ভুল পরিকল্পনা, যেনতেন সম্ভাব্যতা সমীক্ষা…ভাঙ্গা মহাকাশ অবলোকন কেন্দ্রের সবকিছু যেভাবে ভজকট পাকিয়ে গেল
বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে যেসব সাধারণ সমস্যা বেশি দেখা যায়, সেগুলো থেকে রেহাই পায়নি মহাকাশ অবলোকন কেন্দ্র নির্মাণের মতো কঠোর বৈজ্ঞানিক ও গাণিতিক নির্ভুলতা দাবি করা জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রকল্পও।
ভুল জায়গা বাছাই, ভুল পরিকল্পনা, যেনতেনভাবে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা—সবকিছুতেই গলদ ছিল ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলায় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া এই প্রকল্পে।
তিন বছর এবং সাড়ে ৬ কোটি টাকারও বেশি ব্যয় হওয়ার পর প্রকল্পটি এখন বাতিল হওয়ার মুখে।
২০২১ সালে ২১৩ কোটি টাকা বাজেটের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাকাশ অবলোকন কেন্দ্র প্রকল্পটির অনুমোদন দেওয়া হয়। অনন্য ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে ভাঙ্গার ভাঙ্গারদিয়া গ্রামে মহাকাশ অবলোকন কেন্দ্রটি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বলা হয়েছিল, কর্কটক্রান্তি রেখা—যে কাল্পনিক রেখা বরাবর সুর সরাসরি কিরণ দেয়—এবং ৯০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমার ছেদবিন্দুতে অবস্থিত হওয়াই মহাকাশ অবলোকন কেন্দ্রের এই অবস্থানের অনন্য বৈশিষ্ট্য।
তবে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের কর্মকর্তারা এখন বলছেন, ভাঙ্গায় ৯০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমা রেখা ও কর্কটক্রান্তি রেখার ছেদবিন্দুর অবস্থান প্রতি বছর ১৫ মিটার করে দক্ষিণ দিকে সরে যাচ্ছে।
কর্মকর্তারা জানান, ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত চার বছরে ওই ছেদবিন্দু ৬০ মিটার দক্ষিণে সরে গিয়ে প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা জমির দক্ষিণ সীমানার প্রায় শেষ প্রান্তে অবস্থান করছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ ছেদবিন্দু আরও সরে যাবে। ফলে প্রকল্পের অবস্থানটি ক্রমেই গুরুত্ব হারাচ্ছে।
তারা আরও বলছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য নির্বাচিত স্থানে কৃত্রিম আলোর উপস্থিতি ও বাতাসের আর্দ্রতার আধিক্য থাকায় পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থেকে টেলিস্কোপের মাধ্যমে প্রাপ্ত উপাত্ত মহাকাশ গবেষণার কাজে ব্যবহারের জন্য ততটা উপযোগী হবে না।
জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের মহাপরিচালক মুনিরা সুলতানা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এই প্রকল্পটির এখন আর প্রয়োজন নেই। দ্রাঘিমা রেখা ও কর্কটক্রান্তি রেখার ছেদবিন্দুর অবস্থান প্রতি বছর সরে যাচ্ছে। প্রকল্পটি থেকে সুফল পেতে হলে আরো অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে।'
অপ্রাসঙ্গিক অনন্যতার 'উদ্ভাবন'
বিষুবরেখা, কর্কটক্রান্তি রেখা ও মকরক্রান্তি রেখা—এই তিনটি কাল্পনিক রেখা পূর্ব থেকে পশ্চিমে পৃথিবীকে বেষ্টন করে রেখেছে। অন্যদিকে শূন্য (০) ডিগ্রি, ৯০ ডিগ্রি পূর্ব, ১৮০ ডিগ্রি পূর্ব-পশ্চিম ও ৯০ ডিগ্রি পশ্চিম—এই চারটি দ্রাঘিমা রেখা উত্তর থেকে দক্ষিণে পৃথিবীকে ঘিরে রেখেছে।
পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত এই তিনটি রেখা এবং উত্তর-দক্ষিণে প্রসারিত চারটি দ্রাঘিমার সংযোগস্থল মোট ১২টি ছেদবিন্দু তৈরি করেছে। এর মধ্যে ১০টি ছেদবিন্দুই মহাসাগরে অবস্থিত। কেবল দুটি ছেদবিন্দু রয়েছে স্থলভাগে।
স্থলভাগে থাকা দুটি ছেদবিন্দুর সংযোগস্থলের একটি সাহারা মরুভূমিতে, অপরটি ফরিদপুরের ভাঙ্গায়। ১২টি ছেদবিন্দুর মধ্যে ভাঙ্গার এই বিন্দুই ভ্রমণকারীরা সহজে দেখতে যেতে পারেন।
লেখক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল প্রথম এই বিষয়টি জনসাধারণের নজরে আনেন। ২০১৯ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন কমিটির এক সভায় তিনি ভাঙ্গায় একটি 'বঙ্গবন্ধু মহাকাশ অবলোকন কেন্দ্র' নির্মাণের প্রস্তাব দেন।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে প্রকল্প প্রস্তুতের নির্দেশ দেন।
২০২১ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) প্রকল্পটি অনুমোদন করে। ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্কটক্রান্তি রেখা এবং ৯০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমার ছেদবিন্দু একটি জাতীয় মহাকাশ অবলোকন কেন্দ্র নির্মাণের জন্য বৈজ্ঞানিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়।
তারা বলছেন, মহাকাশ অবলোকন কেন্দ্র নির্মাণস্থল বাছাইয়ের জন্য প্রধান বিবেচ্য বিষয় হলো রাতের আকাশ কতদিন পরিষ্কার থাকে, সেই সংখ্যা; কৃত্রিম আলোর দূষণ না থাকা এবং আপেক্ষিক আর্দ্রতা কম হওয়া।
বুয়েটের অধ্যাপক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী বলেন, দ্রাঘিমা রেখাগুলো মানুষের সুবিধার্থে তৈরি কাল্পনিক রেখা। এগুলো মান সময় নির্ধারণসহ অন্যান্য ব্যবহারিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য মানুষের সুবিধার্থে তৈরি করা হয়েছে। এসব রেখার সঙ্গে মহাকাশ অবলোকন বা অপটিক্যাল ও রেডিও ওয়েভ গবেষণার সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই।
তিনি আরও বলেন, ঘূর্ণন অক্ষ ধীরে ধীরে বদলানোর কারণে পৃথিবীর ঢাল সময়ের সঙ্গে বদলায়। এর ফলে ছেদবিন্দুটি প্রতি শতাব্দীতে প্রায় ৪৭ সেকেন্ড দক্ষিণে সরে যায়, যা ১০০ বছরে প্রায় ১.৫ কিলোমিটার সরে যাওয়ার সমান।
প্রকল্প বাতিলের সিদ্ধান্ত
গত ১৭ নভেম্বর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোকাব্বির হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত স্টিয়ারিং কমিটির সভায় প্রকল্পটি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সভায় কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পের আওতায় পরিকল্পিত মহাকাশ অবলোকন কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের ডোম ভূমি থেকে প্রায় ১৭২ ফুট উচ্চতায় স্থাপনের জন্য নকশা করা হয়েছিল। এই উচ্চতায় টাওয়ারটি সম্পূর্ণ নিশ্চল রাখা দুরূহ হবে। অন্যদিকে টাওয়ার নিশ্চল রাখার জন্য ভিত্তিমূল দৃঢ় করা হলে প্রকল্প ব্যয় বহুলাংশে বেড়ে যাবে, যা কারিগরি ও আর্থিকভাবে কখনোই উপযোগী নয়।
কর্মকর্তারা বলেন, অতি দ্রুততার সঙ্গে প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়ন ও অনুমোদনের ফলে সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় গুরুতর ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে যায়।
প্রকল্প প্রস্তাব অনুসারে, ১০ একর জমির ওপর পাঁচতলা বৃত্তাকার (আংটি আকৃতির) একটি ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এর কেন্দ্রে পৃথক ভিত্তিমূল থেকে ১ মিটার ব্যাসের একটি মূল পর্যবেক্ষণ টাওয়ার তৈরির নকশা করা হয়েছিল।
পরিকল্পনা ছিল, টাওয়ারটিতে ১০ মিটার ব্যাসের অনুভূমিকভাবে ঘূর্ণায়মান একটি প্ল্যাটফর্ম স্থাপন করা হবে, যেখানে রেইফ্লেক্টর টেলিস্কোপ স্থাপন করা যাবে। পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের ভূমিস্তর এবং বৃত্তাকার প্ল্যাটফর্মকে সেকেন্ডারি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
টাওয়ারটির উচ্চতা ১০০ মিটার নির্ধারণ করা হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী স্মরণে। পাঁচতলা বৃত্তাকার ভবনটিতে অফিস কক্ষ, শ্রেণিকক্ষ, গবেষণাগার ও আবাসনের ব্যবস্থা রাখা হতো। সম্পূর্ণ প্রকল্পের অর্থায়ন করত সরকার।
দুর্বল সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় উন্নয়ন প্রকল্পের সর্বনাশ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্প গ্রহণের আগে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করার বিধান থাকলেও বাংলাদেশে অনেক সময় প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরই এই সমীক্ষা করা হয়।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, গত কয়েক বছরে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো তাড়াহুড়ো করে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। একে তিনি 'বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি' বলে অভিহিত করেন।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, 'সম্ভাব্যতা সমীক্ষাগুলো সাধারণত প্রকল্পের পক্ষেই মতো দেয়। এগুলোতে প্রকল্পের নেতিবাচক তুলে ধরা হয় না।'
তিনি আরও বলেন, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় চলমান প্রকল্পগুলোর নকশা যথাযথভাবে করা হয়েছে কি না, তা যাচাই করতে সাময়িকভাবে কাজ বন্ধ রাখা জরুরি।
জাহিদ হোসেন বলেন, 'একটি ভালো প্রকল্পও খারাপ নকশার কারণে ব্যর্থ হতে পারে। কিছু অর্থ ইতিমধ্যে ব্যয় হয়ে গেলেও ভবিষ্যতে আরও অপচয় ঠেকাতে এখনই এসব প্রকল্প বন্ধ করা উচিত।'
তিনি বলেন, সম্প্রতি অনেকেই দাবি করছেন, উন্নয়ন বাজেট কমানো হলে প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। 'এটা একেবারেই হাইপোথিটিক্যাল যুক্তি। খারাপ প্রকল্প বাস্তবায়ন কি আসলেই প্রবৃদ্ধি বাড়ায়?'