তিন প্রজন্ম ধরে তাবিজ বানাচ্ছেন নারায়ণগঞ্জের তিন গ্রামের মানুষ
গলায়, কোমরে কিংবা বাহুতে ঘুনসি দিয়ে বাঁধা লোহা অথবা পিতলের তাবিজ পরা মানুষ দেখেনি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
বেশি বিলাসীরা সোনা বা রূপার তাবিজও ব্যবহার করেন। সবচেয়ে বেশি তাবিজ ব্যবহৃত হয় ভারতীয় উপমহাদেশে।
অনেকে ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে তাবিজ পরেন, আবার অনেকে জীবনের নানা সমস্যা দূর হওয়ার আশা নিয়ে এটি পরেন। তাবিজ পরা নিয়ে বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থাকলেও, তাবিজের ব্যবহার নিয়ে সে তর্ক-বিতর্ক পাশে রেখেই ভাবতে চাই — আমাদের দেশে এ তাবিজগুলো কোথায় তৈরি হয়? কারা তৈরি করেন এসব তাবিজ?
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে পেলাম নারায়ণগঞ্জের তিনটি গ্রামের নাম — টানামুশুরী, ভিংরাবো ও দক্ষিণবাগ।
এ তিন গ্রামে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের বসবাস। এ গ্রামের মানুষেরা প্রায় ২০০ বছর ধরে তাবিজ বানাচ্ছেন। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই তাবিজ তৈরি হয়। তিন প্রজন্ম ধরে এ ঐতিহ্য ধরে রেখেছে তারা।
এক সুন্দর সকালে বেরিয়ে পড়লাম তাবিজ বানানোর তিন গ্রাম দেখার উদ্দেশ্যে। তাদের চাওয়া-পাওয়ার গল্প জানতে এবং স্বচক্ষে তাবিজ বানানোর প্রক্রিয়া দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে এ লেখা।
তাবিজ বানানোর কলাকৌশল
কাদামাটিতে ঢাকা পিচের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের ভেতরে প্রবেশ করলাম।
একটি চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলাম, কোন বাড়িতে তাবিজ বানানো হয়? সবাই হেসে বললেন, 'সব বাড়িতেই!'
আরও কিছুদূর এগিয়ে যেতেই শুনতে পেলাম এক বাড়ি থেকে হাতুড়ির ঠকঠক শব্দ। আঙিনায় প্রবেশ করতেই মধ্যবয়সি এক লোক; হাতুড়ি দিয়ে লোহার পাত পিটিয়ে তাবিজ তৈরি করছেন। তার নাম দিলীপ কুমার।
তার পাশেই অনেকগুলো লোহার পাত ও টিনের টুকরো রাখা। এগুলো ঢাকার জিঞ্জিরা ও বিভিন্ন পাইকারি বাজার থেকে কেজি দরে কেনা হয়।
প্রথমে পাতগুলোকে একটা তক্তার সঙ্গে লাগানো পেরেক দিয়ে মাপ নিয়ে বড় লোহা কাটার কাঁচি দিয়ে কাটা হয়। এ কাঁচিকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় 'কাতানি'।
মাপ অনুযায়ী কাটার পর ছোট সিলিন্ডার আকৃতির লোহার সঙ্গে পাতটিকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে সিলিন্ডারের আকৃতি দেওয়া হয়। এভাবেই তৈরি হয় তাবিজের প্রাথমিক রূপ।
তাবিজের একপাশ বন্ধ করার জন্য আরও একটি ছোট চারকোণা লোহার পাত লাগানো হয়। একে বলা হয় 'চান্দাইড়'।
চান্দাইড়কে আবার কাতানি দিয়ে কেটে সিলিন্ডার আকারে আনা হয়। তারপর তাবিজের ওপরে ক্ষুদ্র আকারের একটি আংটা লাগানো হয়, যার ভেতর দিয়ে কালো সুতা বা ঘুনসি ঢুকিয়ে তাবিজ শরীরে বাঁধা হয়। এ আংটাকে তারা বলেন 'কোড়া'।
তাবিজ আর কোড়াকে একসাথে পেঁচানোর প্রক্রিয়াকে বলা হয় 'বান্ধন'। বান্ধন দেওয়ার পরে তাবিজগুলো জমিয়ে রাখা হয়।
তাবিজের সঙ্গে কোড়াকে জোড়া দেওয়ার জন্য একটি ব্যতিক্রমী পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। ছোট তাবিজে ঝালাই যন্ত্র ব্যবহার করা সম্ভব হয় না, তাই মাটি ও আগুন ব্যবহার করে ঝালাই করা হয়।
ঝালাইয়ের আগে তাবিজের ভেতরে একটি ছোট পিতলের টুকরো রাখা হয়। এটি ভেতরে গলে গিয়ে কোড়াকে তাবিজের সঙ্গে জোড়া লাগিয়ে দেয়।
সুতা দিয়ে বাঁধা তাবিজকে ঝালাই করার জন্য কাদামাটি ব্যবহার করা হয়। প্রতিটি তাবিজ মাটি দিয়ে মুড়ে রোদে শুকানো হয়।
এরপর এগুলো আগুনে দেওয়া হয় ঝালাইয়ের জন্য। আগুনে পোড়ালে তাবিজের ভেতরের পিতল গলে গিয়ে তাবিজের সব অংশ একসাথে জোড়া লেগে যায়।
মাটি দিয়ে মুড়ে আগুনে ঝালাই করার প্রক্রিয়াকে কারিগরেরা 'আপড়' বলেন। আগুন থেকে বের করে ঠান্ডা হওয়ার পর মাটি ছাড়ানো হয়। তারপর তাবিজগুলোকে রেতি দিয়ে ঘষে উজ্জ্বল করলেই সম্পূর্ণ হয় তাবিজ বানানোর প্রক্রিয়া।
দিলীপ কুমার বলেন, 'আমরা প্রতি মাসে দশ-বারো হাজার তাবিজ বানাই। মহাজনের কাছে একেকটা বিক্রি করি ৪০ থেকে ৬০ পয়সা করে। মহাজন সেগুলো ১০, ২০, ৩০ টাকা যেভাবে পারেন বিক্রি করেন।'
তিনি জানান, এখন এ ব্যবসায় লাভ কম। 'আগে বাণিজ্য বেশি ছিল, লাভও বেশি হতো। এখন লাভ কম। কয়দিন এ কাজ চালাতে পারব জানি না। বাপ-দাদা করত, তাই আমিও করি। এ কাজটাই মন দিয়ে শিখেছি, আর কিছু পারি না।'
প্রজন্মের বোঝা বয়ে চলেন তারা
দিলীপ কুমারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এগোলাম আরেক তাবিজ কারিগরের বাড়ির দিকে। পথ দেখালো এলাকার ছোট বাচ্চারা।
বাড়িতে ঢুকতেই উঠানে বসে থাকা একজন অশীতিপর বৃদ্ধকে দেখলাম। তার নাম সিরাজুল হক। বয়স আশির কোঠায়।
তিনি প্রায় ৫০ বছর ধরে তাবিজ তৈরি করছেন। জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি তাবিজ বানিয়েই কাটিয়েছেন।
স্বাধীনতার আগেই বাবার হাত ধরে এ পেশায় আসেন সিরাজুল। শৈশব থেকেই দাদাকেও একই কাজ করতে দেখেছেন। এখন তার ছেলেরাও তাবিজ বানায়।
সিরাজুল হক বলেন, 'বাবা, আমি তো এক জীবন পার করলাম এই কাজ করে। আগে মানুষে সম্মান দিত, তাবিজে বিশ্বাস করত।'
এখন দিন যত যাচ্ছে, তাবিজের দাম তত কমছে। বিশ বছর আগেও এক মাসে তাবিজ বানিয়ে যত আয় হতো, এখন তার তিন ভাগের এক ভাগও আসে না।
'বাপ-দাদার এ কাজ কোনোদিন ছাড়তে পারিনি। রক্তে ঢুকে গেছে সাম্বুর [তাবিজের আঞ্চলিক নাম] কাজ। এখন দিন আনি দিন খাইয়ের মতো অবস্থা হয়ে গেছে আমাদের,' বলেন সিরাজুল।
মানুষ আজকাল তাবিজ কম মানে। 'খারাপ কাজে' তাবিজ ব্যবহার করে। সিরাজুল আক্ষেপ করে বলেন, 'আমরা তো আর খারাপ কাজের নিয়তে তাবিজ বানাই না। তাবিজ তো লোহার টুকরা! খারাপ মানুষের মধ্যে আছে, তাবিজের মধ্যে না।'
সিরাজুল হকের বাড়ির পাশেই তার বড় ছেলে মোহাম্মদ সেলিম পরিবার নিয়ে থাকেন। তাবিজের কাজ দেখতে এসেছি শুনে তিনি খুশি হয়ে ডেকে নিয়ে গেলেন ঘরের ভেতরে।
তার স্ত্রী ঝর্ণা বেগম তখন তাবিজ বানাচ্ছিলেন। সেলিম বসে পড়লেন তক্তা আর হাতুড়ি নিয়ে। মেশিনের মতো তার হাত চলতে শুরু করল। পাত কাটেন আর হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে তাবিজের রূপ দেন।
কাজ শেষে পরের ধাপের কাজ করেন ঝর্ণা। কোড়া আর চান্দাইড় লাগিয়ে সুতা পেঁচিয়ে তাবিজগুলো জমিয়ে রাখছেন একটি পাত্রে। পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের ছোট ছেলে তানভীর। আনমনে বাবা-মায়ের কাজ দেখছে সে।
তানভীরকে জিজ্ঞেস করলাম, সে বড় হয়ে কী হতে চায়। এককথায় উত্তর, 'পুলিশ!'
মোহাম্মদ সেলিম ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, 'আমরা তিন পুরুষ ধরে এ কাজ করছি। কিন্তু আমার ছেলে এ কাজে আসে, সেটা আমি চাই না।'
আয় দিন দিন কমছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'সরকারও আমাদের কোনো খোঁজখবর নেয় না।'
ছেলেকে অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন সেলিম। 'আমি চাই তারা ভালো কিছু হোক। তাবিজের কাজ আমাদের দিয়েই শেষ হোক।'
সেলিমের কাছ থেকেই জানতে পারলাম, ঢাকার কিছু জায়গায় এখন অটোমেটিক মেশিন দিয়ে তাবিজ বানানো হয়। কিন্তু তাতে খরচ বেশি।
তাই 'তাবিজ গ্রাম' থেকেই বেশি তাবিজ যায়। মহাজনরা এখান থেকে কম পয়সায় বেশি তাবিজ কিনতে পারেন পাইকারি হারে।
কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেটসহ দেশের নানা এলাকা থেকে লোকজন এসে এখান থেকে তাবিজ কিনে নিয়ে যান।
আবার, এ গ্রাম থেকে অনেকেই ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় হেঁটে হেঁটে তাবিজ বিক্রি করেন। সব মিলিয়ে এই তিন গ্রামের তাবিজ কারিগরেরা ভালো অবস্থায় নেই।
তারা মনে করেন, প্রজন্ম ধরে এই পেশায় আসতে না হলে তারা এ কাজ করতেন না। তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও তারা এ পেশায় আনতে চান না।
ঝর্ণা বেগম বলেন, 'আমার মতো একজন মহিলা শহরে গিয়ে মানুষের বাসায় কাজ করে এর থেকে বেশি টাকা আয় করতে পারে।
'বৃষ্টি-বাদলের দিনে আমাদের কাজ থেমে থাকে। আপড় দিতে পারি না, কাজ কম হয় তখন। কাজ কম মানে ইনকামও কম।'
তাবিজ বানানোর কাজকে একটা শিল্পও বলা যায়। কিন্তু ধর্মীয় আবেগের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে এটিকে কখনোই সরকারিভাবে কুটির শিল্পের আওতাভুক্ত করা হয়নি।
নারায়ণগঞ্জের এ তিন গ্রামের মানুষের একটাই চাওয়া — দেশের অন্যান্য কুটির শিল্পের মতো তাদের কাজকেও যেন স্বীকৃতি দেওয়া হয়।