রাজশাহীর পদ্মাও এখন দূষণের কবলে
পদ্মা নদীও দখলে-দূষণের কবলে পড়েছে। নদীতে শহরের কঠিন ও তরল দুই ধরনের বর্জ্যই ফেলা হচ্ছে নির্বিবাদে। এসব বর্জ্য গিয়ে মিশছে নদীর পানিতে। অন্যদিকে বাড়ি ঘরের ভাঙা টাইলস, পরিত্যক্ত কংক্রিটের টুকরোর মতো শক্ত আর্বজনাও ফেলা হচ্ছে নদীর পাড় ধরে, এ ধরনের শক্ত উচ্ছিষ্ট জিনিস ফেলার পেছনে কাজ করছে নদী দখলের মনোবৃত্তি। এই দৃশ্য আরও স্পষ্ট শহর রক্ষা বাঁধ জুড়ে। ইতোমধ্যে শহর রক্ষা বাধে বেশ কিছু স্থাপনা তৈরি হয়ে গেছে।
রাজশাহীতে যারা নদী নিয়ে গবেষকরা করছেন তারা শঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, এখনি নদী দূষণ আর দখল থামাতে না বাড়লে বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপনে এর প্রবল প্রভাব পড়বে। নদী তীরবর্তী মানুষের জন্য শুধু যে বসবাসের অযোগ্য অবস্থা তৈরি হবে তাই না, পদ্মা নদীর জীববৈচিত্র্যও ধ্বংস হবে। দীর্ঘ মেয়াদে এই দূষণ চলতে থাকলে শহর রক্ষা বাঁধ দুর্বল হয়ে পড়বে। তখন পুরো রাজশাহী শহরই ঝুঁকির মুখে পড়বে।
গত এক সপ্তাহ রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকার পদ্মা নদী সংলগ্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, আশপাশের এলাকাগুলোর বাসাবাড়ি থেকে প্রতিদিনের গৃহস্থালি সব ময়লা-আর্বজনা নির্বিবাদে পদ্মা নদীতে ফেলা হচ্ছে। বিশেষ করে শহরের বুলনপুর, কেশবপুর, শ্রীরামপুর, কুমারপাড়া, সেখের চক, পঞ্চবটি, তালাইমারী ও শ্যামপুর এলাকা শহর রক্ষা বাঁধ ও নদীসংলগ্ন হওয়ায় বসতবাড়ির গৃহস্থালি সব ময়লা-আর্বজনাই পদ্মা নদীতে ফেলা হয়।
এছাড়া পাঠানপাড়া, দরগড়াপাড়া, বড়কুঠি ও শ্রীরামপুরসহ শহর রক্ষা বাঁধের নানা স্থানে বিভিন্ন ধরনের রেঁস্তোরা গড়ে উঠেছে। এসব রেস্তোরার সব ধরনের প্লাস্টিক ও পলিথিন এবং বর্জ্য সরাসরি পদ্মা নদীতে ফেলা হয়। এছাড়া শহরের পাঁচটি স্লুইস গেটের মাধ্যমে শহরের তরল বর্জ্যও পদ্মা নদীতেই পড়ে।
মঙ্গলবার দুপুর ১২ টায় কুমারপাড়া পদ্মার পাড়সংলগ্ন নদীতে এক নারীকে ময়লা ফেলতে দেখে এই প্রতিবেদক তাকে জিজ্ঞেস করলে, তিনি জানান তার নাম রুনা এবং তার মতো ওই মহল্লার সবাই বাসাবাড়ির ময়লা এখানে (পদ্মা নদী দেখিয়ে বলেন) ফেলেন।
কুমারপাড়ার সুবাসী দাশ সিটি করপোরেশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে বলেন, সিটি করপোরেশনের ভ্যান কোনোদিন আসে সন্ধ্যার দিকে, কোনোদিন আসে রাত আটটার পর, আবার কোনো কোনো সময় ভ্যান খুঁজেই পাওয়া যায় না। এছাড়া গলির ভেতরে সিটি করপোরেশনের ভ্যান না ঢোকায় বাসাবাড়ির সব ময়লা পদ্মা নদীতে ফেলা হয়।
কেশবপুর পুলিশ লাইনের সামনের টি-বাঁধেও অবাধে ময়লা ফেলা হয়। বাধ জুড়ে পড়ে আছে প্লাস্টিকের কাপ, বোতল ও পলিথিন। এই বাধেই ১০ বছর ধরে বাঁধের ওপর পান বিড়ির দোকান করছেন গোলাম রসুল, তিনি জানান, 'অনেক দিন ধরেই পদ্মা নদীতে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। এর আগে সিটি করপোরেশন ময়লা পরিস্কার করত মাঝে মাঝে। মাস ছয়েক ধরে করপোরেশনের লোকজন আর আসে না। আগে তবু পরিষ্কার করতো। এখন প্লাস্টিকের কাপ, বোতল ও পলিথিন ও কাগজের ঠোঙ্গা সব পদ্মা নদীতেই ফেলা হয়।'
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান জানান, শহরের মধ্যে থেকে স্লুইস গেটের মাধ্যমে যে তরল বর্জ্য পদ্মা নদীতে পড়ে তার মধ্যে দরগাপাড়া এলাকায় তরল বর্জ্যের মধ্যে ক্ষতিকর উপাদান বেশি পাওয়া গেছে। এসব বর্জ্যের ফলে পদ্মা নদীর পানি দূষণ বাড়ছে। এর ফলে পদ্মায় জলজ জীবৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে। কারণ ইতিমধ্যে দেখা গেছে রাজশাহীর আরেক নদী পবা উপজেলার বারনই নদীতেও শহরের তরল বর্জ্য পড়ে ওখানকার জলজ জীববৈচিত্র্য নষ্ট করে ফেলেছে। বারনইয়ের মাছসহ জলজ প্রাণী বহুলাংশে কমে গেছে।
সেভ দ্য ন্যাচারের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, পদ্মা নদীর জন্য সবচেয়ে মারাত্মক হচ্ছে প্লাস্টিক বর্জ্য ও পলিথিনের ব্যাগ। এসব নদীর পানির দূষণ বাড়াচ্ছে। পদ্মা নদীর জীবৈচিত্র্য কমিয়ে দিচ্ছে। আমরা পলিথিনের ব্যবহার কমানোর আন্দোলন করেও কোনো লাভ হচ্ছে না।
পদ্মার দূষণ শুধু রাজশাহী অংশে ঘটছে এমন নয়, উৎসমূখ থেকেই এই দূষণ শুরু হয়েছে বলা যায়। ভারতের গঙ্গা নদীই বাংলাদেশে এসে পদ্মা নদী নামে পরিচিত হয়েছে। এদেশে গোয়ালন্দ পর্যন্ত গঙ্গার অন্তর্ভুক্ত।
ভারতের উত্তরপ্রদেশ পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ড (ইউপিপিসিবি) গবেষণায় বলা হয়েছে, ভারতের নদী দুষণের মধ্যে গঙ্গার অবস্থান দ্বিতীয় নাম্বারে রয়েছে। আর যমুনা নদী রয়েছে দূষণের পাঁচ নাম্বারে। ভারতের গঙ্গা নদীর দুধারে রয়েছে সহস্রাধিক শহর, শিল্প কারখানা, দর্শনার্থী ও তীর্থ স্থান। তাদের বর্জ্য প্রতিনিয়ত পদ্মা নদীকে দূষণ করছে।
তবে ভারতের হিন্দু বেনারস ইউনিভার্সিটির মহামানা মালিভিয়া রিসার্চ সেন্টার ফর গঙ্গার চেয়ারপার্সন প্রফেসর ত্রিপাঠী বলেছেন, কোভিডের সময়ে গঙ্গা দূষণ ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কমেছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, আমি কয়েকবছর আগে পদ্মা নদীতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্লুইস গেটের মাধ্যমে সিটি করপোরেশনের যে তরল বর্জ্য যাচ্ছে তা গবেষণা করে দেখেছি তাতে দূষণের মাত্রা ব্যাপক। আর এটা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এর আগে যেমন পদ্মা নদীতে শুশুক দেখা গেলেও এখন আর দেখা যায় না। মাছের পরিমাণও বহুলাংশে কমে গেছে। এছাড়া পদ্মা নদীর পানি কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়াচ্ছে। কারণ গবেষণা দেখা গেছে, পদ্মা নদীর পানি কৃষি কাজে ব্যবহারের ফলে কৃষি জমিতে ধাতব পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
তিনি মনে করেন, এইজন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানার দূষক পরিশোধনকারী প্ল্যান্ট থাকা উচিত যা রাজশাহীতে নেই।
রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ জানান, পাঁচটি স্লুইচ গেটের মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশনের তরল বর্জ্য পদ্মা নদীতে পড়ে। তবে বর্ষাকালে পদ্মা নদীর পানি বেড়ে গেলে তখন গেট বন্ধ থাকে যাতে পদ্মার পানি শহরে প্রবেশ না করে।
শহর রক্ষা বাধের সবচেয়ে বেশি দখলের ঘটনা ঘটেছে রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকায় বুলনপুর থেকে শ্যামপুরে। এই অংশে শহর রক্ষা বাঁধ দখল করে নানা স্থায়ী স্থাপনা যেমন গড়ে উঠেছে বাঁধেও ভ্রাম্যমাণ অস্থায়ী স্থাপনাও বাড়ছে দিনকে দিন।
নগরীর শ্রীরামপুরে শহর রক্ষা বাঁধ ঘেঁষে পদ্মার বিশাল জমি দখল করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) গড়ে তুলেছে সীমান্তে অবকাশ ও সীমান্তে নোঙর নামের দুইটি বড় স্থাপনা। সেখানে রেস্টুরেন্টের ব্যবসা করা হয়। এছাড়া একটি স্থায়ী কনফারেন্স সেন্টারও গড়ে তোলা হয়েছে।
তবে রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ জানান, ব্রিটিশ আমলে যখন শহর রক্ষা বাঁধ তৈরি করা হয় তখন জমি অধিগ্রহণ করে বাধ নির্মাণ করা হয়নি। এই জন্য বাঁধের পাশের জমি সব খাস জমি হিসেবে পরিগণিত হয়। খাস জমির মালিক জেলা প্রশাসক। বিজিবি জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে লিজ নিয়েই তাদের রেস্তোরাঁ ব্যবসা পরিচালনা করছে।
এদিকে পাঠানপাড়া শহর রক্ষা বাঁধ ঘেঁষে পদ্মা নদীর পাড়ে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে গড়ে তোলা হয়েছে লালন শাহ পার্ক। তার একাংশে পাঠানপাড়া ও দরগাপাড়ার স্থানীয় লোকজন অস্থায়ী গরুর গোয়াল বানিয়েছে, সেখানে নিয়মিত গরু রাখা হচ্ছে। এছাড়া বড়কুঠি সংলগ্ন এলাকায় পদ্মার তীর ঘেঁষে গড়ে তোলা হয়েছে ২০-২৫টি দোকানপাট। অস্থায়ী দোকানপাটের সঙ্গেই আছে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকটি দলীয় ওয়ার্ড কার্যালয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার তাপু বলেন, নদীতে সলিড কিংবা লিকুইড কোনো বর্জ্য ফেলা উচিত না। এটা আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কারণ লিকুইড বর্জ্য পানিতে মিশে বায়োলজিক্যাল অক্সিজেনের ঘাটতি তৈরি করে । এতে জলজ প্রাণী মারা যায়। আর সলিড বর্জ্য ফেলা হলে কিংবা নদীর পাড়ে বা নদীর তীরবর্তী এলাকায় বসতি গড়ে তোলা হলে, তা নদীর পাড়কে দুর্বল করে দেয়। শহর রক্ষা বাঁধের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। রাজশাহীতে এমনিতেই বাঁধ সংলগ্ন এলাকায় বসতি রয়েছে যা শহর রক্ষা বাঁধের জন্য হুমকিস্বরূপ। এসব অবশ্যই সরিয়ে ফেলা উচিত।
গোলাম সাব্বির সাত্তার তাপু বলেন, রাজশাহী শহর রক্ষা বাঁধ ২২ মিটার উঁচু হলে বাঁধ থেকে দুই মিটার নিচে রয়েছে শহর। ফলে বাঁধকে রক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ জানান, ব্রিটিশ আমলে যখন শহর রক্ষা বাঁধ তৈরি করা হয় তখন জমি অধিগ্রহণ করা হয়নি। এই জন্য বাঁধের পাশের জমি সব খাস জমি হিসেবে পরিগণিত হয়। খাস জমির মালিক জেলা প্রশাসক। বিজিবি জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে লিজ নিয়েই তাদের রেস্তোরাঁ ব্যবসা পরিচালনা করছে।