দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের সামরিক আইন জারি হিতে বিপরীত হয়েছে: এখন কী ভাবছেন তিনি?
হঠাৎ করেই সামরিক আইন জারির ঘোষণা দেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওল। গত মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) রাতে টেলিভিশনে সম্প্রচারিত জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে এ ঘোষণা দেন তিনি, যা বিস্মিত করে দেশবাসীকে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ব্যাপক প্রতিবাদ এবং সংসদ সদস্যদের তীব্র বিরোধিতার মুখে তিনি তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হন। খবর বিবিসি'র।
সামরিক আইন জারির প্রতিবাদে সৈনিকদের বাধা উপেক্ষা করেই পার্লামেন্টে সমবেত হন আইনপ্রণেতারা। তারা প্রেসিডেন্টের জারি করা সামরিক আইন ভোটাভুটির মাধ্যমে বাতিল করে দেন।
ইউনের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখন গভীর সংকটে। রাস্তায় প্রতিবাদ এবং তার বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তার পদত্যাগের দাবি উঠেছে এবং স্থানীয় কিছু গণমাধ্যম জানিয়েছে, তার নিজ দল পিপল পাওয়ার পার্টির সদস্যরাও তাকে দল থেকে বহিষ্কারের কথা বিবেচনা করছেন।
এরপর থেকে সিউলে একটি প্রশ্নই সকলের মনে উঁকি দিচ্ছে—'প্রেসিডেন্ট আসলে কী ভাবছিলেন?'
১৯৭৯ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় শেষবার মার্শাল ল জারি হয়েছিল, যা তখনকার সামরিক শাসনের সহিংসতার ফল। কিন্তু এখনকার দক্ষিণ কোরিয়া সেই অস্থির সময় পেরিয়ে একটি স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ গণতন্ত্র।
তবু ইউন দাবি করেন যে, তিনি 'অন্ধকার শক্তি' থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য সামরিক শাসন জারি করেছেন। বিরোধী-নিয়ন্ত্রিত সংসদকে তিনি 'অপরাধীদের আখড়া' বলে উল্লেখ করেন এবং অভিযোগ করেন, তারা সরকারকে অচল করার চেষ্টা করছে।
বিশ্লেষকদের মতে, প্রেসিডেন্টের এই পদক্ষেপ তার ক্ষমতা ধরে রাখার একটি মরিয়া চেষ্টা। তিনি ২০২২ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে কম ব্যবধানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হন। তবে এরপর থেকে তার শাসনকাল নানা বিতর্কে জর্জরিত।
২০২২ সালের শেষের দিকে হ্যালোউইনের সময় সিউলে ভয়াবহ ভিড় চাপে ১৫৯ জন তরুণ প্রাণ হারালে সরকারের প্রতিক্রিয়া নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন প্রেসিডেন্ট ইউন।
এরপর তার স্ত্রীকে একটি ডিওর ব্যাগ উপহার হিসেবে গ্রহণ করতে দেখা গেলে, সেই ঘটনার তদন্তের দাবিও ওঠে। এই কেলেঙ্কারি প্রায়ই শিরোনামে উঠে আসে।
চলতি বছরের এপ্রিল মাসে তার দল সংসদীয় নির্বাচনে পরাজিত হয়, ফলে প্রেসিডেন্ট ইউন রাজনৈতিকভাবে অকার্যকর হয়ে পড়েন। চলতি সপ্তাহেই তিনি দেশের বাজেট নিয়ে বিরোধী আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে তীব্র রাজনৈতিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন।
এরপরও যখন তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার জনগণের অধিকারের স্থগিতাদেশের ঘোষণা দেন, তখন তার জনপ্রিয়তার হার ছিল ২০ শতাংশেরও নিচে।
তবে ইউনের ভাষণে কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, তিনি কী ভাবছিলেন।
বিরোধী দল-নিয়ন্ত্রিত সংসদ নিয়ে যে তিনি হতাশ ছিলেন, তা তার বক্তব্যে স্পষ্ট ছিল। মঙ্গলবার রাতের ভাষণে তিনি সংসদকে 'উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংসকারী দানব' বলে আখ্যা দেন।
উত্তর কোরিয়া এবং 'রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি'র হুমকির উল্লেখ করে তিনি ডানপন্থী রক্ষণশীলদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেছিলেন, যারা প্রায়ই উদারপন্থী রাজনীতিবিদদের 'কমিউনিস্ট' বলে অভিহিত করে।
কিন্তু দেশের জনগণ ও রাজনীতিকে ভুলভাবে মূল্যায়ন করেছেন তিনি।
ইউনের আকস্মিক সামরিক আইনের ঘোষণাটি দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য এমন এক সময়ের দুঃসহ স্মৃতিকে ফিরিয়ে এনেছে, যা মানুষ ভুলে থাকতে চেয়েছিল। টেলিভিশনে সংবাদ উপস্থাপকদের এই সংবাদ জানানোর সময়ও হতবাক এবং ভীত দেখাচ্ছিল।
১৯৮০ সালে গণতন্ত্রকামী আন্দোলনকারীরা, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন ছাত্র, সামরিক আইন জারির প্রতিবাদে গোয়াংজু শহরের রাস্তায় নামেন। সেনাবাহিনী তাদের ওপর সহিংস আক্রমণ চালায়, যাতে প্রায় ২০০ জন নিহত হন।
সেই সময় দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারবিরোধী কর্মীদের গুপ্তচর আখ্যা দিয়ে গ্রেফতার বা হত্যা করা হতো। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তিন বছর সামরিক আইন জারি ছিল। কিন্তু সামরিক শাসন ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত চলমান ছিল।
তবুও, নির্বাচনী প্রচারের সময় ইউন স্বৈরাচারী জেনারেল চুন দু-হওয়ানের প্রশংসা করেছিলেন এবং বলেছিলেন, তিনি সরকারের কার্যক্রম ভালোভাবে পরিচালনা করেছিলেন—যদিও গণতন্ত্রকামী আন্দোলনকারীদের দমন নিয়ে সমালোচনা রয়েছে। পরে ইউন ক্ষমা চেয়ে বলেন, তিনি চুনের শাসনকে সমর্থন বা প্রশংসা করেননি।
এটি ইউনের ক্ষমতা নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা দেয়।
গত কয়েক মাস ধরে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন ছিল যে, ইউন সামরিক আইন জারি করতে পারেন। সেপ্টেম্বরে বিরোধী দলের নেতারা এই সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছিলেন, যদিও অধিকাংশই এটিকে চরমপন্থী এবং অযৌক্তিক বলে মনে করেছিলেন।
তবে ইউন হয়তো আরেকটি বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন—বিচারের ভয়।
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট পার্ক গিউন-হাই ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতির অভিযোগে কারাবন্দি হন। তার পূর্বসূরি লি মিয়ং-বাক স্টক মূল্য জালিয়াতি এবং ঘুষের জন্য ১৭ বছরের সাজা পান। আরেক প্রেসিডেন্ট রোহ মু-হিউন দুর্নীতির তদন্ত চলাকালে আত্মহত্যা করেন।
দক্ষিণ কোরিয়ায় বিচার কার্যক্রম প্রায়ই রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা বিরোধীদের জন্য এক ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। হয়তো এই কারণেই ইউন এমন চরম পদক্ষেপ নিয়েছেন।