তালেবান রক্তচক্ষু এড়িয়ে আফগানিস্তানে প্রথম নারীদের জিম
কাবুল রুশানা আজিজি শেষবারের মতো নিজের ব্যাগ খুলে কর্মতালিকায় নজর বুলিয়ে নিলেন। তারপর ঝটপট আয়নায় তাকিয়ে ঠিকঠাক করে নিলেন হিজাব।
এবার তার কাজে নামার সময়। কান্দাহারে নিজ বাড়ির কাছে তৈরি হওয়া আফগানিস্তানের প্রথম শুধুই নারীদের ফিটনেস সেন্টারের নতুন রুটিনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে ১৯ বছর বয়সী এই তরুণীকে। আসলে দেশটির পুরো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এটিই নারীদের একমাত্র জিম।
'পরিবার থেকে কোনো বাধা আসেনি। বাড়ি থেকে হিজাব পরেই ক্লাবে আসি আমরা। তারপর ভেতরে ঢুকে রেগুলার স্পোর্টস ক্লথ গায়ে চাপাই। ক্লাবটির পরিবেশ দারুণ। শুরুর দিকে কিছু পুরুষ অবশ্য আপত্তি তুলেছিলেন, তবে দিন দিন তাদের সমর্থন বাড়ছে। কেননা, তারা বুঝে গেছেন, এটা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারি ও জরুরি,' বলেন আজিজি।
তিনি জানেন সবই
কান্দাহার প্রদেশে শুধুই নারীদের জন্য কোনো জিম হবে, এ কথা বছর কয়েক আগেও বোধহয় কেউ ভাবতে পারেনি। কেননা, এখনো এখানকার কিছু অঞ্চলে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বারণ। একা বাড়ির বাইরে কিংবা জিমে যাওয়া তো কল্পনারও অতীত!
তালেবানের জন্মভূমি এবং আফগানিস্তানের অনেক শাসকের ঐতিহ্যবাহী মসনদের স্থান হিসেবে এখনো কান্দাহারের প্রায় সব নারীই বাড়ি থেকে বোরকা পরে বের হন।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিদেশি সৈন্যদলের হাতে উৎখাত হওয়ার আগে দেশটিতে যখন তালেবান শাসন চলছিল, তখন নারীদের জন্য পড়াশোনা নিষিদ্ধের পাশাপাশি চলাফেরায় অনেক বিধিনিষেধ করা হয়েছিল আরোপ।
তবে প্রদেশটিতে নারী অধিকারের এক প্রবল ও সমন্বিত প্রচেষ্টার কারণে শহরটির কেন্দ্রস্থলে শুধুই নারীদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার প্রবর্তন ঘটেছে।
'নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ও প্রতিকূল কথাবার্তা পাশ কাটিয়ে, আমি এই সুবিধার (জিম স্থাপন) পক্ষ নিয়ে স্থানীয় গণমাধ্যমে কথা বলেছি এবং এটি এখন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। শুধু নারীরাই নন, পুরুষরাও আমাকে সমর্থন দিয়েছেন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার পক্ষে কথা বলেছেন,' বলেন ৩৬ বছর বয়সী মরিয়ম দুরানি। এই জিম তিনিই চালান।
জিম স্থাপনের কাজটি শুরুতে সহজ ছিল না। সে সময় এজন্য ফোন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অচেনা পুরুষদের হুমকি পাওয়া হয়ে উঠেছিল তার জন্য নিয়মিত ঘটনা।
তবু ছাড়েননি হাল
কান্দাহারের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রবণতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা দুরানির জন্য নতুন কিছু নয়। তিনি এ ধরনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে অভ্যস্ত।
এই ফিটনেস সেন্টারের পাশাপাশি নারীদের জন্য একটি রেডিও স্টেশনের পরিচালনা কার্যক্রম দেখাশোনা এবং কান্দাহারের প্রাদেশিক কাউন্সিলে প্রতিনিধিত্বও করেন দুরানি।
একজন আইনপ্রণেতা হিসেবে নিজ অবস্থানের কারণে দুইবার প্রাণঘাতী হামলার শিকার হলেও বেঁচে যান তিনি। এরমধ্যে ২০০৯ সালে কাউন্সিল কম্পাউন্ডে তালেবানদের আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনাটিও রয়েছে। ওই হামলায় প্রাণ যায় ২০ জনের। দুরানি ও তার বেশ কয়েকজন সহকর্মী মারাত্মক আহত হয়েছিলেন।
বছরের পর বছর ধরে নিজ শক্তি দেখানোর দাম তিনি পেয়েছেন। ২০১২ সালে তৎকালীন মার্কিন ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা তাকে 'ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অব কারেজ অ্যাওয়ার্ড' তুলে দিয়েছেন।
দুরানি জানান, জিম স্থাপনের ভাবনা তার মনে দীর্ঘদিন ধরেই ছিল; তবে এটিকে বাস্তব করে তুলতে প্রয়োজনীয় বাজেটের ব্যবস্থা করতেই সময় লাগল এতদিন।
জিমটিতে কোনো সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী নেই এবং এটি পুরোপুরি নারীরা চালান, তাই সব মিলিয়ে ইতিবাচক সাড়াই পাচ্ছেন দুরানি।
'নারীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে সাহায্য করতে পারছি, এটা দেখে আমার খুব আনন্দ হয়,' বলেন তিনি।
পথচলা শুরুর এক বছর পেরিয়ে, ফিটনেস সেন্টারটিতে এখন প্রতিদিন ৩০ জনেরও বেশি নারী নিয়মিত শরীরচর্চা করেন।
এর খরচ যোগাতে দুরানি ধার্য্য করেছেন ন্যূনতম ফি।
যদিও জিম বন্ধ করার জন্য তালেবানদের কাছ থেকে সরাসরি কোনো হুমকি পাননি, তবু দেশটিতে চলমান সুদীর্ঘ সংঘাত নিরসনের উদ্দেশ্যে কাতারে তালেবান ও সরকারের মধ্যে মধ্যস্থতার আলাপ স্থগিত হয়ে যাওয়ায় আফগানিস্তানে নারীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুরানি বেশ উদ্বিগ্ন।
'অন্য সবার মতো আমিও আফগানিস্তানে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার আশা করি; তবে আশাবাদের পাশাপাশি মনে উৎকণ্ঠাও কাজ করে: আমার মানবাধিকার ধরে রাখতে পারব কি না, নারীদের মানবাধিকার অর্জিত হবে কি না,' বলেন তিনি।
এখন তার মনোযোগ জিমটির সচল থাকা অব্যাহত রাখা এবং 'আফগানিস্তানে নারীদের ক্ষমতায়ন এবং তাদের সক্ষমতা অর্জনে' কাজ করে যাওয়া।
- আরব নিউজ থেকে অনুবাদ: রুদ্র আরিফ