রোদের ঘ্রাণ আর বাতাসের রঙ: প্রতিবেশি বন্ধুরা
দেশ থেকে যেসব জিনিস স্থায়ীভাবে নাই হয়ে যাচ্ছে তার একটা হচ্ছে খেলার মাঠ। আমাদের খেলার মাঠের অভাব ছিল না। কারণ বসতিগুলো থাকতো ফাঁকা ফাঁকা। বিশেষ করে পাড়ার পেছনে রেললাইনের কাছটা তো পুরাই ফাঁকা। পাড়ার ভেতরেও প্রচুর প্লট খালি থাকতো। তার কোনটার চারদিকে দেয়াল ছিল, তবে বেশির ভাগগুলোতে কোন সীমানা প্রাচীর থাকতো না। অমন যেকোন জায়গায় আধলা ইট বা গাছের ডাল দিয়ে গোলপোস্টের সীমানা নির্ধারণ করতে পারলেই ফুটবল খেলা যেতো। আমরা ফুটবল খেলতাম খালি পায়ে, তাতে আমাদের কোন অসুবিধা হতো না। দূরের স্টেডিয়াম বা কাছের ক্লাবগুলোর মাঠে মুশকো খেলোয়াড়রা জার্সি পরে, বুটপায়ে খেলতেন। ঐ পোশাকে তাদের দেখলে আমরা সভয়ে সরে যেতাম। অথচ অন্যসময়ে তাদেরকে দেখলে ভয় লাগতো না। কেন ভয় লাগবে! ভিক্টোরিয়ার গোলকিপার তো বাচ্চুভাই, আজাদ স্পোর্টিং-এর লিংকম্যান শাহীনভাই, জাগরণীর স্ট্রাইকার রানাভাই! পাইওনিয়ার ডিভিশন মাতানো ছোটখাটো মনুমামাকে কে ভয় পাবে!
আমরা যখন ফুটবল খেলতাম, অথবা শীতকালে ক্রিকেট বা ব্যাডমিন্টন, অথবা কোর্ট কেটে দাড়িয়াবান্ধা সেখানে কে কোন পরিবারের সন্তান সেটা কোন বিচার্য বিষয় ছিল না। ফলে আমাদের পাড়ার বন্ধুকূলে ধনী ব্যবসায়ী বা উচ্চপদস্থ চাকুরীজীবির ছেলে যেমন ছিল তেমন বাজারের সবজিওয়ালার ছেলে, পাড়ার মুদি দোকানদারের ছেলে বা ঠেলাগাড়ি চালকের ছেলে ছিল। কারো শ্রেণী অবস্থান নিয়ে আমাদের কোন মাথাব্যথা ছিল না। ফাঁকা প্লটে বাড়ি উঠে মাঠ নাই হয়ে যাবার সাথে সাথে শ্রেণীবোধহীন শিশুদের দলও নাই হয়ে গেছে।
দিল হোসেন খুব ভালো ছাত্র ছিল। ওর মেধার ব্যাপারে আমার যে কিছু ঈর্ষা ছিল না তা নয়। দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় দিল হোসেনের বাবা মারা যান। সংসার চালানোর জন্য পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান দিল হোসেন তখন বাসার বারান্দায় চৌকি পেতে মুদি দোকান খুলে বসে। আমরা স্কুলে যাবার সময় কোন কোনদিন দেখতাম দুটো বড় চটের ব্যাগ নিয়ে দিল হোসেন দোকানের সওদা কেনার জন্য বাজারে যাচ্ছে। যাবার সময় হেঁটেই যাচ্ছে যাতে বাস ভাড়াটা বাঁচে। আমার মধ্যে এক রকমের অপরাধ বোধ কাজ করতো, কিন্তু কেন তা বুঝিয়ে বলতে পারতাম না। বছর শেষে পরীক্ষায় কখনো ভালো ফল করলে মনে হতো আমি দিল হোসেনের জায়গাটা অন্যায়ভাবে নিয়ে নিলাম।
শুধু দিল হোসেন নয়, সিনেমার নায়ক হবার স্বপ্ন দেখা সুদর্শন আবদুল হাই লেদমেশিন চালক হয়েছে, অসাধারণ গল্প কথক রশীদ মোটরমেকানিক হয়েছে, ভালো ফুটবলার সিরাজ ফার্নিচারের দোকানে কাঠমিস্ত্রী হয়েছে, আর খুব জোরে দৌড়াতে পারা কামরুল সবজিওয়ালা হয়েছে। এই প্রত্যেকটি বন্ধুর এই প্রকার পরিণতির জন্য আমার নিজেকে অপরাধী মনে হয়, যদিও আমার কিছুই করার ছিল না এবং আমি নিজে জীবনে কিছুই হতে পারিনি।
ধর্মে নাকি বলে চল্লিশঘর পর্যন্ত প্রতিবেশি, আমাদের কাছে গোটাপাড়ার সবাইকেই প্রতিবেশি মনে হতো। যাদের বাসায় টেলিভিশন ছিল না তারা অনায়াসে অন্য যে কারো বাসায় টেলিভিশন দেখতে চলে যেত। যখন রবিবার সন্ধ্যায় রনএলি'র বা আরও পরে রবিবার দুপুরে জনি ওয়েসমুলারের 'টারজান' দেখাতো তখন পাড়ার এক ফেজে ইলেকট্রিসিটি না থাকলে অন্য ফেজের কারো বাসায় সবাই ছুট লাগাতো। উৎসবের দিনে রাতে বাংলা সিনেমা দেখার জন্য সব বয়সী নারী-পুরুষের যে ভীড় হতো সেটা এখন কারো কল্পনাতে আসবে না। এবং এই ভীড় করে কারো বাসায় যাবার জন্য কারো মধ্যে কোন দ্বিধা কাজ করতো না। কারণ, আমরা সবাই প্রতিবেশি যে! আর এখন উলটো দিকের ফ্ল্যাটে কারা থাকেন সেটা জানি না। বিল্ডিং-এ কেউ মারা গেলে মাইকের ঘোষণা শুনে খবর পাই, তাও জানাজায় লোক হয় না।
আমাদের শৈশবে চাচাতো-ফুফাতো-মামাতো-খালাতো-তালাতো ভাইবোন, বন্ধুর মতো অল্পবয়সী চাচা-ফুফু-মামা-খালা, স্কুলের বন্ধু ছাড়াও পাড়া জুড়ে বন্ধু ছিল, অন্যপাড়ার বন্ধুও ছিল। আমাদের সন্তানদের এসব কিছু নেই। বস্তুগত দৃষ্টিতে ওরা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি কিছু পায়, কিন্তু ওদের চারপাশে কোন মানুষ নেই। যা কিছু মানুষ আছে সব স্পর্শাতীত জগতের। স্কুল ছুটি থাকলে বাসাবোতে চাচার বাসায় বা খিলগাঁয়ে ফুফুর বাসায় যেতাম। চাচাতো ভাইদের সাথে রাজাবাগ-কুসুমবাগের কালীবাড়ির বিশাল পুকুরের পাশের পুরনো বটগাছটাতে গুলতি দিয়ে পাখি শিকার করতে যেতাম—যদিও আমরা কোনদিন কোন পাখির গায়ে একটা আঁচড় পর্যন্ত কাটতে পারিনি। ফুফাতো ভাইদের সাথে খিলগাঁয়ের মাটির মসজিদের কাছের ঝিলের ওপারে দূরে বাংলাদেশ টেলিভিশনের নতুন ভবন দেখতে যেতাম। এসব অ্যাডভেঞ্চারে যাবার পথে ডালপুরি বা কাঠি লাগানো কদবেল খেতাম। বিকেলে বোনেরাসহ সবাই মিলে ইগলু আইসক্রীম খেতে যেতাম। কোন কোন দিন জোনাকী, মধুমিতা বা অভিসার সিনেমা হলে বাংলা সিনেমা দেখতে যেতাম অথবা নয়াপল্টন, শান্তিনগরে অন্য আত্মীয়দের বাসায় বেড়াতে যেতাম। প্রতিবেলায় লাইন ধরে পাত পেরে খেতে বসতাম। রাতে সবাই একঘরে ঢালা বিছানায় ঘুমাতাম।
আজও গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে সিলিং-এ ঘুর্ণয়মান পাখা দেখে আমার হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় আমি বুঝি সেই ঢালা বিছানায় শুয়ে আছি। আমার গায়ে হাতকাটা সাদা স্যান্ডো গেঞ্জী, পরনে মাথায় পালক লাগানো রেড ইন্ডিয়ানের ছবি এমব্রয়ডারি করা ইলাস্টিকওয়ালা হাফ প্যান্ট, এক পাশে মিন্টুদাদা বা পিন্টুদাদা, আরেক পাশে অপু বা সেতু। ভাবনার টাইমমেশিন অবলীলায় আমাকে আজকে অলঙ্ঘনীয় সব দূরত্বে থাকা ভাইবোনদের কাছে, চিরতরে হারিয়ে যাওয়া মিল্লাত পাখার ঘর ঘর শব্দের কাছে, বাতাসে ফুলে ওঠা নীল মশারীর কাছে, সবুজ ডিমলাইটের আলোর কাছে নিয়ে যায়।
১৩মার্চ ২০২০