৫ লাখ ৬০ হাজার লাইসেন্স আটকা: হতাশ বিআরটিএ-এর গ্রাহক, বিদেশে যেতে পারছেন না অনেকে
বিদেশে চাকরির জন্য ড্রাইভিং ভিসা নিতে গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) থেকে স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আঙুলের ছাপ দিয়েছিলেন মো. আজমুল।
কিন্তু সময়মতো লাইসেন্স না পাওয়ায় সে চাকরিটি হাতছাড়া হয়ে যায় তার।
এক বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে গেলেও আজমুল এখনো স্মার্ট লাইসেন্স কার্ড পাননি। হতাশাজনক পরিস্থিতির কথা জানিয়ে তিনি বলেন, 'আগের চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি, কিন্তু বিদেশে যেতে পারিনি। এখন মারাত্মক আর্থিক সংকটে আছি।'
বিআরটিএর স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স বিতরণে ৫ লাখ ৬০ হাজার কার্ডের ব্যাকলগের কারণে হাজারো মানুষ একই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন।
বিআরটিএ কর্মকর্তারা এ বিলম্বের জন্য কার্ড সরবরাহে চুক্তি করা মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স (এমএসপি)-কে দায়ী করছেন। পলিকার্বোনেট কার্ডের সংকটের কারণের কথা উল্লেখ করেছে কোম্পানিটি।
বিআরটিএ অফিসের করিডোর ও কক্ষ প্রতিদিন হতাশ আবেদনকারীদের ভিড়ে পূর্ণ থাকে। তাদের মধ্যে অনেকেই বিদেশে চাকরি বা ড্রাইভিং ভিসার জন্য অপেক্ষা করছেন, কিন্তু প্রিন্ট করা ড্রাইভিং কার্ড পাচ্ছেন না।
'প্রতিদিন ২০-৩০ জন আবেদনকারীকে প্রধান কার্যালয়ে আসতে দেখি। অনেকেই শীর্ষ কর্মকর্তাদের সুপারিশপত্র নিয়ে আসেন,' বলেন বিআরটিএর এক সিনিয়র কর্মকর্তা।
বিআরটিএর পরিচালক (অপারেশন্স) মীর আহমেদ তরিকুল ওমর জানান, বর্তমানে ৫.৯ লাখ ড্রাইভিং লাইসেন্স কার্ডের ব্যাকলগ রয়েছে। তবে গত দুই সপ্তাহে এমএসপি ৩০ হাজারের বেশি কার্ড প্রিন্ট করে সরবরাহ করেছে।
তিনি আরও বলেন, 'কোম্পানিটি জানিয়েছে, তারা ৪.৭৫ লাখ কার্ডের চালান পেয়েছে। প্রতিদিন তিন শিফটে কাজ করে তারা প্রায় ১০ হাজার কার্ড প্রিন্ট করছে। ব্যাকলগ দ্রুত কমানোর চেষ্টা চলছে।'
২০২০ সালের জুলাইয়ে বিআরটিএ ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে ৪০ লাখ কার্ড সরবরাহের জন্য এমএসপি-র সঙ্গে ১২০ কোটি টাকার চুক্তি করেছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাত্র ২০ লাখ কার্ড সরবরাহ করা হয়েছে। বাকি কার্ড সরবরাহের জন্য সময় আছে মাত্র সাত মাস।
বিআরটিএ কর্মকর্তারা জানান, প্রতিদিন ২,০০০-৩,০০০ নতুন আবেদন জমা পড়ছে। ফলে ব্যাকলগ কমানো আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে।
এদিকে বিআরটিএ ই-পেপার ড্রাইভিং লাইসেন্সও সরবরাহ করছে। এতে আবেদনকারীরা কিউআর কোডসহ মেশিন-জেনারেটেড ডকুমেন্ট পাচ্ছেন, যা দিয়ে সারা দেশে গাড়ি চালানো যায়।
বিআরটিএর পরিচালক (প্রকৌশল) সিতাংশু শেখর বিশ্বাস জানান, প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি সংগ্রহের পর বিআরটিএর নিজেদের ব্যবস্থাপনায় ড্রাইভিং কার্ড সরবরাহের পরিকল্পনা রয়েছে। তবে, দ্রুত সমাধান না হলে তৃতীয় পক্ষকে এ সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব দেওয়া হবে।
স্মার্ট কার্ড বিতরণে বিলম্বের কারণে বিকল্প হিসেবে ই-ড্রাইভিং লাইসেন্সকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত করার চেষ্টা করছে বিআরটিএ।
এমএসপি নিয়ে সমস্যা
মীর আহমেদ তরিকুল ওমরের মতে, ভারতীয় কোম্পানি কার্ড তৈরির ক্ষেত্রে কয়েকটি সমস্যার কথা জানিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে এলসি (লেটার অফ ক্রেডিট) খোলার জটিলতা এবং আবেদনকারীদের ছবির মানের সমস্যা।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, 'অনেক সময় তাদের ফটোগ্রাফাররা নিম্নমানের ছবি তোলেন। গুণগত মান যাচাইয়ের সময় অনেক কার্ড বাতিল করা হয়, ফলে আবেদনকারীদের নতুন করে ছবি তুলতে হয়। এতে প্রক্রিয়া আরও বিলম্বিত হয়। হতাশ হয়ে কিছু আবেদনকারী নিম্নমানের ছবি দিয়েই লাইসেন্স গ্রহণে রাজি হচ্ছেন।'
তিনি আরও জানান, 'আমরা তাদের এক মাসের মধ্যে মুলতুবি থাকা সব কার্ড বিতরণের নির্দেশ দিয়েছি।'
বিআরটিএ এমএসপির ওপর চাপ তৈরি করতে অর্থ প্রদান স্থগিত করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'আমরা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছি, যতদিন সব মুলতুবি কার্ড বিতরণ না হবে, ততদিন কোনো বিল পরিশোধ করা হবে না। এছাড়া, ছবি তোলার সময় মান যাচাই নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। আমরা আর কোনো বিলম্ব মেনে নেব না।'
এদিকে, এমএসপি আগামী চার মাসের মধ্যে ব্যাকলগ সমস্যার সমাধান করতে আশাবাদী।
এমএসপির আইটি প্রজেক্ট ম্যানেজার আহমেদ কানি জানান, 'আমরা ইতোমধ্যে ৪ লাখ কার্ড পেয়েছি এবং অতিরিক্ত ৫ লাখ কার্ডের জন্য এলসি খোলার প্রক্রিয়া চলছে। আমরা দিনে ২৪ ঘণ্টা কাজ করছি এবং প্রতিদিন প্রায় ১০,০০০ লাইসেন্স প্রিন্ট করছি। এতে ৩-৪ মাসের মধ্যে ব্যাকলগ দূর হবে।'
তিনি আরও আশ্বস্ত করে বলেন, 'আমাদের দৈনিক প্রিন্টিং সক্ষমতা চাহিদার প্রায় দ্বিগুণ। বিআরটিএ প্রতিদিন প্রায় ৬,০০০ লাইসেন্স প্রক্রিয়া করলেও আমরা ১০,০০০ কার্ড প্রিন্ট করতে পারছি।'
ব্যাকলগের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কানি জানান, জুলাই থেকে বাংলাদেশের পরিস্থিতির কারণে এলসি খোলায় বিলম্ব হয়েছে এবং অন্যান্য চ্যালেঞ্জও ছিল। তবে এলসি সংক্রান্ত নির্দিষ্ট সমস্যার বিষয়ে তিনি বিস্তারিত জানাতে অস্বীকৃতি জানান।
এমএসপির কার্যক্রম তদারকি দায়িত্বে থাকা বিআরটিএর একজন কর্মকর্তা বলেন, গত তিন মাসে স্টকের সংকটের কারণে এমএসপি প্রতিদিন মাত্র ২০০-৩০০ কার্ড তৈরি করতে পেরেছে। ছয় মাসের মধ্যে ৪ লাখ ৭৫ হাজার কার্ডের চালানটি ছিল সবচেয়ে বড়।
তিনি বলেন, 'এমএসপির সঙ্গে কাজ করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা প্রায়ই সময়সীমা পূরণে ব্যর্থ হওয়ার অজুহাত দেয়। আগের সরকারের সময় বিআরটিএ ভারতীয় কোম্পানির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারেনি, তবে এখন সমাধানের চেষ্টা চলছে।'
এ কর্মকর্তা আরও জানান, বিআরটিএ আগামী বছরের জুন পর্যন্ত যত সংখ্যক স্মার্ট কার্ড সরবরাহ করা যায় সে চেষ্টা করবে, তারপর বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনা করছে।
পোস্ট অফিসে দেরি
বিআরটিএ আবেদনকারীদের স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স তাদের দেওয়া ঠিকানায় ডাক বিভাগের মাধ্যমে সরবরাহ করে। তবে, প্রায়ই অভিযোগ পাওয়া যায় যে ডাক বিভাগের বিলম্বের কারণে আবেদনকারীরা সময়মতো তাদের কার্ড পান না।
ডাক অধিদপ্তরের পরিচালক (মেইল) মো. জাকির হাসান নূর জানান, লাইসেন্স বিতরণে বিলম্বের পেছনে বেশ কিছু সিস্টেম-সংক্রান্ত সমস্যা রয়েছে।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, 'অনেক সময় বিআরটিএ আমাদের ব্যাকডেটেড কার্ড পাঠায়, যার কারণে ডেলিভারিতে বিলম্বের ধারণা তৈরি হয়।'
তিনি আরও জানান, 'এর আগে বিআরটিএ প্রতিদিন আমাদের কাছে ৩,০০০ থেকে ৪,০০০ কার্ড পাঠাত। আমরা সে অনুযায়ী প্রতিদিন ৫,০০০ কার্ড প্রক্রিয়াকরণের ব্যবস্থা করেছিলাম। এ প্রক্রিয়ায় সিস্টেম এন্ট্রি, বিআরটিএর সার্ভারের সঙ্গে পুনঃচেকিং এবং প্যাকেজিং অন্তর্ভুক্ত ছিল।'
'কিন্তু কয়েক দিন আগে হঠাৎ একসঙ্গে ৪০,০০০ কার্ড পাঠানো হয়। এত বড় ব্যাচ প্রক্রিয়াকরণে স্বাভাবিকভাবেই সময় লেগেছে। তবে, আমরা টানা কাজ করে কয়েক দিনের মধ্যেই এ ব্যাকলগ সমাধান করেছি,' তিনি উল্লেখ করেন।
ডেলিভারি টাইমলাইন সম্পর্কে জাকির হাসান বলেন, 'আমাদের সঙ্গে সাত দিনের মধ্যে লাইসেন্স বিতরণের একটি চুক্তি রয়েছে। সাধারণত আমরা কার্ড পাওয়ার তিন দিনের মধ্যে প্রাপকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করি। তবে, যদি প্রাপক অনুপস্থিত থাকেন, সেক্ষেত্রে কার্ডটি নিকটস্থ পোস্ট অফিসে সাত দিন পর্যন্ত রাখা হয়। এরপরও কার্ড ডেলিভারি করা না গেলে, সেটি বিআরটিএতে ফেরত পাঠানো হয়।'
তিনি সময়মতো ডেলিভারির বিষয়ে বিভাগের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, 'আমরা বিলম্বের বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক। আসলে এই কিছুদিন আগেই আমরা একজন কর্মচারীকে দেরিতে ডেলিভারির দায়ে সাসপেন্ড করেছি।'
বিলম্বে জর্জরিত প্রকল্প
স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স কার্ডে একটি ডিজিটাল ডেটা চিপ সংযুক্ত থাকে, যা ড্রাইভারের তথ্য সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়।
বিআরটিএ ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে চিপযুক্ত ডিজিটাল স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স বিতরণ শুরু করে। এর আগে, ২০০৫ সালে ড্রাইভিং লাইসেন্স জালিয়াতি রোধে প্লাস্টিক কার্ড চালু করা হয়েছিল।
স্মার্ট কার্ড বিতরণের জন্য বিআরটিএ দীর্ঘকাল থেকেই বিভিন্ন ঠিকাদারের ওপর নির্ভর করেছে। এমএসপির আগে স্থানীয় প্রতিষ্ঠান টাইগার আইটি বাংলাদেশ লিমিটেড একটি ফরাসি কোম্পানির সহযোগিতায় এ কাজটি করত।
তবে, ২০১৮ সালে বিআরটিএ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান টাইগার আইটির সঙ্গে চুক্তি নবায়ন করতে ব্যর্থ হয়। এর ফলে প্রকল্পটি অচল হয়ে পড়ে। টাইগার আইটি বিশ্বব্যাংকের কালো তালিকাভুক্ত হওয়ায় এ সংকট তৈরি হয়েছিল।
এরপর বিআরটিএ নতুন ঠিকাদার খুঁজতে শুরু করে, কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় দেড় বছর সময় লেগে যায়। অবশেষে, ভারতীয় প্রতিষ্ঠান মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স (এমএসপি) ২০১৯ সালে স্মার্ট কার্ড মুদ্রণের কার্যাদেশ পায় এবং বাংলাদেশে একটি কারখানা স্থাপন করে।
এদিকে, স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স বিতরণের জন্য মুলতুবি থাকা কার্ডগুলো মুদ্রণের লক্ষ্যে বিআরটিএ ২০২১ সালের ২৯ আগস্ট বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ)-এর সঙ্গে একটি পৃথক চুক্তি স্বাক্ষর করে। এমএসপি কাজ শুরু করার আগ পর্যন্ত সেনাবাহিনী পরিচালিত এ কারখানাটি পূর্ববর্তী ঠিকাদার টাইগার আইটির রেখে যাওয়া ব্যাকলগ পরিষ্কার করে ১২ লাখ ৫০ হাজার কার্ড সরবরাহ করে।