অবৈধভাবে দখল: হাসিনার পতনের পর ৮৭৬ কোম্পানি ফেরত পেলেন আগের মালিকেরা
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ১৫ বছরে অবৈধভাবে দখল করা ৮৭৬টি কোম্পানি তাদের সাবেক মালিকদের কাছে ফেরত দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসি)।
২০ আগস্ট থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত আরজেএসসি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারের জন্য তিন হাজার ৭৫৩টি আবেদন গ্রহণ করেছে। বেশিরভাগ কোম্পানি ছোট থেকে মাঝারি আকারের, যেগুলোর সম্মিলিত বিনিয়োগ প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
আরজেএসসির রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত সচিব) মিজানুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেছেন, 'গত এক মাসে যে পরিমাণ আবেদন আরজেএসসিতে জমা পড়েছে, সেটি একেবারেই নজিরবিহীন।'
তিনি আরও বলেন, 'আরজেএসসি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এত অভিযোগ মাত্র দুমাসে জমা পড়ার ইতিহাস নেই। আমরা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছি। অন্যায়ভাবে যে-সব কোম্পানি দখল করা হয়েছে, সেগুলোর যথাযথ প্রতিকার দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।'
বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ টিবিএসকে বলেন, 'গত ১৫ বছরের শাসনামলে এরকম অনেক বেআইনি ঘটনা ঘটেছে। বিদেশি কোম্পানি দখলেরও ঘটনা ঘটেছে। সরকার স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ সমস্যাগুলোর সমাধানে কাজ করছে, কারণ বেসরকারি খাতই অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি।'
আরজেএসসির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আবেদনকারীরা দাবি করেছেন তাদের ব্যবসা, নেতৃত্ব (চেয়ারম্যান/এমডির পদ) অথবা কোম্পানির শেয়ারের মালিকানা ২০০৯ সাল থেকে এ বছরের জুলাই পর্যন্ত অবৈধভাবে প্রভাব খাটিয়ে দখল করা হয়েছে।
'তদন্ত শেষে ইতোমধ্যে ৮৭৬টি কোম্পানির মালিকানা, ব্যবস্থাপনা এবং শেয়ার সাবেক মালিকদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে,' ওই কর্মকর্তা জানান।
তিনি আরও বলেন, বাকি আবেদনগুলো এখনো প্রক্রিয়াধীন। ৩০০টি আবেদন আইনি প্রক্রিয়াধীন থাকায় আরজেএসসি সেগুলো নিষ্পত্তি করতে পারেনি। হাইকোর্ট এবং নিম্ন আদালতের রায়ের ভিত্তিতে আরজেএসসি এ কোম্পানিগুলোর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
গাজীপুরের কালিয়াকৈরে অবস্থিত দ্য অ্যাডভেঞ্চার পলিমার অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান। ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত এ কোম্পানি ওষুধ এবং তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্যের প্যাকেজিংয়ের জন্য উচ্চ মানের মোড়ক, বাক্স, কার্টন, লেবেল এবং সিন্থেটিক পলিমার উৎপাদন করে।
তিন বন্ধুর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এ কোম্পানি ২০১০ সালের মধ্যে ১৫০ কোটি টাকার বার্ষিক টার্নওভারে পৌঁছায়।
কোম্পানির চেয়ারম্যান আসিফুর রহমান জানান, ২০১০ সালের নভেম্বরে কালিয়াকৈর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা পরিচয়দাতা ওমর ফারুক একজন মন্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে কোম্পানিটির পরিচালক বনে যান।
আসিফুর রহমান অভিযোগ করেন, '২০১১ সালের মার্চ মাসে ভুয়া রেজুলেশন বানিয়ে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হন ওমর ফারুক। পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে পুরাতন সব পরিচালক ও শেয়ারহোল্ডারদের বের করে দিয়ে অস্ত্রের মুখে পুরো কোম্পানির কারখানা ও অফিস দখলে নেন ওমর ফারুক।'
তিনি বলেন, '২০১১ সালে আমাদের ওপর কয়েক দফা হামলা করা হয় এবং প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দেয়। এরপর ভুয়া রেজুলেশন বানিয়ে কোম্পানির পুরো মালিকানা পরিবর্তন করে ওমর ফারুক নিজের নামে সব করে নেন। আমরা একেবারে অসহায় ও নিঃস্ব হয়ে পড়ি। থানায় অভিযোগ, কোর্টে মামলা করেও কোনো ফল পাইনি।'
'উল্টো আমাদের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা, চুরি ও ডাকাতির পৃথক ৬টি মামলা দিয়ে এলাকা ছাড়তে বাধ্য করে। পুলিশ দিয়ে বাড়িতে দফায় দফায় অভিযান পরিচালনা করে আমাদের বিপর্যস্ত করে তোলে,' বলেন আসিফুর।
তিনি বলেন, ওমর ফারুকের পেছনে শক্তি হিসেবে তৎকালীন একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী সকল সহায়তা করেছেন। 'ফলে আমরা কারও কাছে গিয়ে কোনো সহায়তা পাইনি এবং আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে।'
আসিফুর জানান, ৫ আগস্ট ক্ষমতার পরিবর্তনের পর ফারুকও আত্মগোপনে চলে যান। 'আমরা স্থানীয় সাধারণ মানুষ ও পুলিশের সহায়তায় ১০ আগস্ট কোম্পানিটি পুনরুদ্ধার করি। এরপর কোম্পানির মালিকানা আমাদের নামে ফিরে পেতে আরজেএসসি-তে আবেদন করি এবং একইসঙ্গে এক হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ চেয়ে গাজীপুর আদালতে মামলা করেছি।'
আরজেএসসি-এর এক কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, আসিফুর এবং তার সহযোগী শেয়ারহোল্ডাররা আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে মালিকানা পুনরুদ্ধারের আবেদন করেন। তদন্তের পর তাদের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
তিনি আরও জানান, 'তদন্তে দেখা গেছে, ওই কোম্পানি জোর করে দখল করার অভিযোগ সত্য এবং যে দুটি রেজুলেশনের মাধ্যমে কোম্পানিটি স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা দখল করেন, সেগুলো ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়েছে।'
তবে জোর করে কোম্পানিটি দখলের অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করেছেন আত্মগোপনে থাকা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ওমর ফারুক। হোয়াটসঅ্যাপে কল দিলে তিনি বলেন, 'সকল আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই কোম্পানির মালিক হয়েছি আমরা।' এটুকু বলেই তিনি কল কেটে দেন।
গ্লোব এডিবল অয়েল লিমিটেডের ঘটনা একই রকম। গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালস গ্রুপ ২০১৪ সালে দেড় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করলেও চট্টগ্রামের একটি শক্তিশালী ব্যবসায়ী গ্রুপের প্রভাবের কারণে কারখানাটি উৎপাদন শুরু করতে পারেনি।
২০২২ সালে ওই ব্যবসায়ী গ্রুপটি জোরপূর্বক কোম্পানির বেশিরভাগ অংশ অধিগ্রহণ করে বলে অভিযোগ ওঠে। পরবর্তীসময়ে গ্লোব এডিবল অয়েল লিমিটেডের নাম পরিবর্তন করে গ্লোব রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ রাখা হয়।
আরজেএসসি-এর কর্মকর্তারা জানান, ৫ আগস্ট ক্ষমতার পরিবর্তনের পর গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালস নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে অবস্থিত কোম্পানিটির সম্পূর্ণ মালিকানা পুনরুদ্ধার করেছে। কোম্পানির একজন কর্মকর্তা জানান, তারা এখন পাঁচ ধরনের ভোজ্যতেল উৎপাদনের লক্ষ্যে কাজ করছে।
কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ শাহ মো. আহসানুর রহমান বলেন, কোনো কোম্পানির নিবন্ধন, অবসায়ন, মালিকানা হস্তান্তর, শেয়ারহোল্ডার অনুমোদনসহ নানা কাজ করে আরজেএসসি। তিনি বলেন, 'কোনো কোম্পানির মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা পরিবর্তনের জন্য আরজেএসসি থেকে অনুমোদন নিতে হয়। এ অনুমোদনই কোম্পানি পরিচালনার ভিত্তি। যেসব কোম্পানি অবৈধভাবে দখল হয়েছে, সেগুলোর বিষয়ে অভিযোগ পেলে আরজেএসসি আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে।'
আরজেএসসি-এর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন কোম্পানির মালিকানা পরিবর্তনের জন্য ৬৩৩টি আবেদন জমা পড়েছে।
তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে মোট এক হাজার ৭২৩টি কোম্পানি মালিকানা পরিবর্তন করেছে। ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৩৮২। ২০২১ সালে দুই হাজার ৬৬৩টি কোম্পানি হাতবদল হয়েছে। আর ২০২০ সালে দুই হাজার ৭৭টি কোম্পানির মালিকানা পরিবর্তিত হয়েছিল।
গত ১৫ বছরে কতটি কোম্পানি অবৈধভাবে দখল হয়েছে সে তথ্য আরজেএসসি-এর কাছে নেই। দেশে মোট নিবন্ধিত কোম্পানি রয়েছে প্রায় দুই লাখ ৮৮ হাজার।