গণঅভ্যুত্থানে আহতরা পাবেন স্বতন্ত্র পরিচয়পত্র, বিনামূল্যে আজীবন চিকিৎসাসেবা
সরকার জুলাই–আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসার জন্য প্রত্যেককে স্বতন্ত্র পরিচয়পত্র (ইউনিক আইডি) দেবে। এ আইডি ব্যবহার করে তারা দেশের সব সরকারি হাসপাতালে আজীবন বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা নিতে পারবেন।
এছাড়া, যেসব বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে সরকারের চুক্তি থাকবে, সেখানেও তারা বিনামূল্যে চিকিৎসা পাবেন।
বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) সচিবালয়ে গণ-অভ্যুত্থানে আহত শতাধিক ব্যক্তির সঙ্গে এক বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠকে সরকারের ছয়জন উপদেষ্টা এবং প্রধান উপদেষ্টার এক বিশেষ সহকারী উপস্থিত ছিলেন।
হট্টগোলের কারণে নির্ধারিত সময়ের আড়াই ঘণ্টা পরে শুরু হওয়া এ বৈঠকে আহতরা উপদেষ্টাদের সামনে তাদের সাত দফা দাবি উপস্থাপন করেন।
গতকাল বুধবার (১৩ নভেম্বর) উন্নত চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের দাবিতে আন্দোলনে আহতদের একটি অংশ জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) সামনে অবস্থান নেন।
তাদের বিক্ষোভ মাঝরাতেও অব্যাহত থাকে। রাত আড়াইটার দিকে অন্তর্বর্তী সরকারের চার উপদেষ্টা সেখানে উপস্থিত হয়ে দাবি মানার ও আহতদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করার আশ্বাস দেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে আজকের বৈঠকটির আয়োজন করা হয়।
বৈঠকের সিদ্ধান্ত
বৈঠক শেষে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্বাহীর দায়িত্ব পাওয়া প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান জানান, 'আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে একটি লিখিত রূপরেখা প্রকাশ করা হবে। রূপরেখায় উল্লেখিত টাইমলাইন অনুযায়ী প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'আহত যোদ্ধাদের ইউনিক আইডি কার্ড থাকবে। তারা সারাজীবন সব সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বিনামূল্যে সেবা পাবেন। যেসব বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে সরকারের চুক্তি থাকবে, সেখানেও তারা বিনামূল্যে সেবা পাবেন।'
আহতদের চিকিৎসার জন্য সব সরকারি হাসপাতালে বিশেষ বেড থাকবে এবং ঢাকার সব হাসপাতালকে একটি নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হবে বলে জানান তিনি।
সায়েদুর রহমান বলেন, আহতদের চিকিৎসার বিষয়ে রূপরেখায় যেসব বিষয় উল্লেখ থাকবে, তা আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করা হবে।
তিনি বলেন, 'এ বিষয়ে কোনো ধরনের গাফিলতি সহ্য করা হবে না।'
বৈঠকে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের সভাপতিত্বে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম, যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, সমাজ কল্যাণ উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ, উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ, জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলমসহ স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শুরুর আগে হট্টগোল
এ দিন দুপুর ২টায় বৈঠক শুরু হওয়ার কথা ছিল। সে অনুযায়ী পঙ্গু হাসপাতালের সামনে অবস্থান নেওয়া আহতদের ৫০ সদস্যের একটি দল দুপুরে সচিবালয়ে আসেন। তাদের সঙ্গে অন্যান্য হাসপাতাল থেকেও অনেকে উপস্থিত হন সচিবালয়ের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে।
কিন্তু বৈঠক শুরুর আগে একজন নিজেকে আহতদের সমন্বয়ক দাবি করায় অধিকাংশ আহত ওই সভা বয়কট করার ঘোষণা দেন।
এক পর্যায়ে পঙ্গু হাসপাতালের সামনে অবস্থান নেওয়া আহতদের দলটি সভা বয়কট করার সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের একজন প্রতিনিধি হিল্লোল বলেন, 'যারা জীবন দিয়ে, রক্ত দিয়ে আন্দোলনকে সফল করেছেন, তাদের প্রতি সরকার দায়িত্ব দেখাচ্ছে না। আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়নি। অন্যদিকে সরকার উপদেষ্টা, সচিব নিয়োগসহ অন্যান্য কাজে ব্যস্ত আছে।'
তিনি আরও বলেন, 'যাদেরকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হচ্ছে বা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, আন্দোলনে তাদের ভূমিকা আমরা জানি না। আহতরা চিকিৎসা পাচ্ছে না সেটা পরিষ্কার।'
হিল্লোল বলেন, 'আজ সচিবালয়ে এসে দেখছি, আহতদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া নিয়ে যাদের সঙ্গে মিটিং করা হবে বা এখানে কিছু লোক আহত হিসেবে উপস্থিত হয়েছেন, তারা বুধবারের পঙ্গু হাসপাতালের আন্দোলনে ছিলেন না। এখানে কিছু রাজনীতি হচ্ছে।'
সরেজমিনে দেখা যায়, আহতদের একটি গ্রুপ সভা বয়কট করার উদ্দেশ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষ থেকে বের হয়ে যান। পরে সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে আসেন।
আহতদের পক্ষ থেকে সভায় কে কে কথা বলবেন, সে তালিকা করার পরামর্শ দেন তারা। পরে সকলকে নিয়ে বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটের দিকে এ বৈঠক শুরু হয়।
সাত দফা দাবি
বৈঠকে আহতরা সাত দফা দাবি তুলে ধরেন। তাদের দাবিগুলো হলো, মন্ত্রী বা উপদেষ্টা যারা আহত হলে যে মানের চিকিৎসা দেওয়া হতো, আন্দোলনে আহতদের অতিদ্রুত সে মানের চিকিৎসা দিতে হবে।
যারা আহত হয়ে নিজ খরচে চিকিৎসা নিয়েছেন, তাদের চিকিৎসা খরচ পরিশোধ করতে হবে।
আন্দোলনে শহীদ পরিবার ও আহতদের সম্মাননা কার্ডের মাধ্যমে একটি প্রজন্ম পর্যন্ত মাসিক ভাতা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
শহীদ ও আহতদের স্মৃতি ফাউন্ডেশন নামে জাদুঘর নির্মাণ করে প্রতি বছর ১ জুলাই হতে ৫ আগস্ট পর্যন্ত শহীদদের স্মরণে গণ-স্বাক্ষর কর্মসূচির আয়োজন করতে হবে।
এর বাইরে আরও যেসব দাবি তারা করেছেন তার মধ্যে রয়েছে, শহীদ হয়েছেন ও আহত হয়ে যারা অঙ্গ হারিয়েছেন, একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে তাদের মেডিকেল ফাইল তদন্ত করে কোনো ডাক্তার বা মেডিকেলের অবহেলার কারণ খুঁজে পেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া।
দ্রুত সময়ের মধ্যে গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগীদের বিচারের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে এবং সে সংগঠনকে নিষিদ্ধ করতে হবে।
আর আগামীতে রাষ্ট্র সংস্কারে ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে শহীদ পরিবারের সদস্য ও আহত যোদ্ধাদের মতামত গ্রহণ করতে হবে।