লক্ষ্মীপুরে এখনও আটকে আছে বন্যার পানি: কারণ কী?
সাম্প্রতিক ফেনীর বন্যার পানি যেন ধাক্কা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে পার্শ্ববর্তী জেলা লক্ষ্মীপুরে। যে পানি কয়েক দিনের মধ্যেই বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ার কথা, সেই পানি এখনও জমে আছে পাশের উপকূলীয় জেলায়।
ফলে প্রায় দুই সপ্তাহ যাবত ঘরবাড়িতে গলা-সমান পানি নিয়ে এখন দিশেহারা লক্ষ্মীপুরবাসী। জেলার সদর উপজেলা যেন পানির সাগর। রামগঞ্জ, রায়পুর পানিতে একেবারে টইটম্বুর।
রামগতি ও কমলনগরের পাঁচটি ইউনিয়নসহ নোয়াখালী সদর উপজেলায় ৪০ দিনেও যেন একফোঁটা পানি নড়ছে না। অবর্ননীয় দুর্ভোগে বসবাস করছেন কয়েক লাখ মানুষ। দুর্যোগের জেলায় এমন বন্যা আর পানিকে নজিরবিহীন বলছে স্থানীয়রা।
নিম্নাঞ্চলীয় (যেখান দিয়ে পানি সহজে বেরিয়ে যায়) জেলা হওয়া সত্ত্বেও লক্ষ্মীপুরে এসে বন্যা কেন দাঁড়িয়ে গেল— বিভিন্ন মাধ্যমে তা গভীরভাবে জানার চেষ্টা করেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। এ বিষয়ে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
গত ৫-৬ দিনে বিভিন্ন উপজেলার অন্তত ৫০ জন মানুষের সাথে কথা বলে তাদের অভিজ্ঞতা জানতে হওয়া হয়। ভুক্তভোগীদের সকলেই একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন।
জলাবায়ু বিষয়ক আর্ন্তজাতিক খ্যাতিমান ও উপকূল বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম মন্টু বলেন, "নদ-নদী খাল বেষ্টিত উপকূল হচ্ছে সারাদেশের পানি নেমে যাওয়ার একমাত্র পথ। উপকূলে ঘূর্ণিঝড় হয়, নদীর জোয়ারে মাঝে মধ্যে কয়েক ঘণ্টার জন্য উপকূল প্লাবিত হয়। আবার ৫-৬ ঘণ্টা কিংবা তার একটু বেশি সময়ের মধ্যে সে পানি নেমে যায়।"
"ঢল কিংবা বৃষ্টি যেভাবেই হোক বন্যার পানি লক্ষ্মীপুরের মতো উপকূলীয় জেলায় এসে প্রায় দুই সপ্তাহ আটকে থাকা পুরোপুরি অস্বাভাবিক। দীর্ঘ সময় ধরে দখলবাজি, জলাশয় আটকে দেওয়াই বন্যার পানি না নামার একমাত্র কারণ বলে মনে হচ্ছে," যোগ করেন তিনি।
মাছের ঘের, বাঁধে আটকা বন্যার পানি
সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম মন্টুর মন্তব্যের সাথে পুরোপুরি মিল পাওয়া গেছে লক্ষ্মীপুরের পথে পথে।
মেঘনা নদীর নিকটবর্তী এলাকায় নদীর পানির স্তর বাঁধের ৮-১০ ফুট নিচে। মেঘনাপাড়ের বহু এলাকায় ফসলি জমিতে পানি নেই। এর পুরো বিপরীত চিত্র দেখা গেল একটু দূরে, যেখানে কেবল পানি আর পানি।
মেঘনা নদী থেকে লক্ষ্মীপুরের রামগতি, কমলনগর, লক্ষ্মীপুর সদর এবং নোয়াখালীর সুর্বনচর ও সদর উপজেলা হয়ে ছুটে আসা ভুলুয়া নদ ছুটে মিশেছে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ওয়াপদা খালে। অন্য অংশ ছুটে গেছে নোয়াখালীর ভেতরে। ৭৬ কিলোমিটার এ নদের প্রতি ১০০ ফুটে রয়েছে মাছ ধরার একটি করে জাল কিংবা একটি ডুবন্ত বাঁধ, বাড়ির পথ কিংবা ইটভাটার রাস্তা।
নানান প্রজাতির এ জাল ও বাঁধে পানি কোনোভাবেই নড়ছে না। রামগতির চরপোড়াগাছা ইউনিয়নের কোডেক বাজার থেকে আজাদনগর এলাকায় কয়েকজন ভূমি ডাকাত ভুলুয়া দখল করে বসতি স্থাপনকারীদের কাছে বিক্রি করেছে। নদীতে মাছের ঘের, মুরগীর খামার করেছে তারা। ৫০০ মিটার চওড়া ভুলুয়া এখানে এসে হয়ে গেছে ৩০ ফুট। ফলে ৭৬ কিলোমিটার দূরের পানি, এই ৩০ ফুট অগভীর পথ দিয়ে বের হচ্ছে না।
লক্ষ্মীপুর-রামগতি সড়কের পূর্ব পাশের ভবানীগঞ্জ থেকে তোরাবগঞ্জ বাজার পর্যন্ত সড়ক পাশ দিয়ে মুছার খালের এক মাথা গেছে ওয়াপদা খালে অন্য মাথা মেঘনায়। প্রায় ১০০ ফুট চওড়া খালটির ওপর চর মনসা এলাকায় আশপাশের কয়েকটি ইটভাটা বড় বড় রাস্তা তৈরি করে পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে খাল।
ছোট নদী ডাকাতিয়া। কুমিল্লা থেকে আঁকাবাঁকা পথে চাঁদপুর ও নোয়াখালী হয়ে এসে পৌঁছেছে লক্ষ্মীপুরে। স্থানীয় বাসিন্দা আজম খাঁন ও আবদুর রহমান সুমন জানান, রায়পুর বাজার থেকে ডুবন্ত ও দৃশ্যমান শতশত বাঁধে আটকে গেছে ডাকাতিয়া।
রায়পুর সরকারি মহিলা কলেজ করা হয়েছে ডাকাতিয়া নদীর বুকে। স্থানীয় প্রভাবশালীরা নদীটি নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে মোটা জাল আর কচুরিপানার বাঁধ দিয়ে করছেন মাছের চাষ।
খালে খালে জমেছে ময়লা-আবর্জনা
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ এবং নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি হয়ে পশ্চিমের ডাকাতিয়া নদীতে পানি প্রবাহের একমাত্র খালের নাম বীরেন্দ্র খাল। রামগঞ্জ উপজেলা শহরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বীরেন্দ্র খালে শতশত টন আর্বজনায় সোনাইমুড়ির পানি ডাকাতিয়ায় যেতে পারছে না। এ খাল এখন কার্যত বন্ধ। ফলে এক মাসের বেশি সময় জলাবদ্ধতা থেকে এখন বন্যায় ভাসছে পুরো উপজেলার হাজার হাজার মানুষ।
লক্ষ্মীপুর-চৌমুহনী সড়কের মান্দারি একটি বড় বাজার। বাজারের পূর্ব দিকে রহমতখালী খালের সাথে মিলেছে মান্দারি-মোল্লারহাট খাল। খালটির মুখ থেকে বাজারের প্রায় ৫০০ মিটারের মধ্যে এক ইঞ্চি জায়গা খালি নেই। ময়লা আবর্জনাতে ভরে আছে পুরো খাল। পানি নামার কোনো পথই নেই।
লক্ষ্মীপুর-চৌমুহনী সড়কের পাশ দিয়ে বয়ে চলা রহমত খালী খাল পাড়ে যতগুলো বাজার রয়েছে, সকল বাজারের শতশত টন ময়লায় খালগুলো ভর্তি। স্থানীয় বাসিন্দা জুনায়েদ আহমেদ জানিয়েছেন, এই খাল হয়েই নোয়াখালীর বন্যার কিছু পানি নামছে মেঘনা নদীতে। কিন্তু ময়লাভর্তি খাল এখন পানি নিতে পারছেনা। তাই রহমতখালীর দুপাড়ে কয়েকটি ইউনিয়নে দীর্ঘদিন জলাবদ্ধতা থেকে এখন বন্যা।
জেলার স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে জানা গেছে, লক্ষ্মীপুর জেলাব্যাপী ১৭৯টি ইজারাপ্রাপ্ত হাট–বাজার রয়েছে। এর বাইরে আরও শতাধিক ছোট ছোট বাজার রয়েছে। গ্রামের সকল বাজার থেকে উৎপন্ন ময়লা আবর্জনার বেশির ভাগই ফেলা হয় নিকটবর্তী খালে। এতে খালের পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে খাল মরে গেছে।
স্লুইচ গেট দখল
নদীর জোয়ার ও সেচের পানি নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্রিটিশ আমলেই লক্ষ্মীপুরে নির্মাণ করা হয়েছে অসংখ্য রেগুলেটর এবং স্লুইচগেট। ভুলুয়া নদের শাখা রাতাচূড়া খালের স্লুইচ গেচটটি দখল করে স্থানীয়রা বাজার বসিয়েছেন। এতে ৬টি গেটের মধ্যে ৪টি গেট বন্ধ হয়ে গেছে।
একইভাবে একই বেঁড়ির মৌলভীরহাট বাজার স্লুইচগেট, চৌধুরীবাজার স্লুইচগেট এবং তোরাবগঞ্জ পূর্ব বাজারের স্লুইচ গেটটি স্থানীয়রা দখল করে বাজার বানিয়ে বন্ধ করে দিয়েছেন। এ স্লুইচ গেটগুলো দিয়ে ভুলুয়ার পানি বিভিন্ন খাল হয়ে মেঘনায় পড়তো।
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, লক্ষ্মীপুরে বিভিন্ন খালে ৮টি রেগুলেটর এবং ২৩টি স্লুইচগেট রয়েছে। প্রায় সবগুলো স্লুইচ গেটই দখল হয়ে গেছে।
কী বলছে কর্তৃপক্ষ?
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নাহিদুজ্জামান জানিয়েছেন, লক্ষ্মীপুরে প্রধান তিনটি নদী ছাড়াও ৯৯টি ছোট বড় খাল এবং এদের শাখা রয়েছে। যেগুলোর মোট দৈর্ঘ্য ৪৯৮ কিলোমিটার। অন্যদিকে, ৭৬ কিলোমিটার লম্বা ভুলুয়া এবং ২৩ কিলোমিটার ডাকাতিয়া ও মেঘনানদীর ৫০ কিলোমিটার সীমানা রয়েছে লক্ষ্মীপুরে।
"সবগুলো খালের পানি ব্যবস্থাপনার প্রধান দায়িত্বেই রয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু খাল সংস্কার করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ এবং বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি)," বলেন তিনি।
লক্ষ্মীপুর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইকরামুল হক জানান, লক্ষ্মীপুরের প্রায় সবগুলো খাল বিভিন্নভাবে দখল হয়ে গেছে। গত অর্থ বছরে লক্ষ্মীপুরে মাত্র ৩টি খালে প্রায় ৭ কিলোমিটার সংস্কারের আদেশ দেওয়া হয়।
তিনিন বলেন, "এই সামান্য খাল সংস্কার করতে গেলে বনবিভাগের গাছ, খালের সীমানা নির্ধারণ এবং প্রভাবশালীদের বাঁধায় খাল সংস্কারে বড় সমস্যা তৈরি হয়।"
অন্যদিকে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) লক্ষ্মীপুর সেচ বিভাগের উপ সহকারী প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, "২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিএডিসি লক্ষ্মীপুর জেলার বিভিন্ন খালে ১৪০ কিলোমিটার সংস্কার করেছে।"