চীনের অর্থায়নে দক্ষিণ আমেরিকায় প্রথম মেগা বন্দর চালু; উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র
বৃহস্পতিবার পেরুর চাঙ্কাই বন্দর উদ্বোধন করেছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এটি দক্ষিণ আমেরিকায় চীনের অর্থায়নে তৈরি প্রথম সমুদ্রবন্দর।
চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অংশ হিসেবে তৈরি বিশাল এই বন্দরটি লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্যকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনা পণ্য আমদানিতে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতেছেন। তবে দক্ষিণ আমেরিকায় চীনের সহায়তা তৈরি এই নতুন মেগা বন্দর সম্পূর্ণ নতুন বাণিজ্য রুট তৈরির সম্ভাবনা তৈরি করছে। এ রুটে উত্তর আমেরিকাকে সম্পূর্ণ পাশ কাটিয়ে বাণিজ্য পরিচালনা করা যেতে পারে।
শি জিনপিং একে 'একবিংশ শতাব্দীর সামুদ্রিক সিল্ক রোড' হিসেবে অভিহিত করেছেন।
পেরুর প্রেসিডেন্ট দিনা বোলুয়ার্ত চীনের সঙ্গে এই সহযোগিতাকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, 'এই প্রকল্প আমাদের অর্থনীতির উন্নয়নে চীনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রতিফলন।'
শি জিনপিং পেরুর প্রেসিডেন্ট দিনা বোলুয়ার্তের সঙ্গে লিমায় বলেন, 'এটি পেরুর জন্য উল্লেখযোগ্য আয় এবং বিশাল কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে।'
স্থানীয় এল পেরুয়ানো পত্রিকায় প্রকাশিত একটি মতামত নিবন্ধে শি জিনপিং উল্লেখ করেছেন যে, এই প্রকল্পটি বছরে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার আয় সৃষ্টি করবে এবং আট হাজারের বেশি কর্মসংস্থান তৈরি করবে। পেরু-চীন রুটের লজিস্টিক খরচ ২০ শতাংশ কমিয়ে দেবে।
বন্দরের সুযোগকে স্বাগত জানিয়ে চীনের প্রশংসা করে বোলুয়ার্ত বলেন, 'আমাদের অর্থনীতির উন্নয়নে চীন একটি বড় ভূমিকা পালন করছে।'
১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্পটি চীনের বৃহৎ শিপিং কোম্পানি কস্কো দ্বারা পরিচালিত। ২০২৫ সালের মধ্যে চাঙ্কাই বন্দর বিশ্বের সবচেয়ে বড় কন্টেইনার জাহাজগুলোর হ্যান্ডলিং সক্ষমতা অর্জন করবে।
বন্দরটি ব্রাজিলসহ প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে সয়াবিন ও লোহার আকরিকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্য রপ্তানি সহজতর করবে।
প্রথম জাহাজটি আগামী সপ্তাহে চাঙ্কাই বন্দর থেকে যাত্রা করবে, যা দক্ষিণ আমেরিকা ও এশিয়ার বাণিজ্য রুটের খরচ ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দেবে।
চীন ইতিমধ্যেই এ অঞ্চল থেকে আমদানি করতে যথেষ্ট আগ্রহী। তাদের আগ্রহের তালিকায় রয়েছে ব্রাজিলের সয়াবিন ও চিলির তামা। এখন এই নতুন বন্দরটি বড় জাহাজ পরিচালনা করতে পারবে। পাশাপাশি পরিবহনের সময় কমিয়ে আনবে ৩৫ দিন থেকে ২৩ দিন পর্যন্ত।
তবে এই নতুন বন্দর রপ্তানির পাশাপাশি আমদানিকেও প্রাধান্য দেবে। অনলাইনে কেনা সস্তা চীনা পণ্য স্থানীয় শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, এমন লক্ষণ ইতিমধ্যে দেখা দিয়েছে। তাই চিলি ও ব্রাজিল ব্যক্তি খাতের ক্রেতাদের জন্য কম দামের বিদেশি পণ্যের ওপর করছাড় বাতিল করেছে।
এদিকে প্রকল্পটি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। স্থানীয় মৎস্যজীবী ও বাসিন্দারা পরিবেশগত ক্ষতি এবং ঐতিহ্যবাহী মাছ ধরার স্থান হারানোর অভিযোগ তুলেছেন।
৭৮ বছর বয়সি জেলে জুলিয়াস সিজার বলেন, 'আমাদের মাছ ধরার স্থানগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি চীনাদের দোষ দিই না, বরং আমাদের সরকারই আমাদের সুরক্ষায় ব্যর্থ।'
এ বন্দরে চীনের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে উদ্বিগ্ন মার্কিন সামরিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, চাঙ্কাইয়ে যদি অতিরিক্ত বড় আকারের কনটেইনার জাহাজ ভিড়তে পারে, তাহলে চীনা যুদ্ধজাহাজও এ বন্দরে ভিড়তে পারবে।
পশ্চিমা পর্যবেক্ষকরা বলছেন, প্রতিবেশী এবং তাদের প্রয়োজনের প্রতি বছরের পর বছর উদাসীনতার মাশুল দিচ্ছে ওয়াশিংটন।
ওয়াশিংটনে পিটারসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিকসের সিনিয়র ফেলো মনিকা ডি বোল বিবিসিকে বলেন, 'দীর্ঘদিন লাতিন আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্র অনুপস্থিত ছিল। আর চীন এত দ্রুত সেখানে প্রবেশ করেছে যে গত দশকে পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে গেছে।'
তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের 'পেছনের আঙিনা সরাসরি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছে। এটা সমস্যা তৈরি করবে।'
এর আগে মার্কিন সেনা কমান্ডের সাবেক প্রধান জেনারেল লরা রিচার্ডসন সতর্ক করেছিলেন, চাঙ্কাই বন্দরটি চীনের নৌবাহিনীর গোয়েন্দা কার্যক্রমের জন্য ব্যবহার হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ লাতিন আমেরিকা কূটনীতিক ব্রায়ান নিকোলস লিমায় সতর্ক করেছিলেন যে, চীনের বিনিয়োগ সম্পর্কে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর সতর্ক থাকা উচিত।
চাঙ্কাই বন্দর দক্ষিণ আমেরিকায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং পেরুর মতো দেশগুলোর জন্য প্রধান বাণিজ্য অংশীদার হয়ে ওঠার উদাহরণ।
সামরিক উদ্বেগ যদি অবান্তরও হয়, তারপরও এই বন্দর প্রমাণ করে যে চীন যখন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র তখন লাতিন আমেরিকায় নিজের অবস্থান হারাচ্ছে।
লন্ডন স্কুল অভ ইকোনমিক্সের গ্লোবাল সাউথ ইউনিটের পরিচালক প্রফেসর আলভারো মেন্ডেজ বিবিসিকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যখন লাতিন আমেরিকা নিয়ে ভাবা ছেড়ে দিয়েছিল, শি জিনপিং তখন নিয়মিত এই অঞ্চলে সফর করে সুসম্পর্ক গড়ে তুলছেন।
চীনের রাষ্ট্রীয় গ্লোবাল টাইমস একটি সম্পাদকীয়তে লিখেছে, এই বন্দর 'চীন ও লাতিন আমেরিকার মধ্যে বাস্তব সহযোগিতার সেতু এবং এটি কোনোভাবেই ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার হাতিয়ার নয়।'
যুক্তরাষ্ট্রের 'সামরিক ব্যবহারের অভিযোগকে' তারা 'মিথ্যা প্রচারণা' বলে আখ্যায়িত করেছে।