২ বছরে ১,০৪৬ কোটি টাকা লোকসান, প্রথমবারের মতো লভ্যাংশ দিতে ব্যর্থ ডেসকো
গেল টানা দুই অর্থবছরে বাল্ক বা পাইকারি এবং খুচরা বিদ্যুতের শুল্ক বৃদ্ধির অসমতার পাশপাশি ডলার মূল্যের অস্থিরতায় লোকসানে পড়েছে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো)।
খুচরা পর্যায়ে গ্রাহকদের বিদ্যুৎসেবা প্রদানকারী এক সময়ের শক্তিশালী ও লাভজনক রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানিটি ২০২৩ অর্থবছরে ৫৪১ কোটি টাকা এবং ২০২৪ অর্থবছরে ৫০৫ কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়েছে।
ফলে কোম্পানিটির রিটেইন্ড ইনকাম বা আয় নেতিবাচক ধারায় পৌঁছেছে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির পর প্রথমবারের মতো প্রতিষ্ঠানটি তার শেয়ারহোল্ডারদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি। ডেসকোর ৬৭.৬৬ শতাংশ শেয়ার সরকারের এবং বাকি ৩২.৩৪ শতাংশের মালিকানা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে।
মঙ্গলবার প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার দর ৫.৯১ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে; এদিন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) প্রতি শেয়ারের দাম ২২.৩০ টাকায় বন্ধ হয়।
লোকসানের বিষয়ে জানতে চাওয়ার পর বাল্ক ও গ্রাহক পর্যায়ের বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির একটি হিসাব দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে দিয়েছে ডেসকোর অর্থ বিভাগ।
এতে বলা হয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ক্রমযোজিত হারে পাইকারি পর্যায়ে ২৯.৬৯ শতাংশ এবং খুচরা পর্যায়ে ১৫.৭৬ শতাংশ বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়।
বিদ্যুতের মূল্য পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বৃদ্ধি এবং ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে ৪২৮ কোটি টাকা ফরেন এক্সচেঞ্জ লস (বৈদেশিক বিনিময় হার সংক্রান্ত ক্ষতি) হওয়ায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে ডেসকোর নিট লোকসান হয়েছে ৫৪৩ কোটি টাকা।
অন্যদিকে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নতুন করে পাইকারি পর্যায়ে ৫ শতাংশ ও খুচরা পর্যায়ে ৮ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি করার পর, ক্রমযোজিত হারে পাইকারি পর্যায়ে মোট মূল্যবৃদ্ধি দাঁড়ায় ৩৬.১৭ শতাংশ এবং খুচরা পর্যায়ে দাঁড়ায় ২৫.০২ শতাংশ। এর সাথে নতুন করে ডলারের মূল্য ৯.২৬ টাকা বৃদ্ধিজনিত কারণে ২৪৩ কোটি টাকা একচেঞ্জ লস হওয়ায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে লোকসান হয় ৫০৫ কোটি টাকা।
ডেসকোর অর্থবিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ নবা করার শর্তে জানান, বড় লোকসানের মূল কারণ বিদ্যুতের বাল্ক ট্যারিফ ও গ্রাহক পর্যায়ে সমানুপাতিক হারে দাম বৃদ্ধি না পাওয়া। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিদেশি ঋণ পরিশোধে বড় লোকসান হচ্ছে।
"বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড থেকে বাল্কে যে ট্যারিফে বিদ্যুৎ কেনা হয়, সেই তুলনায় কম দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করা হয়। যার কারণে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রিতে ডেসকোর লোকসান হয় ০.৫৬ টাকা," বলেন তিনি।
টিবিএসকে দেওয়া ডেসকোর ওই হিসাবে বলা হয়— হুইলি চার্জ, ডিস্ট্রিবিউশন কস্টসহ প্রতি ইউনিটে ব্যয় ১০.৮৫ টাকা; কিন্তু প্রতি ইউনিটের বিক্রয়মূল্য ১০.২৯ টাকা। অর্থাৎ, প্রতি ইউনিট বিক্রি থেকে ডেসকোর লোকসান হয় ০.৫৬ টাকা।
বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে ডেসকো বলছে, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে পাইকারি পর্যায়ে ২০.০৮ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির পর ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে পুনরায় পাইকারি মূল্য ৮ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়।
২০২৩ সালে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ— এই তিন মাসে প্রতিবার ৫ শতাংশ করে ক্রমযোজিত হারে খুচরা পর্যায়ে মোট ১৫.৭৬ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছিল।
ডেসকোর উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, "সরকারের নীতি সিদ্ধান্তের কারণেই ডেসকোর আর্থিক অবস্থা দূর্বল হয়ে পড়ছে। সরকারি এই কোম্পানিটি ২০০৬ সালে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর এবারই কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি। সাধারণ বিনিয়োগকারীর স্বার্থে সরকার নতুন কোনো সিদ্ধান্ত না নিলে লোকসানের পাল্লা আরও বাড়বে।"
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, "পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির বিনিয়োগকারীর কথা বিবেচনায় বিগত সরকার গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম সমন্বয় কিংবা বাল্ক বিদ্যুতের দাম কমানোর আশ্বাস দিয়েছিল। তবে ওই সরকার পরিবর্তন হয়ে যাওয়ায়, সেই উদ্যোগও এখন থমকে গেছে।"
২০২৪ অর্থবছরের বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুসারে, ডেসকোর বিদ্যুৎ সরবরাহ থেকে রাজস্বের (নেট অফ ভ্যাট) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬,৬২৫ কোটি টাকা— যা এক বছর আগে ছিল ৫,৩৭২ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ ক্রয়ের অর্থ পরিশোধের পর, এর বিতরণযোগ্য রাজস্ব দাঁড়ায় ৩৬৫ কোটি টাকায়— যা আগের বছরের ২৬৮ কোটি টাকার চেয়ে বেশি।
এছাড়া, অন্যান্য অপারেটিং রেভেনিউ থেকে ডেসকোর আয় হয়েছে ১৭৯ কোটি টাকা। যার ফলে প্রতিষ্ঠানটির মোট অপারেটিং রেভেনিউ ২৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৫৩৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ অর্থবছরে জ্বালানি বিক্রির খরচ ৩.৬২ শতাংশ কমে ৩২৫ কোটি টাকা হয়েছে।
ফলে ২০২৪ অর্থবছরে ডেসকোর নিট লোকসান হয়েছে ৫০৫ কোটি টাকা। এই ক্ষতির সিংহভাগই ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ার কারণে হয়েছে বলে জানা গেছে। কারণ কোম্পানির বিদেশি ঋণের পরিমাণই ২,৭৪৮ কোটি টাকা। ডলারের দাম ওঠানামায় ২৪৩ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে; আগের অর্থবছরে এই লোকসানের পরিমাণ ছিল ৪২৮ কোটি টাকা।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকে ডেসকো। ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছর থেকে ২০০১-০২ অর্থবছর পর্যন্ত লোকসানের পর, তখন থেকে ২০২২ অর্থবছর পর্যন্ত টানা ২০ বছর মুনাফায় ছিল কোম্পানিটি।
২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত, ডেসকোর গ্রাহক সংখ্যা বেড়ে ১২.৭৯ লাখে দাঁড়ায়— যা এক বছর আগের ১২.৪০ লাখ ছিল।
এছাড়া, ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ডেসকোর সিস্টেম লস কমে ৫.৫৮ শতাংশ হয়েছে— আগের অর্থবছরে যা ছিল ৫.৭২ শতাংশ।