তিন মাস ধরে মজুরি বন্ধ, কাজ নেই ন্যাশনাল টি কোম্পানির চা শ্রমিকদের
"ঘরে চাল কেনার মতো টাকা নেই। টাকার অভাবে গত এক মাসে কোন সবজি কিনতে পারিনি। আর মাছ খাই না তো অনেকদিন," আক্ষেপের সুরে কথাগুলো বলছিলেন সিলেটের দলদলি চা বাগানের শ্রমিক সুবল নায়েক।
তিনি বলেন, "বাগান কর্তৃপক্ষ সপ্তাহে কিছু আটা দেয়। ডিসি সাহেব (জেলা প্রশাসক) কিছু চাল দিছিলেন। আর বাগান থেকে লতা ও শাক তুলে আনি। এইগুলা খাইয়া কোনোমতে পরিবার নিয়া বাঁচিয়া আছি।"
কেবল সুবল নায়েক নয়, এমন হাহাকার সিলেট বিভাগের ১৮ টি চা বাগানের প্রায় সব শ্রমিকের।
দলদলি চা বাগান রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল টি কোম্পানির (এনটিসি) মালিকানাধীন। সিলেট বিভাগের তিন জেলা সিলেট, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে এনটিসির মালিকানাধীন ১৮টি বাগান রয়েছে। এই সবগুলো বাগানে গত তিন মাস ধরে শ্রমিকদের মজুরি বন্ধ।
মাত্র ১৭০ টাকা দৈনিক মজুরি কাজ করেন চা শ্রমিকরা। তিন মাস ধরে মজুরি বন্ধ থাকায়, অনেকটা খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন তারা। আর মজুরি না পেয়ে দুই মাস ধরে এনটিসির মালিকানাধীন সব বাগানে কাজ বন্ধ রেখেছেন শ্রমিকরা। বাংলাদেশে মোট চায়ের ৭ শতাংশ উৎপাদিত হয় এনটিসির এই বাগানগুলোতে।
সিলেটের লাক্কাতুরা চা বাগানও এনটিসির মালিকানাধীন। রোববার (১ ডিসেম্বর) দুপুরে এই বাগানের গিয়ে দেখা যায়, বাগানের লেবার কলোনির সামনে গোল হয়ে বসে আছেন কয়েকজন নারী ও পুরুষ শ্রমিক।
তাদের একজন অনিতা লোহার বলেন, "কালকে রাতে রুটি খাইছিলাম। আজকে সকালে শুধু কচুশাক সিদ্ধ করে খাইছি। রাতে কিছু খেতে পারবো কি না, জানি না। ঘরে রান্না করার মতো কিছু নাই। দোকান থেকেও এখন আমাদের বাকি দেয় না।"
এই বাগানের প্রবীণ শ্রমিক সুবল মোন্ডা। প্রায় ৩০ বছর ধরে কাজ করছেন এখানে। তিনি বলেন, "বাগানে বিভিন্ন সময় সমস্যা হয়। মজুরিও বন্ধ থাকে। কিন্তু একটানা তিন মাস কখনো মজুরি বন্ধ থাকার কথা জীবনেও শুনিনি। এবারই প্রথম এমন হলো।"
সুবল বলেন, "আমরা সামান্য টাকায় কাজ করি। যে টাকা মজুরি পাই তাতেই সংসার চলে না। ফলে টাকা কখনো সঞ্চয় করতে পারিনি। এখন তিন মাস মজুরি বন্ধ থাকায় সব শ্রমিকই খুব কষ্টে আছে। অনেকে দিনে একবেলা খেয়ে আছে।"
লাক্কাতুরা বাগানের শ্রমিক আয়েশা বেগম বলেন, "আমরা না হয় খেয়ে না খেয়ে আছি। কিন্তু সবচেয়ে সমস্যায় আছি বাচ্চাদের নিয়ে। আমার দুই ছেলে স্কুলে পড়ে। তাদের পরীক্ষা চলছে। কিন্তু এখনো পরীক্ষার ফি দিতে পারিনি। এ কারণে ছেলেরা প্রতিদিন স্কুল থেকে বাড়ি এসে কান্নাকাটি করে।"
সিলেটের শ্রমিকরা জানান, এই তিন মাসে বাগান থেকে সপ্তাহে অল্প সংখ্যক আটা প্রদান করা হয়। আর সিলেটের জেলা প্রশাসক দুই দফা তাদেরকে চাল দিয়েছেন।
জানা যায়, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এনটিসির চেয়ারম্যান শেখ কবির আহমেদসহ অন্য পরিচালকরা আত্মগোপনে চলে যান। এরপর বন্ধ হয়ে যায় শ্রমিকদের মজুরি।
এনটিসির কর্মকর্তারা জানান, শ্রমিকদের মজুরি কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে আসে। ব্যাংক থেকে টাকা না পাওয়ায় মজুরি বন্ধ আছে। তবে আগামী বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) শ্রমিকদের বকেয়া মজুরির কিছু অংশ প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানান তারা।
চা বাগানের শ্রমিকরা বাইরেও কাজ পায় না জানিয়ে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ফেডারেশন সিলেটের সভাপতি বীরেন সিংহ বলেন, "বাগান খুললে চলে আসবে, এই অজুহাতে বাইরের কেউ চা শ্রমিকদের কাজে নিতে চায় না। এমনকি এই অজুহাতে তাদের ঘরের কাজেও নেওয়া হয় না।"
তিনি বলেন, "বাগানের বাইরে চা শ্রমিকদের আয়ের তেমন সুযোগ নেই। এ কারণে মজুরি বন্ধ থাকায় তারা আরও সঙ্কটে পড়েছেন।"
বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়ন সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা জানান, সিলেটে এনটিসির অধীনে লাক্কাতুরা, কেওয়াছড়া ও দলদলি– এই তিনটি বাগান আছে। এসব বাগানে ১ হাজার ১৮০ শ্রমিক রয়েছেন। এছাড়া পুরো বিভাগে শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্য মিলিয়ে লক্ষাধিক লোক রয়েছে। এরা সকলেই এখন চরম সঙ্কটে রয়েছেন।
তিনি বলেন, "মজুরি বন্ধ হওয়ার পরও ২০ অক্টোবর পর্যন্ত শ্রমিকরা কাজ করে গেছেন। কিন্তু ঘরে খাবার না থাকলে তারা কি খেয়ে কাজে আসবেন? ফলে ২১ অক্টোবর থেকে তারা কাজ বন্ধ করে দেন। এরপর থেকে এনটিসির সবগুলো বাগান কার্যত অচল হয়ে আছে।"
এসব বাগানের ৮০ বাগান শ্রমিকই খেতে পারছে না জানিয়ে চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি রামভজন কৈরী বলেন, "এনটিসির বাগানগুলোর ৮০ ভাগের বেশি মানুষ তিনবেলা খেতে পারছে না। ২০ ভাগ পরিবারের কেউ বাগানের বাইরে, কেউ লেবুবাগানে কাজ করেন। তারা কিছুটা চলতে পারছেন।"
বৃহস্পতিবার দেওয়া হবে বকেয়া মজুরি
অবশেষে তিন মাস বন্ধ থাকার পর চা বাগানের শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি ধাপে ধাপে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ন্যাশনাল টি কোম্পানি (এনটিসি)। প্রথম ধাপের টাকা আগামী বৃহস্পতিবারের শ্রমিকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে।
রোববার সন্ধ্যায় মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের সভাকক্ষে এনটিসির সঙ্গে চা-শ্রমিক ও কর্মচারীদের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়।
বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, আগামী বৃহস্পতিবার শ্রমিকদের ছয় সপ্তাহের বকেয়া মজুরির মধ্যে দুই সপ্তাহের মজুরি এবং মাসিক বেতনধারী শ্রমিকদের এক মাসের বেতন পরিশোধ করা হবে। অবশিষ্ট চার সপ্তাহের মজুরি আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে কিস্তিতে পরিশোধ করা হবে। এ ছাড়া চলতি ডিসেম্বর মাস থেকে প্রতি সপ্তাহের মজুরি নিয়মিতভাবে দেওয়ার সিদ্ধান্তও হয়।
বৈঠকে এনটিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহমুদ হাসান বলেন, "টাকার অভাবে এতদিন শ্রমিকদের মজুরি দেওয়া সম্ভব হয়নি। সরকারের হস্তক্ষেপে অচলাবস্থার নিরসন হচ্ছে।"
তিনি বলেন, "চা-শ্রমিক ও কর্মচারীদের সঙ্গে বৈঠকে ধাপে ধাপে বকেয়া মজুরি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বৃহস্পতিবারের মধ্যে তারা বকেয়া মজুরির প্রথম কিস্তি পেয়ে যাবেন।"
চা-শ্রমিক ইউনিয়ন নেতা রাজু গোয়ালা বলেন, "বৃহস্পতিবার বকেয়া মজুরির প্রথম কিস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।"
বকেয়া মজুরির প্রথম কিস্তির টাকা পাওয়ার পরই চা শ্রমিক ও কর্মচারীরা কাজে ফিরবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।