পান–জর্দা: জেনেশুনে বিষ করছেন পান?
ছোট্টবেলায় ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসি ছড়াখানা শুনতে শুনতে মায়ের কোলের মধ্যে ঘুমোননি এমন মানুষ খুব বেশি পাওয়া যাবে না। যে ছড়াখানার কথা বলছি ঠাহর করতে পারছেন তো?
'ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসি মোদের বাড়ি এসো,
খাট নাই পালং নাই, খোকার চোখে বসো।
বাটা ভরে পান দেব, গাল ভরে খেয়ো,
খোকার চোখে ঘুম নাই, ঘুম দিয়ে যেয়ো।'
হ্যাঁ, হ্যাঁ, এটাই। তা হঠাৎ করে এতদিন পরে এ ছড়ার কথা কেন মনে করিয়ে দিলাম বলুন তো? মনে করালাম পান প্রসঙ্গে। সে ছেলেবেলায়, স্কুলের পাট শুরু হওয়ার আগেই যখন মুখে মুখে ছড়া শুনে শিখছি, সে সময়কার ছড়াতে ছিল পানের কথা। বাটা ভরে পান দেওয়ার কথা। তাহলেই বুঝতে পারছেন, বাঙালি সংস্কৃতিতে অতিথি আপ্যায়নে পানের কদর কতখানি!
পান এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার সংস্কৃতির এক অনবদ্য অংশ। বিয়ে থেকে নানা সামাজিক অনুষ্ঠান, এমনকি মৃত্যুর আনুষ্ঠানিকতায়ও পানের ব্যবহার বেশ পরিচিত। পানকে এক কথায় 'বাঙালির চুইংগাম' বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না।
কাজের অবসরে গ্রামের মা-বউরা গল্পগাছা করতে করতে পান চিবুনোর দৃশ্য আমাদের বাংলাদেশের যেকোনো গ্রামে গেলেই দেখা সম্ভব। শুধু যে গ্রাম তা নয়, শহুরে মানুষও পান খাওয়াতে পিছিয়ে নেই। বাঙালির উৎসব আয়োজনে খাওয়াদাওয়ার শেষপর্বে মিষ্টিমুখ যেমন অপরিহার্য ঠিক তেমনি পান, সুপারি ছাড়াও ভোজবাড়ি যেন জমে না। বিশেষ করে বয়স্ক অতিথিদের জন্যে পানের একটা আয়োজন রাখতেই হয়।
থালায় করে খিলি পান, সুপারি, কখনো বা পান সেজে খাওয়ার জন্যে থাকে নানা রকমের জর্দাও। এমন নানা রঙের জর্দা, পান মশলার বাহার আর থরে থরে সাজিয়ে রাখা পান পাতা দেখলে যে কখনো পান খায়নি, তারও মনে হবে, একবার চেখে দেখাই যাক না।
'একখান পান চাইলাম পান দিলে না
তোমার সনে কিসের পিরিতি?'
পণ্ডিত রামকানাই দাসের এ গানখানা থেকে পান দেওয়া-নেওয়ার রীতি সম্পর্কে আন্দাজ করা যায়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'বামুনের মেয়ে' উপন্যাসে মূল চরিত্র সন্ধ্যা কর্তৃক নায়ক অরুণকে পান সেজে খাওয়ানোর উল্লেখ আছে। আমাদের ছেলেবেলায় অনেকেরই পানের সঙ্গে প্রথম আলাপ দাদি-ঠাকুরমার হাত ধরে। দাদি-ঠাকুরমা যেখানেই যাক না কেন, পানের কৌটোখানা সঙ্গে নিতে ভুলত না। কৌটোখানা হতো চৌকো কিংবা গোল, কৌটোর ভেতর ভাগ ভাগ করা আলাদা জায়গা। ভেতরে থাকত সুপারি, জর্দা, চুনসহ পান তৈরির নানা উপকরণ।
বাঙালির কোনো রান্নাবান্না মানেই মশলার বাহার, এটা চাই, ওটা চাই। তা পান-ই-বা বাদ যাবে কেন? প্রাচীনকালের পানপাতা খাওয়ার রীতিটাকেই নানা বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন মশলা, জর্দার ব্যবহারে আজকের রূপে নিয়ে আসা হয়।
খয়েরের ব্যবহারে ঠোঁট লাল হয় কিংবা মিষ্টি জর্দায় মুখ একটু মিষ্টি মিষ্টি হয়ে ওঠে — এমনভাবে পানের আনুষঙ্গিক জর্দা-মশলার প্রচলন। তবে পান, জর্দা কিন্তু শুধু বাঙালিরই নয়, অবাঙালিদের মধ্যেও বেশ জনপ্রিয়।
আজকের দিনে এসে স্রেফ পানপাতা কেউ আর খায় না। এখন ঘরের মা-দাদিদের পানের কৌটোর বাইরে মশলা পানই বলতে গেলে বেশি চলে। পান, সুপারি, চুন, খয়ের, কয়েক রকমের জর্দা, নানা স্বাদ ও গন্ধের মশলা দিয়ে সাজানো হয় পান।
যারা পান খান না তাদের এ সম্পর্কে খুব একটা ধারণা হয়তো নেই। কিন্তু যারা পান ভালোবেসে খান, তাদের কাছে পান-জর্দা একটা আবেগের জায়গা। চা-সিগারেটের মতো করে পান-জর্দা এক শ্রেণির মানুষের নেশাও বটে।
পানের আছে ওষধি গুণ
যারা পানের নাম শুনলেই নাক সিটকান তারা অনেকেই পানের গুণাগুণ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। পানপাতা শুধু নববধূর লজ্জাবনত মুখ ঢাকতেই নয়, পানপাতা ব্যবহৃত হয় নানা রোগের চিকিৎসায়। আয়ুর্বেদমতে, পানের ভেষজ গুণ অনেক।
এ পাতা খাবার হজমের পাশাপাশি ডায়াবেটিস, বাতের ব্যথা নিয়ন্ত্রণে বেশ কার্যকর। ক্যানসার প্রতিরোধেও পানপাতার জুড়ি মেলা ভার। পান পাতায় থাকে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল যৌগ, যা মুখের দুর্গন্ধ দূর করে। এছাড়া কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ, সর্দি-কাশি, হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিসের মতো রোগের চিকিৎসায় পানের রস খুবই উপযোগী।
পান-জর্দা নিয়ে যত কথা
পানের সঙ্গে জর্দা মিশিয়ে একসঙ্গে খাওয়ার প্রচলন কে কবে নাগাদ করেছিল তা সময়-তারিখ হিসেবে বলা মুশকিল। তবে পান-জর্দার এ সংমিশ্রণ খুব তাড়াতাড়িই জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। এর একটা কারণ হতে পারে নেশার বোধ। জর্দা তৈরি হয় তামাকজাত দ্রব্যের মাধ্যমে। তাই নেশা ধরতে খুব বেশি সময় লাগে না।
কৌতুহলবশত এক-আধবার খাওয়া শুরু করলে সেটাই যে কবে অভ্যেস হয়ে যায় তা যিনি খান তিনিও বুঝে উঠতে পারেন না। এভাবেই পান-জর্দার কম্বিনেশন গ্রাম থেকে গঞ্জ, গঞ্জ থেকে শহরে ছড়িয়ে পড়ে। আজকাল পানের দোকানের পাশাপাশি চায়ের ঠেকগুলোতেও পান-জর্দা বেচাকেনা হয়।
যদিও গোল ধরনের ছোটো ছোটো কৌটোতে ভর্তি জর্দা বাজারে আলাদাভাবে কিনতে পাওয়া যায়। তবু নেশার একটা আয়েশ বলে কথা আছে না? চাপ্রেমীরা বাড়িতে যতই চা খেয়ে থাকুন না কেন, আলাপ করতে বসলে রাস্তার পাশের দোকান থেকে কী দু-এক কাপ চা না হলে চলে? পানের ব্যাপারটাও অনেকটা সেরকম। আয়েশ করে পায়ের ওপর পা তুলে বসে সাজা পান না খেলে নেশাটা জমে না।
জর্দার রকমফের
জর্দার বিশেষত্ব মূলত গন্ধ। যারা জর্দা সেবন করেন নিয়মিত, তারা গন্ধের মাদকতায় পড়েন। জর্দা দিয়ে পান খেতে ভালোবাসেন এমন কিছু মানুষের সঙ্গে কথা হলো এ ব্যাপারে। সবার মুখেই সবার প্রথমে শোনা গেল কানপুর জর্দার স্তুতি। কানপুর জর্দার জনপ্রিয়তার কারণ অনুসন্ধানে জানা গেল, এটি বাজেট বান্ধব।
প্যাকেটজাত করে বিক্রি হওয়া এ জর্দার দাম ১২ টাকা। তাই শ্রেণি-পেশা ব্যতিরেকে যে কেউ কিনে খেতে পারেন। পাশাপাশি কানপুর জর্দার গন্ধ একেবারেই উগ্র নয়।
এদিকে হেনা জর্দা যারা খান, তারা হেনার মিষ্টি গন্ধের প্রতি আকৃষ্ট হন। এ জর্দায় ম্যানথলের পরিমাণ থাকে সীমিত। দাম কানপুরের তুলনায় বেশিই বলতে হবে; কৌটাপ্রতি ৩০টাকা।
সোনালী লাল রঙা প্যাকেটের গায়ে লেখা জাফরানী ও মৃগনাভী দ্বারা প্রস্তুত। অনুমান করুন তো, কোন জর্দার কথা বলছি? এ জর্দা ব্র্যান্ডের নাম 'ন্যাশনাল পাতি জর্দা'। জর্দাপ্রেমীদের কাছে ন্যাশনাল বেশ পরিচিত নাম। কানপুর কিংবা হেনা জর্দা অনেকটা গুড়ো গুড়ো ধরনের শুকনো, কিন্তু ন্যাশনাল জর্দা আবার ভেজা।
এ ভেজা ভাবটার জন্যেই অনেকের কাছে এ জর্দা পছন্দনীয়। দামখানাও অবশ্য বেশি, প্যাকেটপ্রতি ৫০ টাকা। জাফরানী কিংবা মৃগনাভী দিয়ে এ জর্দা আদতেই প্রস্তুত হোক বা না হোক, গন্ধ যে সুন্দর তা স্বীকার করতেই হবে।
চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর অঞ্চলের একখানা জনপ্রিয় জর্দা হচ্ছে দুলাল জর্দা। ঐ অঞ্চলে তামাকের চাষটা বেশি। তাই দুলাল জর্দা সরাসরি তামাক পাতা থেকে প্রস্তুত করা হয়। যার কারণে তামাকের একটা কড়া গন্ধ থাকে।
তবে আঞ্চলিকতাকে ছাপিয়ে দুলাল জর্দা সারা বাংলাদেশেই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এছাড়া রয়েছে নিকোটিন ফ্রি গোবিন্দ জর্দা। মশলার কৌটার মতন কৌটায় করে এ জর্দা বিক্রি হয়।
শাহী, মীর্জাপুর, মতী স্পেশাল, চানবাহার, সুরভী, সিয়াম তাম্বুল, কেশরী, মুহাজিদ, শোভা, বাবা, জাফরানী প্রভৃতি জর্দা খুলনা বিভাগে বেশ জনপ্রিয়। বিভাগ অনুসারে জর্দার ব্র্যান্ড ও পছন্দের তারতম্য থাকে। আবার কিছু কিছু জর্দা দেশব্যাপী ভালো চলে।
এ সমস্ত ব্র্যান্ডেড জর্দার বাইরে ধনিয়া, মৌরি, কালোজিরার সঙ্গে তামাকপাতা ভেজে এক ধরনের জর্দা তৈরি করেন কেউ কেউ। আবার কেউ বা জামের পাতা রোদে শুকানোর পর আগুনে পুড়িয়ে ছাই করেন। সে ছাই তামাক পাতার গুড়ার সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়া হয়।
এরকম আরও অনেক ঘরোয়া জর্দার প্রচলন আছে গ্রামের দিকটাতে।
সাজা পান
সাতক্ষীরার ডে-নাইট কলেজ মোড়ের পান বিক্রেতা আবু বক্কর। প্রায় ১৮–২০ বছর ধরে এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আবু বক্কর। তার এ এক চিলতে দোকানে দেখা গেল ১০–১৫ প্রকারের জর্দা।
বাজারে যদিও ৫০–৬০ রকমের জর্দা পাওয়া যায়, তবে তিনি সবচেয়ে জনপ্রিয় ১০–১৫ প্রকারের জর্দাই রাখেন। অন্যগুলো খুব একটা চলে না।
সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত ক্রেতার পছন্দ অনুযায়ী জর্দা দিয়ে পান সাজেন আবু বক্কর। ডে-নাইট কলেজ মোড়ের আশপাশের দোকানদার, ভ্যানচালকরা তার ধরাবাঁধা খদ্দের। এছাড়া পথচলতি অচেনা মানুষও আসেন মাঝেমধ্যে।
পানের মশলা জর্দার ওপর ভিত্তি করে সাজা পান প্রতি দাম ৫–১০ টাকার মধ্যেই থাকে তার দোকান। বিভিন্ন জর্দারই টুকটাক জনপ্রিয়তা আছে। তবে কি না সবচেয়ে জনপ্রিয়টি মিষ্টি জর্দা, নাম পানপরাগ। লালচে রঙের এ জর্দা পানের ঝাঁঝালো ভাবটাকে সুমিষ্ট করে দেয়।
এ জর্দায় পিপারমেন্টের ব্যবহারের কারণে মুখে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুখের ভেতরটা ঠান্ডা-ঠান্ডা হয়ে যায়। সঙ্গে পানটা হয়ে ওঠে মোলায়েম। গরমের দিনে এক ধরনের স্বস্তি যেন পাওয়া যায়।
বেশ কিছু বছর ধরে পানের বরজে কীটনাশক ব্যবহারের কারণে পানের স্বাদে পরিবর্তন এসেছে। আগে পানপাতায় ঝাঁঝ পাওয়া যেত বেশি। এখন অনেক পানপাতায় একটা তেতো স্বাদ থাকে।
তাই কিনে আনা পান পরিষ্কার পানি দিয়ে বারবার করে ধোয়া হয়। এরপর পান সাজার সময় চুনের প্রলেপ দেওয়া হয় পুরু করে। এতে তেতো ভাবটা কাটে, খেতে ততটাও খারাপ আর লাগে না। পান সাজতে সাজতে এই পানদোকানি বলে যাচ্ছিলেন এমন সব কথা।
সাতক্ষীরার বড় বাজার পাইকারি ঘরের স্বত্বাধিকারী নুরজ্জামান। প্রায় ৫৬ বছর ধরে পান সেজে বিক্রির কাজ করেন তিনি। নুরুজ্জামান জানালেন, পাকিস্তান আমল থেকে তার এই পৈতৃক পানের দোকান। বাবার পরে তিনি এ দোকান চালাচ্ছেন।
তার নিজেরও পানের প্রতি ভালো লাগা আছে। তবে জর্দা কখনো খাননি। এ দোকানে দেখা গেল ৮ থেকে ১০ প্রকারের জর্দা। চান বাহার ও সুরভী জর্দাটাই বেশি চলে। অন্যগুলোর খরিদ্দার কম।
জেনেশুনে বিষ করছেন পান?
জর্দার গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে কৌটার পর কৌটা জর্দা সেবন করে নিজের সর্বনাশ করছেন না তো? এ বিষপান কি জেনেশুনেই করছেন জর্দার ভোক্তারা? না, অনেক জর্দাপ্রেমী মানুষই জর্দার ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন না।
নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে এক ধরনের বদ্ধমূল ধারণা আছে, ধোঁয়াযুক্ত নেশাদ্রব্যই শরীরের জন্যে ক্ষতিকারক, অন্য কোনোকিছু অতটা ক্ষতি করে না। প্রকৃতপক্ষে, জর্দা স্লো পয়জনিং করে। ক্ষতিটা হয় আস্তে আস্তে। কিন্তু পরিণতি ভয়াবহ।
ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) (সংশোধন) আইন, ২০১৩-এর ১০(১) ধারা অনুযায়ী, সব তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেট, মোড়ক, কার্টুন বা কৌটার দুই পাশেই স্বাস্থ্য সতর্কবাণী মুদ্রণ করা বাধ্যতামূলক। এ সতর্কবাণীতে তামাক ব্যবহারের কারণে সৃষ্ট ক্ষতি সম্পর্কে রঙিন ছবি ও লেখা থাকতে হয়। প্রদর্শনী তলের উপরিভাগে এটি প্যাকেটের অন্তত ৫০ শতাংশ জায়গা জুড়ে থাকতে হবে। সতর্কবাণীর সমস্ত লেখা ও ছবি বাংলায় মুদ্রণ করতে হবে।
কিন্তু অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞার উদ্যোগে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, দেশের ৮টি বিভাগে ৪০.২% জর্দার কৌটায় এখনও সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী ছাপা হয় না। ৮৫.২% জর্দা এবং ৪২% গুলের কৌটায় সতর্কবাণী সঠিক স্থানে মুদ্রণ করা হয় না। অন্যদিকে, সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী মুদ্রণ বাধ্যতামূলক—এটি ৩১% বিক্রেতা জানেন না। আর ৭০.৮% বিক্রেতাই জানেন না যে এটি ৩ মাস অন্তর পরিবর্তন করতে হয়।
গবেষণাটি ২০১৬ সালে পরিচালিত হলেও গত ৯ বছরে এই চিত্রের খুব একটা হেরফের দেখা যায়নি। আবার, জর্দার ক্ষতিকারক দিক উল্লেখ করে সাবধানবাণীর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ছবি ব্যবহার না করলে অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত মানুষ সেটি পড়তে পারেন না। ফলে লেখা আর না লেখা সমান হয়ে যায়।
যে জর্দা আপনি বা আমি রোজ খাই, সে জর্দা আসলে কী দিয়ে তৈরি হয়? তামাকজাত দ্রব্য তো থাকেই। সঙ্গে জর্দা তৈরিতে ব্যবহৃত হয় নারকেলের আঁশ। এছাড়া মাত্রাতিরিক্ত কৃত্রিম রং, স্যাকারিন, সুগন্ধি এবং অন্যান্য কেমিক্যালের ব্যবহারও আছে। বাজারে যতগুলো জর্দা প্রচলিত আছে, তার মধ্যে অধিকাংশ জর্দাই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অনুমোদনবিহীন। আর যেসব জর্দার এই অনুমোদন রয়েছে, সেগুলোর দাম তুলনামূলক বেশি হওয়ায় তা কম জনপ্রিয়।
তামাকবিরোধী নারী জোটের উদ্যোগে 'ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য জর্দা ও গুল উৎপাদন একটি অনুসন্ধান' (২০১৪) শীর্ষক গবেষণাগ্রন্থে জর্দার ক্ষতিকারক দিকগুলো উঠে এসেছে। এ বইয়ের তথ্য বলছে, ২৫.৯ বিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির মধ্যে ২৭ দশমিক ২ শতাংশ ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবন করেন।
এরমধ্যে পুরুষের চেয়ে মহিলাদের সংখ্যা ২৭ দশমিক ৯ শতাংশ বেশি। আবার ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবনকারীদের মধ্যে গ্রামের মহিলাদের সংখ্যা বেশি। জর্দার মতন ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবনে মহিলারা পুরুষদের থেকে বেশি মৃত্যু ঝুঁকিতে থাকেন।
গর্ভবতী অবস্থায় জর্দা সেবনে মৃত শিশু প্রসব, সন্তানের ওজন কমে যাওয়াসহ নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়। এছাড়া জর্দার অ্যালকালয়েড ও নিকোটিন অধিক মাত্রায় বিষাক্ত হওয়ায় তা মুখগহ্বরের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
আন্তর্জাতিক ক্যানসার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফ্রান্সের আইএআরসির (ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার) গবেষকদের মতে, যারা তামাকজাতীয় দ্রব্যাদি যেমন জর্দা, চুন, কাঁচা সুপারি, খয়ের দিয়ে পান খান, তাদের ক্ষেত্রে অন্যদের তুলনায় ওরাল বা মুখের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি প্রায় পাঁচ গুণ বেশি।
ক্ষণিকের ভালো লাগার জন্যে জর্দার মতো ক্ষতিকর দ্রব্যের সর্বনেশে নেশায় জড়িয়ে পড়া খুব একটা ভালো সিদ্ধান্ত নয়। ক্যানসারের মতন মরণব্যাধি শেষ করে দিতে পারে মূল্যবান জীবন।
জর্দার ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে প্রচার প্রচারণা বাড়ানো জরুরি। প্রতিটা জর্দার কৌটায় জর্দার কুফল সম্পর্কে লেখা বাধ্যতামূলক করতে হবে বলে মত দেন বিশেষজ্ঞরা।
পাশাপাশি সরকারিভাবে জর্দার ওপর শুল্কহার বাড়িয়ে এর ব্যবহার সীমিতকরণে জোর দিতে হবে। আজ এ মুহূর্ত থেকে আপনি, আমি, আমরা যদি সচেতন হই, তাহলে অকালমৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যেতে পারে অনেকগুলো প্রাণ।
ছবি: অনুস্কা ব্যানার্জী/টিবিএস