জানুয়ারি–জুনে বিদেশে দক্ষ চাকরির তালিকায় শীর্ষ দশে ‘অ্যাকাউন্ট্যান্ট’ পদ
বিদেশে বাংলাদেশি অভিবাসীদের জন্য শীর্ষ ১০ চাকরির তালিকায় প্রথমবারের মতো জায়গা করে নিয়েছে অ্যাকাউন্ট্যান্ট বা হিসাবরক্ষক পদ। এই পদে চাকরি নিয়ে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে প্রায় ১৩,০০০ বাংলাদেশি বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিয়েছেন।
বিদেশে স্বচ্ছ অভিবাসনের অনলাইন-ভিত্তিক প্ল্যটফর্ম 'আমি প্রবাসী' অ্যাপের অর্ধ-বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে বোঝা যায়, বিদেশে দক্ষ বাংলাদেশি কর্মীর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।
যদিও জনশক্তি, কর্মসংস্থান এবং প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে— দক্ষ কর্মীর চাহিদা বাড়লেও বিদেশে স্বল্প-দক্ষতার চাকরি, যেমন– সাধারণ শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, কারখানা শ্রমিক, পরিচ্ছন্নতা কর্মী ইত্যাদি পদে চাকরি নিয়ে বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়ায় পাড়ি দেওয়া অভিবাসীদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়; এসব কাজই বিদেশি চাকরির বাজারে আধিপত্য বজায় রেখেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত উভয় দেশই অ্যাকাউন্ট্যান্ট পদে বাংলাদেশের দক্ষ জনশক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে। অর্থাৎ, সময়ের সাথে সাথে দক্ষ কর্মী সরবরাহের ক্ষেত্রে দেশগুলো বাংলাদেশের প্রতি তাদের ক্রমবর্ধমান আস্থার ইঙ্গিত দিচ্ছে।'
ইন্সটিটিউট অফ চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অফ বাংলাদেশের প্রাক্তন সভাপতি মাহমুদুল হাসান খসরু, এফসিএ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, অ্যাকাউন্ট্যান্টদের সম্ভাবনা শুধু মধ্যপ্রাচ্যে নয়, পশ্চিমা দেশেও ব্যাপকভিত্তিতে রয়েছে।
"বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রে গত ছয়মাসে আমাদের পরিচিত অনেক অ্যাকাউন্ট্যান্ট চাকরি পেয়েছেন। তবে এসব চাকরি ধরতে হলে অ্যাকাউন্টিং এর ওপর ডিগ্রির পাশাপাশি এই রিলেটেড ট্রেনিং এবং সফটওয়ার স্কিল ডেভেলপ করতে হবে," যোগ করেন তিনি।
অভিবাসীদের বেশিরভাগ যে ধরনের (ক্যাটাগরি) কর্মসংস্থান খুঁজেছেন, আমি প্রবাসী-এর প্রতিবেদনে কাজের ওই বিভাগগুলোও তুলে ধরা হয়েছে। অভিবাসী শ্রমিকদের প্রায় ৩০ শতাংশই 'সাধারণ' দক্ষতাসম্পন্ন ক্যাটাগরিতে পড়েন— এই ক্যাটাগরিতে সেমি-দক্ষ এবং স্বল্প-দক্ষ (এ ধরনের শ্রমিকদের সাধারণত অদক্ষ হিসাবে উল্লেখ করা হয়) কাজ রয়েছে।
৬৩,৪৬৯ জন অভিবাসী নিয়ে নির্মাণকাজ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে; আর কারখানার কাজ ৩৩,৭৪৮ জন অভিবাসী নিয়ে রয়েছে তৃতীয় স্থানে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, মোট অভিবাসীর মধ্যে ১০.৪ শতাংশকে দক্ষ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে; তাদের মধ্যে ৩.২ শতাংশ সফ্টওয়্যার ডেভেলপারের মতো পেশাদার হিসেবে কাজ করছেন।
চলতি ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন, যা বাংলাদেশ থেকে শক্তিশালী অভিবাসনের ইঙ্গিত দেয়। জানুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে প্রায় ২,৫০,০০০ কর্মী সৌদি আরবকে তাদের প্রাথমিক গন্তব্য হিসেবে বাছাই করেছেন।
সৌদি আরবে সাধারণ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীদের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এই সময়ের মধ্যে ১,১৮,৭৬১ জন অভিবাসী শ্রমিক সেদেশে গিয়েছেন।
মালয়েশিয়ায় যাওয়া শ্রমিকদের মধ্যে নির্মাণকাজ ছিল পছন্দের শীর্ষে; এই কাজে ৪৩,৭৯১ জন শ্রমিক সেখানে পাড়ি দিয়েছেন। এছাড়া, শীর্ষ গন্তব্যের তৃতীয় স্থানে রয়েছে কাতার; একই সময়ে এ দেশে পাড়ি দিয়েছেন ৩৯,৫১৭ জন অভিবাসী।
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ফ্যাকাল্টি সদস্য এবং একজন অভিবাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন সিকদার টিবিএসকে বলেন, "আমরা এখনো থ্রি-ডি (ডার্টি, ডেঞ্জারাস এবং ডিমিনিং) কাজের মধ্যে আটকে আছি। দক্ষ কাজের জন্য প্রথমত ইনফরমেশন অ্যাভেইলেবল করা এবং মানুষ কীভাবে সেগুলো পাবে সেটি যদি তরুণদের জানানো যায়, তাহলে তারা নিজেদেরকে সেভাবে প্রস্তুত করতে পারবে।"
কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর আধুনিয়াকনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, "পশ্চিমা যেসব দেশে স্কিলড ওয়ার্কারের (দক্ষ কর্মী) চাহিদা আছে, তাদের কাছে আমাদের টিটিসিগুলোকে আপগ্রেড করার জন্য দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলে তারা তাদের চাহিদা অনুযায়ী ট্রেডে কারিকুলাম ডেভেলপ করে লোক তৈরি করবে এবং চাকরি দেবে।"
গত বছর বাংলাদেশ রেকর্ড ১৩ লাখ কর্মী বিদেশে পাঠিয়েছে। এরমধ্যে অপ্রচলিত গন্তব্যে অভিবাসন বাড়ার ফলে সেমি-দক্ষ অভিবাসন ২২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে মোট অভিবাসনের মধ্যে ৫০ শতাংশ কর্মীই স্বল্পদক্ষ; যেখানে দক্ষ অভিবাসন প্রায় ২৫ শতাংশের মতো। এমনটিই উঠে এসেছে বিএমইটির তথ্যে।
শ্রম নিয়োগকারীদের মতে, সবচেয়ে চাহিদাপূর্ণ কাজের খাতগুলো হলো— ড্রাইভার, কেয়ার গিভার, গার্হস্থ্য কর্মী, ইলেকট্রিশিয়ান, সুপারভাইজার, রেফ্রিজারেটর এবং এয়ার কন্ডিশনার টেকনিশিয়ান, প্লাম্বিং এবং পাইপ ফিটিংয়ের কাজ।
এদিকে, গত বছর ৫০,১৫৮ জন দক্ষ পেশাদারকে বিদেশে পাঠিয়েছে বাংলাদেশ— যাদের মধ্যে ডাক্তার, নার্স, ইঞ্জিনিয়ার এবং আইটি বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। এর আগের বছর দক্ষ পেশাদার হিসেবে মাত্র ৩,৬৪০ জন কর্মী পাঠানো সম্ভব হয়েছিল।
তবে প্রতি বছর অভিবাসী কর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও এখাতে নারীর অংশগ্রহণ খুবই কম। গত ছয় মাসে মোট অভিবাসন কর্মশক্তির মাত্র ৬ শতাংশ ছিলেন নারী।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ঢাকা বিভাগ থেকে বিদেশে গিয়েছেন সবচেয়ে বেশি ১,২১,৫২০ অভিবাসী শ্রমিক। এরপরে রয়েছে চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, সিলেট এবং রংপুর।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সময়সীমার মধ্যে ইন্ডিভিজ্যুয়াল ভিসা ইস্যু হয়েছে ১,৮৩,২৭৪টি। অন্যদিকে, গ্রুপ ভিসা ইস্যু হয়েছে ২৮,২২৩টি।
বাংলাদেশ সরকার-অনুমোদিত একটি মোবাইল অ্যাপ এবং ওয়েব পোর্টাল হলো 'আমি প্রবাসী'। এই অ্যাপ ও পোর্টাল ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে বিদেশ যেতে ইচ্ছুক লোকেরা প্রায় সব ধরনের তথ্য ও সহযোগিতা পেতে পারেন। অভিবাসনে ইচ্ছুকদের বিদেশে কর্মসংস্থান লাভে সহায়তা করতে পারে, এমন সকল স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে এই অ্যাপের মাধ্যমে।