হান্স: একটি ঘোড়ার নাম
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, শিশুদের উপযোগী সমস্ত বই এবং গল্পের এক তৃতীয়াংশই হয় পশুপাখি সম্পর্কে অথবা পশুপাখিকে প্রধান চরিত্র করে লেখা। বিপুল পরিমাণ রচনায় পশুপাখিকে মানবীয় চিন্তাধারা এবং অনুভূতির অধিকরী বলে দেখানো হয়। প্রায়শই এরা কথা বলতে পারে। বাচ্চাদের বইয়ের তাকে নজর বোলানো কারও কাছে এই বিষয়টি স্পষ্ট কিন্তু আবার কৌতূহলোদ্দীপক বটে। হাজার হোক, শিশুদের জন্যে লিখতে গিয়ে বড়রা কেন ভাববেন ওদের পাঠকরা নিজেদের মানুষের চেয়ে বরং পশুপাখি চরিত্রের সাথে অনেক সহজে একাত্ম বোধ করবে? তাছাড়া, শিশুদের পশুপাখি কথা বলতে পারে ভাবতে প্ররোচিত করার পেছনে কি কারণ থাকতে পারে, যেখানে শেষপর্যন্ত ওরা জানবে যে সেটা সম্ভব নয়? অন্তত মানুষের মতো কথা বলার নিরীখে নয়।
ভাবতে গেলে ব্যাপারট বেশ অদ্ভুত ঠেকে। মানুষ আর পশুপাখির পরস্পরের সাথে কথাবার্তা চালানোর এই ধারণা নিঃসন্দেহে অদ্ভুত হলেও মোটেই আধুনিক পাশ্চাত্য উদ্ভাবন নয়। এটা খোদ সাহিত্যের চেয়েও ঢের বেশি ব্যাপক এবং প্রাচীন। পৃথিবী জুড়ে আদিবাসী সৃষ্টি কাহিনীতে মানুষ অস্ট্রেলিয় আদিবাসীদের 'স্বপ্ন সময়ে'র মতো এমন একটা সময়ের কথা বলে যখন দেবদেবী, পশুপাখি এবং মানুষ একসাথে বাস করতো, সাধারণ ভাষায় যোগাযোগ করতো। এমনকি সৃষ্টির বাইবেলীয় বিবরণও আদম-ইভ এবং স্বর্গোদ্যানের অ-মানবীয় বাসিন্দাদের সম্প্রীতির সহাবস্থানের একটা অবস্থার কথা বোঝায়। এবং আমাদের বলা হয়েছে, নোয়া অনুসন্ধানী কাজে পাঠানোর জন্যে অনায়াসে দাঁড়কাক এবং ঘুঘুর সাথে কথা বলতে পারতেন।
সত্যি বলতে, ইউরোপে মধ্যযুগের দিকে পশুপাখির সাথে যোগাযোগের ক্ষমতাকে পবিত্র পুরুষের নিশ্চিত লক্ষণ ভাবা হতো। বিভিন্ন কিংবদন্তী মোতাবেক আদি ক্রিশ্চান সাধুদের অনেকেই পাখি এবং জন্তুজানোয়ারের সাথে বিশেষ সম্পর্কের অধিকারী ছিলেন। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, সেইন্ট ফ্রান্সিস অভ আসিসি পুলকিত পাখির ঝাঁকের উদ্দেশ্যে বয়ান করতেন, নেকড়ে বাঘ পোষ মানাতে পারতেন, নাইটিঙ্গেল পাখির সাথে দ্বৈত গান গাইতেন এবং চড়াই পাখি কিংবা ব্যাঙের ডাক থামাতে পারতেন। বৈজ্ঞানিক বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গির আধুনিককালে এই ধরনের গল্পকাহিনী উদ্ভট, রপকথার মতো লাগতে পারে। তবু, বিচিত্র কারণে পশুপাখির সাথে মানুষের কথা বলার ধারণা আগের যেকোনও সময়ে চেয়ে বিস্তার লাভ করে চলেছে।
চালাক হান্স নামে একটা ঘোড়ার মাধ্যমে এই জাতীয় ঘটনায় সাম্প্রতিক আগ্রহের সূচনা ঘটে। হান্স ছিল উনিশ শতকের গোড়ার দিকে জার্মানিতে ভিলহেম ফন অস্টেন নামে একজন অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষকের ঘোড়া। দৃঢ়ভাবে নিজের ঘোড়াকে ব্যতিক্রমীভাবে বুদ্ধিমান বলে বিশ্বাস করতেন ভিলহেম ফন অস্টেন। বাচ্চাদের মতো একই কৌশলে লাগিয়ে ওটাকে সহজ অঙ্কের সমস্যা সমাধান শেখানোর সিদ্ধান্ত নেন তিনি। আশাতিরিক্তভাবে তার প্রত্যাশা ছাড়িয়ে গিয়ে নিজের ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য প্রমাণ করে হান্স। যেমন, এগারো থেকে ছয় বিয়োগ করার সহজ অঙ্কের সমাধান করতে বলা হলে ঘোড়াটা জমিনে পাঁচবার ডান পায়ের খুর ঠুকে উত্তর দিতো। কচিত ভুল হতো তার। ফন অস্টেনের চালাক ঘোড়ার খবর সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়লে হান্স একটা উত্তেজনাকর প্রসঙ্গে পরিণত হয়। ঘোড়াটার এমনি কা- দেখতে লোকজন ভীড় জমাতে শুরু করে। এবং বেশির ভাগই হান্স সত্যিই বুদ্ধিমান ঘোড়া বিশ্বাস করে ফিরে যায়।
এমনকি অনেকে, এদেও ভেতর বহু নাম করা বিজ্ঞানীও ছিলেন, যারা জোচ্চুরি থাকার কথা সন্দেহ করেছিল তারাও প্রশিক্ষক আশপাশে না থাকলেও ঘোড়াটা সরাসরি সঠিক জবাব দিচ্ছে দেখে তাজ্জব বনে গেছে। ঘোড়ার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে, অচিরেই চালাক হ্যন্সের নাম ঘরে ঘরে পরিচিত হয়ে ওঠে। দুঃখজনকভাবে, সেটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। স্টাম্পফ এবং পফাস্ট নামে দুজন অধ্যাপক হান্সের জোচ্চুরি প্রমাণের পণ করে বসলেন। বেশ কয়েকটা পরীক্ষা খাড়া করলেন ওরা। প্রথমটিতে ওরা দুজন ঘোড়াকে প্রশ্ন করার জন্যে একটা অঙ্কের ব্যাপারে একমত হলেন। ওদের একজন ঘোড়ার কানে কানে প্রশ্ন করে পর্দার আড়ালে দৃষ্টির বাইরে চলে যাবেন। এই পরীক্ষায় দুজন পরীক্ষকেরই উত্তর জানা থাকায় হান্স দৃশ্যত সঠিকভাবে প্রশ্নের জবাব দিতে পারল। দ্বিতীয় পরীক্ষায় অবশ্য অন্যজনকে উত্তর না জানিয়েই একটা সমস্যার কথা ভাবলেন অপরজন, তারপর ঘোড়ার কানে কানে প্রশ্ন করে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলেন তিনি। এ অবস্থায় হান্স দৃশ্যত সঠিক উত্তর দিতে ব্যর্থ হলো। আরও তল্লাশির পর জানা গেল হান্স সত্যিই দুর্দান্ত বুদ্ধিমান, তবে সেটা লোকে যা ভেবেছে তেমন নয়। সমস্যার সঠিক সমাধানের ক্ষেত্রে লোকজনের অঙ্গভঙ্গি আর মুখের হাবভাবে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পরিবর্তন ধরতে পারাই ছিল হান্সর আসল ক্ষমতা। সঠিক জবাব দেওয়ার জন্যে হান্সকে কেবল সম্মোহিত দর্শকের তরফ থেকে থামার সঠিক ইশারা পাওয়ার আগ পর্যন্ত জমিনে পা ঠুকতে হতো।
ঘোড়াটাকে সঙ্কেত পাঠানোর ব্যাপারটা না জানায় ফন অস্টেনসহ সবাই বোকা বনেছিল। (মানুষের ক্ষেত্রে এই ধরনের নির্বাক বার্তা অজান্তেই লেনদেন হয়।) এখানে পশুর বোধশক্তিকে মারাত্মকভাবে খাটো করে দেখেছিল বলেই লোকে হান্স তার সমাধান করা সমস্যা বুঝতে পেরেছে ধরে নেওয়ার ফাঁদে পা দিয়েছে।
আসলে চালাক হান্স বিশেষভাবে ব্যতিক্রমী ছিল না। শত শত বছর ধরে কথা-বলা পশুপাখি কিংবা অন্ততপক্ষে বোঝার বিস্ময়কর ক্ষমতাধর পশুপাখির কথা সবাই জানে। অবশ্য চালাক হান্স বিশদ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার আওতায় আসা প্রথম এধরনের পশু ছিল। তার চালাকির উন্মোচন এই ধরনের সব ঘটনার উপর সংশয়ের ছায়া ফেলেছে। এই আত্মপ্রব নার অপমানকর ঘটনা থেকে উদ্ধার পেতে বিজ্ঞান জগতের অনেকগুলো দশক লেগেছে। তারপর ১৯৬০ দশকের গোড়ার দিকে ফের কথাবলা পশুপাখির খবর পাওয়া যায়, এবার ঘোড়া নয়, সেটা ছিল ডলফিন। ডলফিনের মতো সাগরের স্তন্যপায়ী প্রাণীদের বুদ্ধিমান এবং এদের অনায়াসে প্রশিক্ষণ দেওয়া যাওয়ার বিষয়টি বহুদিন থেকেই স্বীকৃত। সাধারণ মানুষের বিনোদনের জন্যে এদের বিস্ময়কর সব কলাকৌশল শেখানো সম্ভব।
কিন্তু ১৯৬১ সালে আরও বেশি উত্তেজনাকর পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে ম্যান অ্যান্ড ডলফিন নামে একটি বই বেরোয়। লেখক জন সি. লিলি ছিলেন প্রকৃতিবিদ, জ্যান্ত ডলফিনের মস্তিস্ক নিয়ে গবেষণা করছিলেন তিনি। বিশেষ করে তাদের কণ্ঠস্বরের আচরণই তার মনোযোগের বিষয় ছিল। প্রাথমিক বিপর্যয় সত্ত্বেও (তার পরীক্ষাধীন অনেক পশু অ্যানেন্থেসিয়ার কারণে মারা গিয়েছিল) ডলফিনকে সুর তুলতে শিখিয়েছিলেন লিলি। তার পশুগুলোর কোনওকোনওটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষের কথার চলনসই অনুকরণ করতে পারছে বলে লক্ষ করেন তিনি। ডলফিন ব্যতিক্রমীভাবে জটিল ও বড় আকারের মস্তিষ্কের অধিকারী হওয়ার বাস্তবতার সাথে এই পর্যবেক্ষণে অনুপ্রাণিত লিলি আশাবাদী ভবিষ্যদ্বাণী করেন: 'আগামী দুএক দশকের ভেতর' মানুষ অন্য একটি প্রজাতির সাথে যোগাযোগ স্থাপন করবে, এবং সম্ভবত সেটি সাগরের কোনও প্রাণী।
লিলির এই বইটি উল্লেখযোগ্য মিডিয়ার নজর কাড়ে, বেশ কয়েকটি ভবিষ্যদ্বাদী উপন্যাস ও চলচিত্র নির্মাণে উৎসাহ যোগায়। আরও বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, সম্ভবত তার যুক্তিগুলো ভীষণ বিশ্বাসযোগ্য হওয়ায় মানুষ-ডলফিন যোগাযোগের উপর গবেষণা উল্লেখযোগ্য সরকারী তহবিলও আকৃষ্ট করে। কিন্তু হায়, এইসব প্রয়াস সত্ত্বেও লিলির কথাবলা ডলফিন কখনও বাস্তবায়িত হয়নি। এক দশকের ভেতরই স্পষ্ট হয়ে যায় যে চালাক হান্সর প্রেতাত্মা ¯্রফে অচেনা আবরণে আবার দেখা দিয়েছে। গবেষণার পুরো কর্মসূচিই বাতিল করে দেওয়া হয়।
স্পষ্টতই অবিচলিত বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায় আরও একবার তাদের নজর অন্যদিকে ফেরায়। এবার সেটা নরাকার শিম্পাঞ্জির দিকে। আমাদের নিকটতম জ্যান্ত আত্মীয় শিম্পাঞ্জি দীর্ঘকাল ধরে বিশেষ মনোযোগের বিষয় হয়েছিল। এদের কথা শেখানোর ধারণা মোটেও নতুন নয়। এক্ষেত্রে ১৮৯৬ থেকে ১৯৪০-র দশক নাগাদ বিভিন্ন জনের একেবারে গোড়ার দিকের গবেষণা অবশ্য ব্যাপকভাবে ব্যর্থ ছিল। যেমন ১৯৪৭ সালে এক তরুণ আমেরিকান মনোবিদ এবং তার স্ত্রী ভিকি নামে এক মাস বয়সী একটা শিম্পাঞ্জিকে দত্তক নিয়ে সেটিকে মেয়ে হিসাবে পালন করেন। মৃত্যুর আগপর্যন্ত ছয় বছর বয়স অবধি ভিকিকে সন্তানের মতো লালন করা হয়। ভাষা শেখানোর ব্যাপক কর্মসূচির অধীনে থাকলেও পাপা-মামা, এবং কাপ-আপ এই দুটি জোড়া শব্দই কেবল আয়ত্ত করতে পেরেছিল সে। অনেকটা ফিসফিস করে কথাগুলো বলতো। বিভিন্ন শব্দ সঠিকভাবে উচ্চারণের জন্যে প্রয়োজনীয় স্বরযন্ত্র না থাকায় শিম্পাঞ্জি মানবীয় ভাষা আয়ত্তে অক্ষম বলে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়।
গোড়ার দিকের এইসব নেতিবাচক ফল সত্ত্বেও ১৯৭০ দশকে কথাবলা শিম্পাঞ্জির খবর আবার শিরোনামে পরিণত হয়। ইউনিভার্সিটি অভ নাভাদায় অ্যালেন এবং বিয়েত্রিস গার্ডনার দম্পতি ওয়াশু নামে একটি শিম্পাঞ্জিকে আমেরিকান সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ (বধিরদের জন্যে পরিকল্পিত হাতের সঙ্কেতের একটি পদ্ধতি) শেখানো শুরু করেছিলেন। চার বছর নিবিড় প্রশিক্ষণ শেষে ওয়াশু ১৩২ টি বিভিন্ন সঙ্কেতের শব্দভা-ার আয়ত্ত করেছে বলে দাবী করেন গার্ডনার দম্পতি। এসব সঙ্কেতে সে আপাত অর্থপূর্ণ 'বাক্যে' মেলাতে পারে। ওয়াশূ এবং তার প্রশিক্ষকদের নিবিড় সম্পর্কের কারণে তথাকথিত 'চালাক হান্স প্রভাবের' বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া কঠিন ছিল। অন্য কথায়, গার্ডনার দম্পতি হয়তো তাদের অজান্তেনই ওয়াশূকে শুদ্ধ বা প্রত্যাশিত উত্তর দেওয়ার নির্বাক সূত্র যুগিয়েছেন। এমনকি ওয়াশূ 'আমাকে একটু পানি দাও,'-এর মতো স্বতঃস্ফূর্ত অনুরোধ জানানোর সময়ও মানুষের মতো সঙ্কেতগুলো প্রতীকি বা বিমূর্ত অর্থে বুঝতে পারছে কিনা স্পষ্ট ছিল না। এমনও হতে পারে যে, একটা বিশেষ কাক্সিক্ষত ফলের সাথে কোনও একটা ইশারা বা কিছু ইশারাকে একাত্ম করতে শিখেছিল সে।
'প্রজেক্ট ওয়াশূ'র বেলায় এইসব আপত্তি এবং অন্যান্য সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ গবেষষণা শিম্পাঞ্জির ভাষাগত ক্ষমতা পরীক্ষার বিশদ এবং আধুনিক কৌশল উদ্ভাবনের দিকে চালিত করেছে। মানবীয় হস্তক্ষেপ ও চালাক হান্স প্রভাব দূর করার উদ্দেশ্যে 'শব্দের অনুরূপ' হিসাবে রঙিন প্লাস্টিক চিপ ব্যবহার করে কৃত্রিম ভাষা এবং বিশষে ধরনের জ্যামিতিক প্রতীকে তৈরি কম্পিউটারের কী-বোর্ড উদ্ভাবিত হয়েছে। এমনকি শিম্পাঞ্জিদের এই ধরনের কৃত্রিম ভাষায় পরস্পরের সাথে যোগাযোগের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে। এই ধরনের গবেষণায় দেখা গেছে শিম্পাঞ্জিদের বিমূর্তভাবে তাদের ব্যবহৃত প্রতীকের অর্থ বুঝতে প্রশিক্ষিত করা সম্ভব। অন্য কথায়, বাক্যনির্মাণের প্রাথমিক ধারণা বা বিভিন্ন বস্তু, অবস্থা বা ঘটনার কথা তুলে ধরতে এরা খেয়ালী প্রতীক ব্যবহার করতে পারে। তাসত্ত্বেও এই গবেষণা শিম্পাঞ্জিরা ব্যাকরণ বা বাক্য গঠনের শনাক্তযোগ্য নিয়ম অনুযায়ী এই সমস্ত প্রতীককে বিন্যস্ত করতে পারে, এমনটা প্রমাণ করতে পারেনি। সংক্ষেপে, এদের কথোপকথনের ক্ষমতা নেহাতই সীমিত। সম্ভবত শিম্পাঞ্জিদের মানবীয় শব্দ উচ্চারণের অক্ষমতার কারণেই বিজ্ঞানীরা এখন অন্যান্য আরও 'বাচাল' প্রজাতির ভাষাগত ক্ষমতার সুলুক সন্ধান করছেন। বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন যে কাকাতুয়ার মতো কথাবলা পাখি আন্দাজে বিভিন্ন শব্দ অনুকরণ করে, কিন্তু জুৎসই প্রসঙ্গে ভাষা ব্যবহারের ক্ষমতাহীন। সেজন্যে কাকাতুয়া বা টিয়াপাখির মতো মুখস্থ করার বুলি তৈরি হয়েছে; যার মানে কিছুই না বুঝে কিছু অনুকরণ করা।
বেশ কয়েক বছরের সযতœ তালিমের পর অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা অ্যালেক্স নামে একটি আফ্রিকান ধূসর কাকাতুয়াকে কাগজ, পাথর, ছিপি বা পানির মতো বিশটারও বেশি বিভিন্ন বস্তুর মৌখিক নাম শেখাতে পেরেছেন। পাঁচটা ভিন্ন ভিন্ন রঙ, চারটা আকার এবং 'চাই', 'এদিকে এসো', 'আমাকে সুরসুরি দিচ্ছ'র মতো বিভিন্ন নির্দেশও জানে সে।
সবচেয়ে বড় কথা, অ্যালেক্স প াশটিরও বেশি বিভিন্ন জিনিস শনাক্ত, অনুরোধ কিংবা প্রত্যাখ্যান করার জন্যে বুদ্ধি খাটিয়ে এইসব শব্দ মেলাতে পারে। এমনকি এমন শব্দও আছে যেগুলো মূল প্রশিক্ষণের অংশ ছিল না। কিন্তু প্রশিক্ষকদের সাথে কথোপকথনে যোগ দেওয়ার পর্যায় থেকে অ্যালেক্স বহুদূর, এবং বিজ্ঞানীদেও অনেকেই একে স্রেফ সঙ্গ-সুবাদে শেখার আরেকটা নজীর এবং চালাক হান্স প্রভাব বলে মত দিয়েছেন। তবু তার সাফল্য ইতিমধ্যে গায়ক শিম্পাঞ্জির প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত হয়েছে। অ্যালেক্স সামান্য কাকাতুয়া মাত্র।
আপাতত মানুষের সাথে বা নিজেদের ভেতর কথোপকথনে সক্ষম কথাবলা পশুপাখিকে কিংবদন্তী এবং শিশুতোষ সাহিত্যের বিষয় হয়েই থাকতে হবে। আমাদের অ-মানুষ আত্মীয়দের শিক্ষিত করে তোলার সব প্রয়াস ভাষা আয়ত্ত করার মতো কাউকে হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছে। তার মানে অবশ্য এই নয় যে মানুষ এবং পশুপাখি যোগাযোগে অক্ষম। রাখাল এবং তার কুকুর বা নিপুণ অশ্বারোহী ও তার ঘোড়ার দিকে নিবিড় মনোযোগ রাখলেই অস্তিত্ববান অনন্য সাধারণ যোগাযোগের মাত্রা আঁচ করা সম্ভব। কিন্তু এখানে এই যোগাযোগ এবং সর্বক্ষণ মানুষের ভেতর চলমান যোগাযোগের ভেতর একটা মৌলিক পার্থক্য রয়ে গেছে।
বিমূর্ত প্রতীক এবং ব্যাকরণের নিয়মকানুন নিয়ে ভাষা আপাত মানুষের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। কেবল আমরাই অনায়াসে এবং আপাত স্বতঃস্ফুর্তভাবে এটি আয়ত্ত করতে পারি। সেকারণেই স্বাভাবিক বিকাশের ক্ষেত্রে কেউ ভাষা না শিখলে আমরা কোথাও মারাত্মক ঝামেলা আছে ভেবে উদ্বিগ্ন হই। আমাদের জটিল সামাজিক ও বস্তুগত জীবনে টিকে থাকতে আমাদের ভাষার দরকার। তবে দৃশ্যত মনে হয় যে পশুপাখির এর দরকার নেই। ভাষা ছাড়াই তারা দক্ষতা ও কার্যকরভাবে জীবনযাপন করতে পারে। কিন্তু, এসবই যদি ঠিক হয়, তাহলে মানুষ কেন পশুপাখির সাথে কথা বলার চিন্তার পেছনে এত সময় আর সম্পদ ব্যয় করতে গেল? এ থেকে আসলে কি উপকার হবে আমাদের? পশুপাখি কি ভাবছে, অনুভব করছে জানা কিংবা ওদের জীবন সম্পর্কে সরাসরি প্রশ্ন করা নিঃসন্দেহে কৌতূহলোদ্দীপক (এবং সন্দেহাতীতভাবে নীতিগতভাবে বিব্রতকর)। কিন্তু বস্তুত আমরা কখনওই এই ধরনের সংলাপের ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারিনি।
সম্ভবত আমাদের আসল উদ্দেশ্য যোগাযোগের সরল একটা ইচ্ছামাত্র; আমাদেরই পাশব-মূলের সাথে আবার একাত্ম হওয়ার ইচ্ছা। মানবীয় ভাষা এবং আত্মসচেনতাবোধ আমাদের কার্যকরভাবে পশুজগত থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। আদম এবং ইভ যেমন জানতে পেরেছিলেন, আত্মসচেতনতার মাশুল ছিল স্বর্গোদ্যান থেকে বিতাড়ন। তবু কিংবদন্তী, রূপকথা এবং শিশুতোষ সাহিত্যে এবং চতুর ঘোড়া, গায়ক শিম্পাঞ্জি এবং কথাবলা কাকাতুয়াদের সাথে অতি সাম্প্রতিক সংযোগে আমরা যেন এই বিচ্ছেদকে স্রেফ সাময়িক বলে নিরবিচ্ছিন্ন আশা লালন করে চলি, সেটা দুরাশা হলেও।