কোটিপতি সেজে প্রতারণা করে কোটি টাকা হাতিয়ে নিতেন তিনি
কাগজে-কলমে শিল্পপ্রতিষ্ঠান ‘আবরার ট্রেডার্স’ ও ‘জাহান গ্রুপ’-এর মালিক মশিউর রহমান। রাজধানীর গুলশান, বনানী ও উত্তরায় আলিশান অফিস তার। সবসময় ঘুরে বেড়ান প্রাডো গাড়িতে। নামে-বেনামে আরও শতাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার।
এসব প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন জায়গা থেকে লাখ লাখ টাকার পণ্য কেনেন তিনি। এরপর মাত্র ১০ শতাংশ টাকা অগ্রিম পরিশোধ করে বাকি টাকার জন্য ব্যাংক চেক দিয়ে দেন। তিন মাস না যেতেই হাওয়া হয়ে যায় তার প্রতিষ্ঠান। এলাকা পরিবর্তন করে নতুন জায়গায় নতুন নামে গড়ে তোলেন অফিস।
আর এভাবেই শূন্যের উপর ব্যবসা করে গত পাঁচ বছরে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন মশিউর।
সম্প্রতি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তাকে গ্রেপ্তার করে।এরপর জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।
খবর পেয়ে ডিবি অফিসে ছুটে আসেন মশিউরের প্রতারণার শিকার কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিসহ ভুক্তভোগীরা।
ডিবি বলছে, শুধুমাত্র ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন থানাতেই মশিউরের বিরুদ্ধে ১৫টি প্রতারণার ও ১১টি চেক জালিয়াতির মামলা রয়েছে। তবে মশিউর একা নন, তার প্রতারকচক্রের সদস্য হিসেবে রয়েছেন তার স্ত্রী সাবরিনা রহমানসহ রেজাউর রহমান ও ফারুক নামে অন্য তিন সদস্য।
বেঙ্গল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গুলশান থানায় এই চক্রের বিরুদ্ধে মামলা করে। মামলার এজাহারে জানা যায়, আবরার ট্রেডার্স কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান বেঙ্গল গ্রুপের লিনেক্স ইলেকট্রনিক্স বিডি লিমিটেড থেকে মোট ৪৯ লাখ টাকার পণ্য ক্রয় করেন। এর মধ্যে ছিল বিভিন্ন মডেলের ১৫০টি এলইডি টিভি, ২টি মাইক্রো ওভেন, একটি ফ্রিজ ও একটি এয়ার কন্ডিশনার।
লেনদেনের সময় মশিউর সিটি ব্যাংকের ২৩ লাখ টাকার একটি চেক দেন তাদের। বাকি টাকা পরে পরিশোধের কথা বলেন।
চেকটি ব্যাংকে জমা দেওয়ার পর সেখান থেকে জানানো হয়, একাউন্টে কোনো টাকা নেই। পরে মশিউরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, দু’একদিনের মধ্যে টাকা ব্যাংকে জমা দিয়ে দিবেন। কিন্তু পরে অফিসে তালা ঝুলিয়ে পালিয়ে যান মশিউর।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের খিলগাঁও জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহিদুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “মশিউরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে একাধিক প্রতারণা মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল।”
মশিউরের দ্বারা প্রতারণার শিকার হয়েছেন শাহজাদপুর এলাকার ফার্নিচার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শিমুল মিয়া। তিনি জানান, মাত্র ১০ শতাংশ টাকা অগ্রিম দিয়ে তার কাছ থেকে সাত লাখ টাকার ফার্নিচার কেনেন মশিউর।
“পরবর্তীতে কয়েক ধাপে তিন লাখ টাকা দিলেও আরও চার লাখ টাকা পাব তার কাছে। আমরা ছোট ব্যবসায়ী। এই প্রতারকের পাল্লায় পড়ে আমার ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে,” বললেন শিমুল।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, অভিজাত এলাকায় অফিস ভাড়া নিয়ে গত পাঁচ বছর ধরেই এভাবে প্রতারণা করে আসছিলেন মশিউর। বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে ৫০ লাখ টাকার পণ্য কিনে অগ্রিম হিসেবে মাত্র ১০ শতাংশ পরিশোধ করতেন। একই পণ্য অন্য জায়গায় বিক্রি করে পুরো টাকাটাই নিজের পকেটে পুরে অফিস ছেড়ে পালাতেন।
আরও জানা গেছে, এক বছর আগে একটি বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৫৭ লাখ টাকার সিমেন্ট কেনে মশিউরের প্রতারকচক্র। ওই প্রতিষ্ঠান এখনও ৪০ লাখ টাকা পায় তাদের কাছে।
সম্প্রতি নতুন এক ধরনের প্রতারণা শুরু করেছিল চক্রটি। সিরাজগঞ্জের কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ভুট্টা, গমসহ কৃষিপণ্য কিনত।২০ হাজার টাকা নগদ দিয়ে কৃষকদের কাছ থেকে লাখ টাকার পণ্য নিয়ে এসে বাজারে বিক্রি করা হত।এরপর আগের নিয়মেই নিজেদের পরিচয় পরিবর্তন করে ফেলে তারা। এভাবে ওদের প্রতারণার শিকার হয়ে নিঃস্ব হয়েছেন অনেক কৃষক।
মশিউর-চক্রের প্রতারণার শিকার এক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আজম খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “কখনও ‘আবরার ট্রেডার্স’, কখনও ‘জাহান গ্রুপ’-এর নাম ব্যবহার করত তারা। আর এসব গ্রুপের অধীনে অয়েল, কনজুমার প্রডাক্ট, টেলিকমিউনিকেশন, বিল্ডার্স লিমিটেডসহ অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে বলে দাবি করত মশিউর। ভুয়া এসব প্রতিষ্ঠানের নামেই শত কোটি টাকা লুটে নিয়েছে এই প্রতারকচক্র।”