ক্ষতিগ্রস্ত পণ্য নিতে অস্বীকৃতি, চট্টগ্রাম বন্দরে ৩ মাস ধরে আটকে আছে লাইবেরিয়ান জাহাজ
ব্রাজিলের সান্তারেম বন্দর থেকে ৫০,০৭১ মেট্রিক টন সয়াবিন নিয়ে আসা লাইবেরিয়ান পতাকাবাহী জাহাজ এমভি মানা, পণ্যের গুণগত মান সংক্রান্ত জটিলতায় গত তিন মাস ধরে আটকে আছে চট্টগ্রাম বন্দরে। চলতি বছরের ৮ জুন জাহাজটি বাংলাদেশের বন্দরে এসে পৌঁছায়।
জাহাজটি থেকে ইতোমধ্যে টিকে গ্রুপের মালিকানাধীন শবনম ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ এবং সুপার অয়েল রিফাইনারি লিমিটেডের আমদানি করা ৩০,০০০ মেট্রিক টন সয়াবিন খালাসও করা হয়েছে।
কিন্তু জাহাজে পানি প্রবেশ করে গুণগত মান নষ্ট হওয়ায় ডেল্টা অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের আমদানি করা বাকি ২০,০৭০ মেট্রিক টন সয়াবিন পণ্য খালাস বন্ধ রেখেছে আমদানিকারক এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট ডিক্লেয়ারিং এজেন্ট।
এর ফলে গত তিন মাস ধরে চট্টগ্রাম বন্দরে আটকে আছে লাইবেরিয়ার পতাকাবাহী জাহজটি। এ বিষয়ে সমাধান না আসায় চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে যেতে পারছে না খোলা পণ্যবাহী (বাল্ক ক্যারিয়ার) এমভি মানা।
এদিকে, জাহাজের মালিক অ্যাক্টিভ মেরিটাইম লিমিটেড, পিএন্ডআই প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে— আমদানিকারক, ডিক্লেয়ারিং এজেন্টের অসযোগীতার করণে চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে যেতে পারছে না জাহাজটি। এতে জাহাজ মালিকের ভাড়া বাবদ প্রতিদিন অন্তত ১৫,০০০ ডলার করে ক্ষতি হচ্ছে।
বিষয়টি দ্রুত সমাধানে গত ৬ সেপ্টম্বর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং কাস্টমসের হস্তক্ষেপ কামনা করে জাহাজের মালিক প্রতিষ্ঠান এবং ক্যাপ্টেন। ১০ সেপ্টেম্বর তারিখ বন্দর চেয়ারম্যান এবং কাস্টমস কমিশনারের সাথে দেখাও করেছে জাহাজ মালিক কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এবং কাস্টম কমিশনারকে এমভি মনার ক্যাপ্টেন আন্দোনভ ইয়র্ডান এক চিঠিতে বলেছেন, 'রিসিভারদের আইনগত বাধ্যবাধকতা আছে পণ্যের ডেলিভারি নেওয়ার এবং পণ্য নিয়ে তাদের কোনো অভিযোগ থাকলে, সেটি সম্পূর্ণ পণ্যের ডেলিভারি গ্রহণের পরেই দাখিল করতে হবে। কিন্তু এর পরিবর্তে, রিসিভার কর্তৃপক্ষ বেআইনি দাবি তুলে পণ্য ডেলিভারি না নিয়ে জাহাজ মালিককে বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রদানে চাপ দিচ্ছে।'
'এটি স্পষ্টতই চাঁদাবাজির সামিল এবং এটি বাংলাদেশ ও চট্টগ্রাম বন্দরের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে। পণ্য ডেলিভারি নিতে অস্বীকার করায় জাহাজটি প্রায় তিন মাস ধরে বন্দরে আটকে আছে,' উল্লেখ করা হয় চিঠিতে।
পণ্যের আমদনিকারক ডেল্টা এগ্রো ফুডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মুস্তফা হায়দার টিবিএসকে বলেন, "পণ্য ড্যামেজ হওয়ায় কমার্শিয়াল ডিসপুট (দ্বন্দ্ব) হয়েছে। পণ্যের কাস্টডিয়ান হিসেবে সব ওই জাহাজ মালিকপক্ষের। এটি এখন মীমাংসার প্রক্রিয়ায় আছে। তবে যেসব পণ্য খালাস করা হয়েছে, সেগুলোর মানও খারাপ ছিল।"
আমদানিকারকের প্রতিনিধি ডিক্লেয়ারিং এজেন্ট সিকম-এর তথ্য অনুযায়ী, জাহাজে থাকা প্রতি টন সয়াবিনের মূল্য ৪৪০ ডলার। সেই হিসেবে ২০ হাজার ৭০ মেট্রিক টন সয়াবিনের ক্রয়মূল্য ৮৮,৩০,৮০০ ডলার।
সিকম গ্রুপের পরিচালক জহুর আহমেদ বলেন, পানি প্রবেশ করার কারণে আমদানি পণ্যের কোয়ালিটি নিয়ে একটি দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। জাহাজ মালিকপক্ষের বিলম্বের কারণে বিষয়টি সমাধানেও বিলম্ব হচ্ছে।
তিনি বলেন, "তবে জাহাজ মালিকের প্রতিনিধি বাংলাদেশে এসেছেন। তাদের সাথে কার্গো রিসিভারের আলোচনা চলছে। এক সপ্তাহের মধ্যে এ বিষয়ে একটি সামাধান হবে বলে প্রত্যাশা করছি।"
জাহাজের পিএন্ডআই করেসপন্ডেন্ট ইন্টারপোর্ট জানিয়েছে, কার্গো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরিমাণ এবং ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের জন্য গত ১১ জুন সার্ভে করা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত কার্গো ম্যানুয়েলি পৃথক করার সুপারিশ করেছিল সার্ভে টিম। কিন্তু সেটি করা হয়নি। গত তিন মাস ধরে একই অবস্থায় থাকায় ক্রমশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে পণ্য।
জাহাজটির সার্ভে করার সময় স্যালভেজ টিম টনপ্রতি ৩০০ ডলার মূল্যে এসব সয়াবিন কিনতে চেয়েছিল। কিন্তু আমদানিকারক, ডিক্লেয়ারিং এজেন্ট সাড়া না দেওয়ায় সেটি বিক্রি করা যায়নি। এখন টনপ্রতি ১০০ ডলার দামেও এসব পণ্য বিক্রয় করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন জাহাজ সংশ্লিষ্টরা।
শিপিং খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভাবে তিনমাস বন্দরে জাহাজ আটকে থাকা নজিরবিহীন। এতে চট্টগ্রাম বন্দর সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। দ্রুত এ ঘটনার নিষ্পত্তি করে বন্দর থেকে জাহাজ ত্যাগের পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য কাস্টমসের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ টিবিএসকে বলেন, "জাহাজ যতদিন আটকে থাকবে এর সাথে খরচ যুক্ত হবে। দ্রুত বিষয়টি সমাধানে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।"
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক টিবিএসকে বলেন, "জাহাজ কর্তৃপক্ষ থেকে এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। বিষয়টির সমাধান করবে আমদানিকারক, শিপিং এজেন্ট, পিএন্ডআই ক্লাবের সংশ্লিষ্টরা। কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স এবং অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষে চট্টগ্রাম বন্দরের নির্ধারিত ডিউজ পরিশোধ স্বাপেক্ষে জাহাজ ত্যাগের এনওসি দেওয়া হবে।"
এলসি জটিলতায় সাত মাস ধরে আটকে আছে পানামা পতাকাবাহী জাহাজ
এদিকে, এলসি সংক্রান্ত জটিলতায় চট্টগ্রাম বন্দরে ৭ মাস ধরে আটকে আছে পানামা পতাকাবাহী জাহাজ কনকার থিওডোরোস। আবদুল মোনেম গ্রুপের আমদানি করা ৫৮,৯০০ মেট্রিক টন র সুগারের মধ্যে এখনো আটকে আছে ১৪,০০০ মেট্রিক টন পণ্য।
আমদানিকারক আবদুল মোনেম গ্রুপে তথ্য অনুযায়ী, ইসলামী ব্যাংক এলসি দিতে না পারায় বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে। পরবর্তীতে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে এলসি ওপেন করে ধাপে ধাপে ৪৫ হাজার টন র সুগার খালাস করতে পেরেছে। বাকি পণ্য কবে নাগাদ খালাস করা যাবে, সেটিও নিশ্চিত নয়।
আবদুল মোনেম গ্রুপের তথ্য অনুযায়ী, র সুগার ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিও বন্দর থেকে রওনা দিয়ে বাল্ক ক্যারিয়ার কনকার থিওডোরস চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায় ২০২৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। জাহাটিতে ৫৮,৯০০ মেট্রিক টন র সুগার রয়েছে।
আবদুল মোনেম গ্রুপের হেড অব কমার্শিয়াল আজিজ চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, "ব্রাজিলের সরবরাহকারীদের সাথে আমাদের চুক্তি অনুযায়ী তারা চিনি লোড করে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে দেয়। জাহাজ যাত্রা করার পর আমরা ইসলামী ব্যাংকে এলসি ওপেন করি। ইসলামী ব্যাংকে আমাদের এলসি লিমিটও রয়েছে। কিন্তু ডলার সংকট এবং ইসলামী ব্যাংকের সাম্প্রতিক জটিলতার কারণে ব্যাংক আমাদের এলসি দিতে পারছিল না।"
তিনি বলেন, "এরপর কয়েকটি ব্যাংক থেকে এলসি ম্যানেজ করে ধাপে ধাপে প্রায় ৪৫ হাজার মেট্রিক টন কার্গো খালাস করতে পেরেছি। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের নতুন ম্যানেজমেন্ট আমাদের আশ্বস্ত করেছে শীঘ্রই এলসি দেবে। তখন বাকি ১৪,০০০ মেট্রিক টন পণ্য খালাস নিতে পারবো।"
তিনি আরো বলেন, "আমদানি করা প্রতিটন চিনির মূল্য ৬৩২ ডলার। সেই হিসেবে এখনো আটকে আছে ৮৮,৪৮,০০০ ডলারের চিনি। জাহাজের প্রতিদিনের ভাড়া প্রায় ২০,০০০ ডলার হিসেবে গত ৭ মাসে অন্তত ৪২ লাখ ডলার পরিশোধ করতে হবে।"