সর্বজনীন পেনশন আরও আকর্ষণীয় করতে যুক্ত হচ্ছে এককালীন গ্র্যাচুইটি ও স্বাস্থ্য বিমা সুবিধা
গত বছরের আগস্টে চালু হওয়া সর্বজনীন পেনশনে জনগণকে আকৃষ্ট করতে ৬০ বছর বয়স থেকে মাসিক পেনশন সুবিধার বাইরে গ্র্যাচুইটি হিসেবে এককালীন মোটা অঙ্কের অর্থ পরিশোধ করার সুবিধা যুক্ত করতে যাচ্ছে সরকার। এছাড়া সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার আওতায় স্বাস্থ্যবিমার সুবিধাও অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।
গত ১৪ অক্টোবর পেনশন পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাকে জনপ্রিয় করার জন্য এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে
বিষয়টি সম্পর্কে জানে, এমন সূত্র জানিয়েছে, গ্র্যাচুইটি বাবদ পেনশনারদের কী পরিমাণ অর্থ এককালীন পরিশোধ করা হবে, সেক্ষেত্রে মাসিক পেনশনের পরিমাণ কী পরিমাণ কমবে—তা বিশ্লেষণের কাজ শুরু করেছে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ।
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. গোলাম মোস্তফা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাকে আরও জনপ্রিয় করতে গ্র্যাচুইটি যুক্ত করার বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। ভারতসহ অনেক দেশে এককালীন গ্র্যাচুইটি দেওয়ার বিধান রয়েছে।'
বাংলাদেশে সরকারি চাকরিজীবীরা মাসিক পেনশন পাওয়ার পাশাপাশি গ্র্যাচুইটি সুবিধাও পেয়ে থাকেন। তবে সব নাগরিকের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সি ব্যক্তিদের জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করা হয়েছে। এই স্কিমের সদস্যরা ৬০ বছর বয়স থেকে পেনশন পেতে শুরু করবেন।
এই স্কিমে চারটি প্যাকেজ রয়েছে—প্রবাসীদের জন্য 'প্রবাসী', বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীদের জন্য 'প্রগতি', অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত ব্যক্তিসহ স্বনির্ভর কর্মী ও দিনমজুরদের জন্য 'সুরক্ষা', এবং নিম্ন আয়ের ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য 'সমতা'।
গোলাম মোস্তফা বলেন, এককালীন গ্র্যাচুইটি সুবিধা যুক্ত করা হলে মাসিক পেনশনের পরিমাণ কমে যাবে। 'যেহেতু সর্বজনীন পেনশনারদের মূল বেতন বলে কিছু নেই, তাই এককালীন গ্র্যাচুইটি হিসেবে তাদের জমা দেওয়া চাঁদার একটি অংশ পরিশোধ করতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'অন্যান্য দেশ কীভাবে গ্র্যাচুইটি পরিশোধ করছে, সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অর্থ উপদেষ্টার সম্মতিক্রমে তা উপদেষ্টা পরিষদের সভায় উপস্থাপন করা হবে। উপদেষ্টা পরিষদ সম্মতি দিলে এককালীন গ্র্যাচুইটি পরিশোধের বিধান যুক্ত করা হবে। তবে গ্র্যাচুইটি বাবদ এককালীন অর্থ দেওয়ার বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি।'
ভারতের আদলে বাংলাদেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা হলেও বিগত শেখ হাসিনার সরকার গ্র্যাচুইটি সুবিধা ও অন্যান্য কিছু সুবিধা অন্তর্ভুক্ত করেনি।
ভারত সরকার ২০০৪ সালের ১ জানুয়ারি ন্যাশনাল পেনশন সিস্টেম চালু করে। ভারতের পেনশন ব্যবস্থায় নাগরিকদের মাসিক পেনশন সুবিধার বাইরেও গ্র্যাচুইটি বাবদ এককালীন অর্থ পরিশোধ করা হয়।
ভারতের মডেল বাংলাদেশে এসে বদলে গেল
বাংলাদেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করার আগে অর্থ বিভাগের একটি প্রতিনিধিদল ভারত সফর করে দেশটির পেনশন ব্যবস্থা সম্পর্কে তথ্য নিয়ে আসে। কিন্তু সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভারত সফরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগায়নি বিগত সরকার।
ভারত ২০০৪ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের (সামরিক বিভাগের কর্মচারী বাদে) ন্যাশনাল পেনশন সিস্টেমে অন্তর্ভুক্তি বাধ্যতামুলক করে। ২০০৯ সালের ১ মে থেকে ১৮-৬০ বছর বয়সি সব ভারতীয় নাগরিকের জন্য এই স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হওয়া বাধ্যতামুলক করা হয়। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতের করপোরেট প্রতিষ্ঠানের জন্য নতুন পেনশন পদ্ধতি উন্মুক্ত করা হয়।
কিন্তু বাংলাদেশে শুরুতে বেসরকারি খাত ও দরিদ্রদের জন্য পেনশন স্কিম চালুর পর বিশ্ববিদ্যালয়সহ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের 'প্রত্যয়' স্কিম চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়। পরের বছর থেকে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য আরেকটি স্কিম চালুর ঘোষণা ছিল ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে।
তবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে প্রত্যয় স্কিম বাতিল করা হয়।
ভারতের পেনশন স্কিমের অর্থ উত্তোলন ও স্কিম থেকে প্রস্থান করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে, যা বাংলাদেশের সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
ভারতের পেনশন ব্যবস্থায়ও ৬০ বছর বয়স থেকে মাসিক পেনশন পাওয়ার বিধান রয়েছে। তবে কেউ পেনশন বয়সে উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই স্কিম থেকে প্রস্থান নিতে চাইলে পুঞ্জীভূত পেনশন সঞ্চয়ের কমপক্ষে ৮০ শতাংশ অর্থ সরকারি খাতে বিনিয়োগ রেখে বাকি ২০ শতাংশ অর্থ এককালীন তুলতে পারেন।
পেনশন বয়সে উত্তীর্ণ হওয়ার পর কেউ তার পুঞ্জীভূত পেনশন সঞ্চয়ের কমপক্ষে ৬০ ভাগ সরকারি খাতে বিনিয়োগ রেখে বাকি ৪০ শতাংশ অর্থ এককালীন তুলতে পারেন। আর পেনশন বয়সে উত্তীর্ণ হওয়ার আগে গ্রাহকের মৃত্যু হলে শতভাগ অর্থ নমিনি উত্তোলন করতে পারেন।
আর পেনশন বয়সে উত্তীর্ণ হওয়ার পরে গ্রাহকের মৃত্যু হলে ক্রয়কৃত 'অ্যানিউইটি' সেবার সব সুবিধা গ্রাহকের নমিনি আমৃত্যু ভোগ করতে পারবেন।
কিন্তু বাংলাদেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় গ্রাহককে এককালীন কোনো অর্থ দেওয়ার বিধান তো রাখা হয়ইনি, উল্টো গ্রাহক পেনশন বয়সে উত্তীর্ণ হওয়ার পর মারা গেলে গ্রাহকের বয়স ৭৫ হওয়া পর্যন্ত নমিনি পেনশন পাবেন।
অর্থাৎ ভারতে কোনো পেনশনার ৬০ বছর বয়সে উত্তীর্ণ হওয়ার পর মারা গেলে তার পেনশন সঞ্চয়ের ৬০ ভাগ দিয়ে কেনা অ্যানিউইটি থেকে যে মুনাফা আসবে, তা তার নমিনি আজীবন ভোগ করতে পারবেন। কিন্তু বাংলাদেশে নমিনি এ সুবিধা ভোগ করতে পারবেন পেনশনারের বয়স ৭৫ বছর হওয়ার আগপর্যন্ত। অর্থাৎ নমিনি সর্বোচ্চ ১৫ বছর এ সুবিধা পাবেন।
ভারতের ন্যাশনাল পেনশন সিস্টেমে ৬০ বছর বয়সে উত্তীর্ণ হওয়ার পরও গ্রাহক যদি তার সঞ্চয় উত্তোলন না করেন, তাহলে গ্রাহকের বয়স ৭০ বছর উত্তীর্ণ হলে তার পেনশন হিসাব বন্ধ হয়ে যাবে এবং তার সমস্ত প্রাপ্য সুবিধা এককালীন গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্থানান্তরিত হবে। বাংলাদেশের সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় এ সুবিধাও রাখা হয়নি।
এছাড়া বাংলাদেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় সুদহারও অনেক কম। সরকারি চাকরিজীবীদের জেনারেল প্রভিডেন্ট ফান্ডে সুদহার ১৩ শতাংশ এবং সঞ্চয়পত্রে সুদহার ১১ শতাংশের বেশি হলেও সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় সুদহার মাত্র ৮ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
সুবিধা কম থাকায় জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা
ভারতসহ বিভিন্ন দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় সুবিধা কম থাকায় মানুষ আকৃষ্ট হচ্ছে না।
গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তাড়াহুড়া করে ২০২৩ সালের ১৭ আগস্ট চারটি স্কিম নিয়ে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করে সরকার। সরকারের দিক থেকে বিষয়টি ফলাও করে প্রচারের চেষ্টা করা হলেও গত ১৪ মাসে জনগণকে আকৃষ্ট করতে পারেনি স্কিমগুলো।
এখন পর্যন্ত সর্বজনীন পেনশনের সবগুলো স্কিমে নিবন্ধন করেছেন মাত্র ৩ লাখ ৭২ হাজার ৩৭৮ জন মানুষ। এর মধ্যে শুধু সমতা স্কিমে নিবন্ধন করেছেন ২ লাখ ৮৫ হাজার ৮৮৪ জন।
মূলত প্রবাসী ও বেসরকারি খাতে নিয়োজিতদের আকৃষ্ট করতে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা হলেও স্কিমগুলো তাদের আকৃষ্ট করতে পারছে না।
সমতা ছাড়া প্রবাসী ও বেসরকারি খাতে নিয়োজিতদের জন্য চালু করা বাকি তিনটি স্কিমে নিবন্ধনকারীর সংখ্যা মাত্র ৮৬ হাজার ৪৯৪ জন। এদের মধ্যে অনেকে নিবন্ধন করে দু-এক মাস কিস্তি পরিশোধ করার পর আর কিস্তি দিচ্ছেন না।
সরকারের নীতিনির্ধারকরা আশা করেছিলেন, সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় প্রবাসীদের বিপুল আগ্রহ দেখা যাবে। কিন্তু প্রবাস স্কিমে অন্তর্ভুক্তির হারই সবচেয়ে হতাশাজনক। গত ১৪ মাসে এই স্কিমে মাত্র ৯১০ জন প্রবাসী অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।
বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীদের জন্য প্রগতি স্কিমে নিবন্ধন করেছেন ২২ হাজার ৪১০ জন ও অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত বা স্বকর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য সুরক্ষা স্কিমে ৬৩ হাজার ১৭৪ জন নিবন্ধন করেছেন।
সমতা স্কিম অতিদরিদ্রদের জন্য। এই স্কিমে অংশগ্রহণকারীদের মাসিক চাঁদার পরিমাণ ১ হাজার টাকা, যার মধ্যে নিবন্ধনকারী ৫০০ টাকা ও সরকার ৫০০ টাকা পরিশোধ করে। অতিদরিদ্রদের জন্য হলেও সরকার থেকে প্রতি মাসে ৫০০ টাকা হারে চাঁদা পাওয়ার লোভে এই স্কিমে অন্যান্যরাও ঢুকে পড়ছেন।
অর্থ সচিব মো. খায়রুজ্জামান মজুমদার টিবিএসকে বলেন, সমতা স্কিমে নিবন্ধনকারীদের তালিকা যাচাই করা হবে। এর মধ্যে যারা অতিদরিদ্র নয় বা এই স্কিমে যুক্ত হওয়ার অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন, তাদেরকে সমতা স্কিম থেকে বের করে অন্য স্কিমে স্থানান্তর করা হবে।