বৈদেশিক ঋণছাড়ের চেয়ে ঋণ পরিশোধ বেশি, প্রতিশ্রুতিও কম
বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ প্রতিশ্রুতি কমেছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বৈদেশিক ঋণ প্রতিশ্রুতি চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৯৯ শতাংশ কমে গেছে।
একই সময়ে উন্নয়ন সহযোগীরা যে পরিমাণে ঋণের অর্থছাড় করেছে, তার চেয়ে বেশি ঋণ পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ।
ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বৈদেশিক ঋণের অর্থায়নে প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলো নতুন করে পর্যালোচনা করছে। এতে নতুন ঋণচুক্তি হচ্ছে না বলে প্রতিশ্রুতিও কমেছে।
আবার বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন ধীর হয়ে গেছে বলে প্রকল্প বাস্তবায়নও কমেছে। অন্যদিকে বিগত সরকারের নেওয়া অনেক বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সময়ে শুরু হয়ে যাওয়ার কারণে ঋণ পরিশোধ বেড়েছে।
ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক মোস্তফা কে মুজেরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেছেন, 'বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। এ কারণে বৈদেশিক ঋণ পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি প্রত্যাশা অনুযায়ী এগোচ্ছে না।'
তিনি আরও বলেন, 'সরকার প্রকল্প প্রস্তাবগুলোও পর্যালোচনা করছে, যার ফলে বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি কমে যাচ্ছে। তবে কিছু উন্নয়ন সংস্থা প্রকল্প ঋণ ও বাজেট সহায়তা দেওয়া ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। এই পরিস্থিতিতে বৈদেশিক ঋণের প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো ত্বরান্বিত করা প্রয়োজন।'
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী চলতি, অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি এসেছে মাত্র ২৭.৪১ মিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে প্রতিশ্রুতির পরিমাণ ছিল ২.৮৮ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে জুলাই-সেপ্টেম্বরে উন্নয়ন সহযোগীরা ঋণছাড় করেছে ৮৪৬.১২ মিলিয়ন ডলার। আর এ সময়ে বাংলাদেশ ঋণ পরিশোধ করেছে ১.১২৬ বিলিয়ন ডলার।
ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থানের সময়ই ঋণছাড় এভাবে কমে গেছে। এছাড়া বর্তমানে সরকার বৈদেশিক অর্থায়নের প্রস্তাবিত সব প্রকল্প পুনরায় পর্যালোচনা করছে। এ কারণে উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে ঋণচুক্তি নিয়ে পুনরায় আলোচনা হচ্ছে।
ইআরডি কর্মকর্তারা আরও বলেন, সরকার ঋণ প্রস্তাব পুনর্মূল্যায়ন করেছে। পর্যালোচনা সম্পন্ন হলে ঋণ আবেদন প্রক্রিয়া শুরু হবে। সরকার আশাবাদী, প্রতিশ্রুতি আদায়ের লক্ষ্য অর্জন করা যাবে।
৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করার পর থেকে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ (এডিবি) বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগীরা নানা প্রকল্পের জন্য ঋণ সহায়তা ও বাজেট সহায়তার প্রাথমিক আশ্বাস দিয়েছে। আগের অর্থবছরগুলোর তুলনায় এখন বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে উল্লেখ করেন ইআরডি কর্মকর্তারা।
অন্তর্বর্তী সরকার চলমান, প্রস্তাবিত বা আলোচনাধীন সমস্ত বৈদেশিক অর্থায়নের প্রকল্প পুনরায় পর্যালোচনা শুরু করেছে। এ পর্যালোচনার উদ্দেশ্য, অগ্রাধিকার পাওয়ার মতো প্রকল্পগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর বাস্তবায়ন শুরু করা এবং অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলো বাতিল করা। ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, বিদেশি অর্থায়নের প্রকল্পগুলোর গুরুত্ব মূল্যায়ন, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলো বাতিল ও বৈদেশিক ঋণের বরাদ্দে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন অগ্রাধিকার তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির বৈঠকের পর পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, 'বৈদেশিক অর্থায়নের প্রকল্পগুলো বাছাইয়ের প্রক্রিয়া আমরা ত্বরান্বিত করব, কারণ আমাদের জরুরি ভিত্তিতে বৈদেশিক অর্থায়ন প্রয়োজন। বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প রয়েছে পাইপলাইনে। তবে সব বৈদেশিক অর্থায়নের প্রকল্পই যে কার্যকর, এই দাবি করা যাবে না।'
ঋণছাড়ের চেয়ে পরিশোধ বেশি
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ উন্নয়ন সহযোগীদের ছাড় করা অর্থের পরিমাণকে ছাড়িয়ে গেছে। এ সময়ে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাংলাদেশ ৮৪৬.১২ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে, কিন্তু ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধ করেছে ১.১২৬ বিলিয়ন ডলার।
ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, গণআন্দোলনের ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতা কিছু প্রকল্পের বাস্তবায়নে প্রভাব ফেলেছে। এ কারণে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ঋণছাড় কমেছে। তারা বলেন, সরকার পরিবর্তনের পর প্রশাসনিক ও উন্নয়ন কার্যক্রমে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এছাড়া অনেক বিদেশি ঋণের প্রকল্পে বিদেশি পরামর্শদাতা, ঠিকাদার ও কর্মচারী না থাকায় বিলম্ব হচ্ছে। এতে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি ধীর হয়ে গেছে। এ কারণেও ঋণের অর্থছাড় কমেছে।
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, জুলাই-সেপ্টেম্বরে বৈদেশিক সহায়তার অর্থছাড় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৪ শতাংশ কমেছে। এ সময়ে উন্নয়ন সহায়তা সংস্থাগুলো ৮৪৬.১২ মিলিয়ন ডলার ছাড় করেছে, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১,২৮১.৭২ মিলিয়ন ডলার।
ইআরডি কর্মকর্তারা আরও জানান, চীনের ঋণে পদ্মা রেল লিঙ্ক প্রকল্পের ঋণের আসল পরিশোধ বাড়ায় বৈদেশিক ঋণ পরিশোধও অনেকটা বেড়েছে। ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে বিদেশি ঋণ পরিশোধ গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৯ শতাংশ বেড়েছে। গত অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে বাংলাদেশ ৮৬০.৪৬ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে, তবে চলতি বছর তা বেড়ে ১,১২৬.৫১ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আসল পরিশোধ বেড়েছে ৩৯.৩ শতাংশ। এ সময়ে ৬৮৫.৫ মিলিয়ন ডলার আসল পরিশোধ করা হয়েছে; গত বছর একই সময়ে এ পরিমাণ ছিল ৪৯২ মিলিয়ন ডলার। সুদ পরিশোধও বেড়েছে। এ সময়ে সুদ পরিশোধ করা হয়েছে ৪৪১ মিলিয়ন ডলার, গত বছর এ পরিমাণ ছিল ৩৭৮.৪৬ মিলিয়ন ডলার।
জুলাই মাসে উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থছাড়ের পরিমাণ
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক সহায়তার অর্থছাড় করেছে জাপান, ২১০.৯৯ মিলিয়ন ডলার। এরপরই এডিবি ১৫৬.৭৫ মিলিয়ন ডলার, রাশিয়া ১৪৯.৩৬ মিলিয়ন ডলার, বিশ্বব্যাংক ৭৮.৪৪ মিলিয়ন ডলার ও ভারত ৪৫.২১ মিলিয়ন ডলার ছাড় করেছে।