘটনার সময় বিড়ালটি এক বাগান থেকে বের হয়ে রাস্তা পার হচ্ছিল। আমরা সে বাগানেই তাকে নিয়ে গেলাম। সেখানেই বিড়ালের খাঁচাটি অন্ধকারে কিছুক্ষণ রেখে দিলাম এবং তাকে খাঁচার ভিতরে ঘোরাফেরা করতে দেখলাম। যেসব প্রাণী নিশাচর তাদের রাতের বেলা ছেড়ে দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। তাই যখন আমরা বুঝতে পারলাম সে বাইরে আসার জন্য প্রস্তুত তখনই আমরা খাঁচার দরজা খুলে দিলাম।
প্রথমে, প্রাণীটি একটু ইতস্তত করলেও পরে দ্রুত বেরিয়ে যায়। ছেড়ে দেওয়ার পর আমরা ১০ মিনিট চুপচাপ অপেক্ষা করি এবং নিশ্চিত হওয়ার জন্য ২০০ গজের মধ্যে এর খোঁজ করি। পরে বুঝতে পারি, এটি তার আবাসস্থলে ফিরে গেছে। পরদিন সকালে আমরা আবার বিষয়টি পরীক্ষা করতে আসি যে সে ঠিক আছে কিনা। দেখলাম বিড়ালটি কাছাকাছি কোথাও লুকিয়ে নেই।
আমি স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক সোহাগকে পরবর্তী তিন দিন এলাকাটি পর্যবেক্ষণ করতে অনুরোধ করি। তিনি জানান যে, প্রাণীটি আর কোনো সমস্যায় পড়েনি।
তবে, মেছো বিড়ালগুলোকে প্রায়ই রাতে সেখানে দেখা যেত। এর মাধ্যমে বুঝতে পারি আহত বিড়ালটি ওই এলাকারই বাসিন্দা ছিল। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা সফলভাবে বাঘটিকে বনে ফিরিয়ে দিতে পেরেছি।
তবে এটি মোটেও সহজ কাজ ছিল না। নিয়মিত ওষুধ, ইনজেকশন, চোখের ড্রপ এবং খাবার দেওয়ার মাধ্যমে সে সবসময় নিবিড় পর্যবেক্ষণের মধ্যে ছিল। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল বিড়ালটির আদি আবাসস্থলে পুনর্বাসন নিশ্চিত করা।
প্রায় সময় এ বিড়ালগুলোকে দুর্ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে তাদের অন্য স্থানে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরিচিত এলাকা থেকে অন্য স্থানে সরিয়ে ফেলায় তাদের পুনর্বাসন সংক্রান্ত সমস্যা আরও বাড়িয়ে দেয়। কখনও কখনও উদ্ধারের নামে তাদের বিভিন্ন জায়গায় বদ্ধ জীবন কাটিয়ে দিতে হয়।
মেছো বাঘ সংরক্ষণে চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর এবং কুষ্টিয়া জেলাগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করা অত্যন্ত জরুরি।