পড়ে আছে ৩৫০ কোটি টাকার কর্ণফুলী টানেল রেস্ট হাউস, বেসরকারি খাতে দেয়ার পরিকল্পনা সরকারের
কর্ণফুলী টানেল সার্ভিস এরিয়ায় ৪৫০ কোটি রিসোর্ট বা রেস্ট হাউসের নির্মাণ প্রকল্প শেষ হয়েছে চলতি বছরের জুনে। এরপর থেকে এটি অব্যবহৃতই পড়ে রয়েছে। এ কারণে এখন এই রেস্ট হাউসটিকে বেসরকারি খাতে ইজারা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার।
বিপুল ব্যয়ের তুলনায় আয় অনেক কম হওয়ায় ব্যর্থ প্রকল্পে পরিণত হয়েছে কর্ণফুলী টানেল। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, এ টানেলের দৈনিক পরিচালন ব্যয় ৩৭.৪৪ লাখ টাকা, যেখানে টোল থেকে আয় হয় মাত্র ১০.৫০ লাখ টাকা। ফলে প্রতিদিন গড়ে ২৬ লাখ টাকার বেশি লোকসান দিচ্ছে সরকার।
সেতু কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পরিচালক কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'কর্ণফুলী টানেল সার্ভিস এরিয়া রিসোর্টটি আমরা বেসরকারি খাতে দেওয়ার পরিকল্পনা করছি। দ্রুত দরপত্র আহ্বান করা হবে। এসব বাংলো পর্যটন ব্যবসায় যুক্ত এমন কোনো প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হলে সরকারের লোকসান কমে আসবে।'
সেতু বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ১০ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা ব্যয়ের এ টানেল প্রকল্পের সার্ভিস এরিয়ায় মোট ৩০টি বাংলো রয়েছে। এছাড়া একটি ভিভিআইপি বাংলোও নির্মাণ করা হয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবকাশ কাটানোর চিন্তা করেই বাংলোটি নির্মাণ করা হয়েছে।
সেতু বিভাগের একজন ঊর্ধতন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে টিবিএসকে বলেন, 'ভিভিআইপি বাংলোটি প্রধানমন্ত্রী থাকার ব্যবস্থা রেখেই তৈরি করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা গাইডলাইন মেনে কাজ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী বা সর্বোচ্চ মন্ত্রী পর্যায়ের অতিথিদের থাকার জন্য এটি তৈরি করা হয়। সাধারণ মানুষদের জন্য অন্যান্য বাংলো নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু রিসোর্টটি উদ্বোধনের আগেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা।'
নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও স্থানীয়রা বলছেন, টানেল প্রকল্পটি ছিল অযৌক্তিক এবং উন্নয়নের নামে অর্থ লোপাটের জন্য।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, 'আগামী ৮ -১০ বছরের মধ্যে কর্ণফুলী টানেলের খরচ উঠবে না। তবে মিরসরাই শিল্পনগরী থেকে মেরিন ড্রাইভ হাইওয়েটি যদি টানেল হয়ে আনোয়ারা, বাঁশখালী, মহেশখালী, কক্সবাজার পর্যন্ত চলে যায়, তখন হয়তো পরবর্তীতে কাজে আসতে পারে টানেল প্রকল্প। কিন্তু এর সাথে সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা খরচ করে যে একটি রিসোর্ট গড়ে তোলা হলো, এগুলো পুরোপুরি অপ্রয়োজনীয়। টাকা লুটপাট করার জন্য এই প্রকল্পটি করা হয়েছে।'
৩ ডিসেম্বর রিসোর্ট পরিদর্শন করে দেখা যায়, আনসার ব্যাটালিয়ান সদস্যরা ভিভিআইওপি রেস্ট হাউসসহ বিভিন্ন স্থাপনার প্রহরায় রয়েছেন। বাংলো রক্ষণাবেক্ষণের কাজে রয়েছেন কিছু কর্মী। স্থাপনা পাহারায় রয়েছেন ৮০ জন ব্যাটালিয়ন আনসার সদস্য।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আনসার ব্যাটেলিয়ান সদস্য এবং রক্ষণাবেক্ষণ কর্মীরা বলেন, বাংলাগুলোতে অত্যাধুনিক আসবাবপত্র ও সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। মাঝে মাঝে সেতু কর্তৃপক্ষের ঊর্ধতন কর্মকর্তা এবং কিছু রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা, অতিথি এলেও প্রায় সময় ফাঁকাই থাকে পুরো রেস্ট হাউস এলাকা।
তারা জানান, রেস্ট হাউসটি জনসাধারণের জন্য কবে চালু হবে, তা নিয়ে এখনও কোনো নির্দেশনা নেই তাদের কাছে। সেতু কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া এখনও কাউকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না।
স্থানীয়দের বলেন, সার্ভিস এরিয়ার আশাপাশের এলাকার অন্তত ২০০ বাসিন্দা মৎস্য চাষ এবং পশুপালন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু এই প্রকল্পের কারণে গরু, মহিষসহ অন্যান্য গবাদিপশু বিক্রি করে দিতে হয়েছে তাদেরকে। এখন তাদের বিকল্প পেশা খুঁজতে হচ্ছে।
সাদা হাতি কর্ণফুলী টানেল
দক্ষিণ-পূর্ব চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত কর্ণফুলী টানেল। এর উত্তর প্রান্ত পতেঙ্গায়; চট্টগ্রাম বন্দর ও শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছাকাছি। টানেলটির দক্ষিণ প্রান্ত আনোয়ারা উপজেলায়। চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে পতেঙ্গা ও আনোয়ারা উপজেলাকে যুক্ত করেছে এ টানেল।
টানেলটির নির্মাণ ব্যয় প্রায় ১০ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ ৬০.৭৭ মিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালে উদ্বোধনের পর টানেলটি দিয়ে এখন প্রতিদিন গড়ে ৪ হাজারেরও কম যানবাহন চলাচল করে—যা আগে প্রক্ষেপণ করা সংখ্যার চার ভাগের এক ভাগেরও কম।
এতে টানেলটির দৈনিক আয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০.৫০ লাখ টাকা। অথচ টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণসহ আনুষঙ্গিক কাজে প্রতিদিন ব্যয় হচ্ছে গড়ে ৩৭.৫০ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতিদিনের ব্যয়ের বিপরীতে টোল আদায় থেকে খরচের এক-তৃতীয়াংশও উঠে আসছে না।
সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, ২০২২ সালের ২৮ অক্টোবর উদ্বোধনের পর থেকে ২০২৩ সালের ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত টানেলটি দিয়ে যাতায়াত করেছে প্রায় ১৪.৯৭ লাখ যানবাহন। এই সময়ে টানেল থেকে মোট আয় হয়েছে ৪০.৯ কোটি টাকা।
২০১৩ সালে চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি) পরিচালিত সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় কর্ণফুলী টানেল ২০১৭ সালে চালু হওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। সেইসঙ্গে প্রাক্কলন করা হয়েছিল, প্রথম বছরে টানেল দিয়ে দৈনিক গড়ে ১৭ হাজার ৩৭৪টি যানবাহন চলাচল করবে। এ সংখ্যা ২০২০ সালে বেড়ে ২০ হাজার ৭১৯ এবং ২০২৫ সালে ২৮ হাজার ৩০৫-এ পৌঁছাবে।
তবে সিসিসিসি একইসঙ্গে সমীক্ষা পরিচালনা এবং টানেল নির্মাণের কাজ করায় স্বার্থের সংঘাতের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যথাযথভাবে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়া অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী ও ত্রুটিপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন সরকারের ওপর ঋণ এবং অতিরিক্ত ব্যয়ের বোঝা তৈরি করেছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল হক টিবিএসকে বলেন, 'এরচেয়ে অনেক কম খরচে একটি সাসপেনশন ব্রিজ নির্মাণ করা যেত। জাপান, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া দুই কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ সাসপেনশন ব্রিজ তৈরি করেছে। অথচ আমরা পিছিয়ে রয়েছি। উল্টো ব্যয়বহুল এবং কম কার্যকর একটি প্রকল্পকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম আন্ডারওয়াটার টানেল হিসেবে প্রচারণা চালানো হয়েছে।