বাহাদুর শাহ জাফর: এক মর্মন্তুদ জীবন-মৃত্যুর আখ্যান
মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে যুগপৎ গৌরব ও গভীর বেদনা প্রোথিত হয়ে আছে। ফারগানার অধিপতি জহির-উদ-দ্বীন মুহম্মদ বাবুর (শাসনকাল: ১৫২৬-১৫৩০ খ্রিষ্টাব্দ) ছিলেন ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য ও মুঘল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। বাবুর তাঁর পিতা মির্জা উমর শেখের দিক দিয়ে ছিলেন তৈমুর লঙের (জীবনকাল: ১৩৩৬-১৪০৫ খ্রিষ্টাব্দ) পঞ্চম বংশধর এবং মাতা কুতলুফ নিগার খানমের সূত্রে চেঙ্গিস খানের (জীবনকাল: ১১৬২-১২২৭ খ্রিষ্টাব্দ) পঞ্চদশতম বংশধর। বাবুর ফারগানা থেকে নিকটবর্তী উজবেকদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে ভাগ্যান্বেষণে আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে হিন্দুস্তানে প্রবেশ করেন। তিনি ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দের ২১ এপ্রিলে সংঘটিত পানিপথের প্রথম যুদ্ধে লোদী বংশের শেষ শাসক দিল্লির সুলতান ইব্রাহীম লোদীকে (শাসনকাল: ১৫১৭-১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দ) পরাজিত করে ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক কালজয়ী অধ্যায়ের সূচনা করেন। বাবুর যেমন ছিলেন মুঘল সা¤্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম বাদশাহ, ঠিক তেমনি বাহাদুর শাহ জাফর ছিলেন শেষ মুঘল বাদশাহ। তাঁর পূর্ণ নাম আবুল মোজাফফর সিরাজ-আল-দ্বীন মুহম্মদ বাহাদুর শাহ গাজী। তিনি ২৪ অক্টোবর ১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দে (২৭ শাবান ১১৮১ হিজরি) দিল্লির লালকেল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। বাহাদুর শাহ দিল্লির বাদশাহ দ্বিতীয় আকবর শাহ (শাসনকাল: ১৮০৬-১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দ) ও স¤্রাজ্ঞী লাল বাঈ'র জ্যেষ্ঠ পুত্র। তাঁর ঊর্ধ্বতন বংশতালিকা বিশতম স্তরে গিয়ে মুঘল সা¤্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহির-উদ-দ্বীন মুহম্মদ বাবুরের সাথে মিলেছে।
পিতার ইন্তেকালের পর বাহাদুর শাহ (দ্বিতীয়) ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ সেপ্টেম্বর দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ছিলেন ১৭তম এবং শেষ মুঘল বাদশাহ। বাহাদুর শাহ বেশ বিলম্বে মুঘল সিংহাসনে আরোহণ করেন। ষাটোর্ধ্ব বয়সে তিনি যখন পিতার স্থলাভিষিক্ত হন, তখন মুঘলদের রাজনৈতিক পতন ঠেকানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। এমন কঠিন সময়ের মধ্যেও তিনি রাজদরবারে অনেক মেধাবী ও সৃজনশীল ব্যক্তির সমাবেশ ঘটাতে সক্ষম হন। মুঘল বংশের সবচেয়ে মেধাসম্পন্ন ও সহনশীল প্রকৃতির বাদশাহদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। তিনি একাধারে দক্ষ লিপিশিল্পী, সূফিবাদের গভীর অন্ত:দৃষ্টি সম্পন্ন লেখক, মুঘল চিত্রকলার (Mughal Miniature) পৃষ্ঠপোষক, উদ্যান নির্মাণের অসামান্য উদ্যোক্তা এবং সৌখিন স্থপতি ছিলেন। বাহাদুর শাহ জাফরের সকল গুণের মধ্যে তাঁর সূফি কবি পরিচয়টি বিশেষ গুরুত্ববহ। তিনি শুধু ফারসি ও উর্দু ভাষাতেই নয়, ব্রজভাষা ও পাঞ্জাবি ভাষায়ও সার্থক কবিতা রচনা করেন। আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাসে সাহিত্য ক্ষেত্রে সবচেয়ে উজ্জ্বলতর রেনেসাঁর জন্য তাঁর অসামান্য অবদান রয়েছে। তিনি নিজে অসংখ্য কালজয়ী কবিতা ও গজল রচনা করেন। এর পাশাপাশি তিনি তাঁর সমসাময়িক হিন্দুস্তানের বিশিষ্ট কবিদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন অসীম উদারতায়। তাঁদের মধ্যে মির্জা গালিব (জীবনকাল: ১৭৯৭-১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দ) ও শেখ মুহাম্মদ ইব্রাহিম জওক (জীবনকাল: ১৭৮৯-১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দ) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বাহাদুর শাহ জাফর যৌবনে প্রবাদতুল্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন। তাঁর সময়ের মুঘল শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে এই ঔজ্জ্বল্য লক্ষ্য করা যায়। জাফর আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন। তিনি ব্রজ ভাষা ও পাঞ্জাবি ভাষায় কবিতা রচনার দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। তাঁর জ্ঞানত পাঁচটি ভাষার মধ্যে চারটি ভাষায় রচিত কবিতার সন্ধান পাওয়া গেলেও আরবি ভাষায় রচিত কোনো কবিতার খোঁজ আজও মেলেনি। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেই তাঁর একটি কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়। যা শেখ সাদী'র 'গুলিস্তা' গ্রন্থটির ওপর দীর্ঘ কাব্যিক বিশ্লেষণ। এছাড়া বাহাদুর শাহের ছন্দশাস্ত্র বিষয়ে তিন খণ্ড অভিধান এবং দক্ষিণ ভারতীয় ভাষা সম্পর্কিত নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। যৌবনে তিনি চৌকস ঘোড়সওয়ার, অসিচালক ও তীরন্দাজ ছিলেন। উল্লেখ্য, বৃদ্ধ বয়সেও তিনি বন্দুক চালনা করে লক্ষ্যভেদ করতে পারতেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির স্যার চার্লস থিওফিলাস মেটক্যাফ (জীবনকাল: ১৭৮৫-১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দ) স্বীকার করেছেন যে, "জাফর অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ও যোগ্যতাসম্পন্ন রাজপুত্র ছিলেন।"
বাদশাহ বাহাদুর শাহ প্রিয়দর্শিনী জেনানা জিনাত মহল বেগমের (জীবনকাল: ১৮২১-১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দ) সঙ্গে ১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ নভেম্বর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। শুরু থেকেই জিনাত বাদশাহের সার্বক্ষণিক সঙ্গী ও সবচেয়ে প্রভাবশালী উপদেষ্টায় পরিণত হন। জাফরের একাধিক স্ত্রীর মধ্যে একমাত্র জিনাত মহলই উচ্চবংশীয় ছিলেন। তাঁরা যখন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, তখন জিনাত মহলের বয়স ছিলো ১৯ বছর এবং বাহাদুর শাহের ৬৪ বছর। জিনাত মহল বাদশাহের সর্বাধিক প্রিয় বিবি হিসাবে মর্যাদা লাভ করেন এবং তিনি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী তাজমহল বেগমের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। জিনাত মহল এক পুত্র সন্তানের জন্মদান করেন। তাঁর নাম মির্জা জওয়ান বখত। বাহাদুর শাহের ষোলোজন পুত্রের মধ্যে জওয়ান বখত ছিলেন পঞ্চদশ অবস্থানে। জিনাত মহলের গভীর আগ্রহে বাদশাহ তাঁকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসাবে ঘোষণা করেন। বাহাদুর শাহ মুঘল সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত দুঃসময়ে বাদশাহ ছিলেন। ব্রিটিশরা যখন এই উপমহাদেশে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ শুরু করে, তখন সাম্রাজ্যে মুঘল বাদশাহ ছিলেন দ্বিতীয় শাহ আলম (শাসনকাল: ১৭৫৯-১৮০৬ খ্রিষ্টাব্দ)। কিন্তু তার আগেই মুঘল সাম্রাজ্যের অবক্ষয় শুরু হয়।
১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দে বাদশাহ আওরঙ্গজেবের (শাসনকাল: ১৬৫৮-১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দ) ইন্তেকালের পর বিরুদ্ধবাদী সামরিক শক্তি মারাঠা, শিখ ও জাটরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। বিভিন্ন প্রদেশের সুবাদারগণ নিজ নিজ নিয়ন্ত্রণাধীন ভূখ- সমূহের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। প্রকৃতপক্ষে বাহাদুর শাহ জাফর তাঁর পিতামহ বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলম এবং পিতা বাদশাহ দ্বিতীয় আকবর শাহ উভয়ের মতো ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পেনশনভোগী ছিলেন। তিনি বার্ষিক এক লক্ষ টাকা ভাতা পেতেন। পিতার মতো বাহাদুর শাহ নিজেরও মুঘল খানদানের ভরণপোষণ বাবদ ভাতা বৃদ্ধির জন্য অনেক চেষ্টা করেন। কিন্তু তার জন্য 'বাদশাহ' উপাধি ত্যাগ এবং লালকেল্লার বাইরে সাধারণ নাগরিকের মতো জীবনযাপনের শর্তে তিনি রাজি হননি। এছাড়া সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনয়ন নিয়েও ইংরেজেদের সঙ্গে বাদশাহের মনোমালিন্য হয়। বাদশাহের ক্ষমতা ও মর্যাদা খর্ব করতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে কোম্পানি। এক পর্যায়ে ক্ষমতা, প্রতিপত্তি ও সম্পদ সবকিছু হারিয়ে বাদশাহ প্রাসাদের চার দেয়ালের অভ্যন্তরে জীবন কাটাতে বাধ্য হলেন। এ সময় অমর্যাদার মনোবেদনা ভুলে থাকার জন্য তিনি গজল ও মুশায়েরায় নিমগ্ন থাকেন। এছাড়াও তিনি লালকেল্লায় সাহিত্যের আসর বসিয়ে সময় কাটান। তাঁর স্বরচিত কবিতায় জীবনের গভীর দুঃখ-কষ্ট ও বিষাদের কথা প্রতিভাত হয়েছে বারবার। বিধৃত হয়েছে দেশ ও জাতির পরাধীনতার কথা। একটি কবিতায় জাফর লিখেছেন:
"উমর দরাজ মাঁঙ্গকে লায়েথে চারদিন
দো আরজুমে কাট গয়ে, দো ইন্তেজার মেঁ।"
অনুবাদ:
"চারদিনের জন্য আয়ু নিয়ে এসেছিলাম
দু'দিন কাটলো প্রত্যাশায়, দু'দিন অপেক্ষায়।"
দুই.
১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দ। পলাশীর যুদ্ধের (১৭৫৭) ঠিক একশত বছর পরের কথা। এই একশত বছরের ইংরেজ রাজের রক্তকলুষিত শাসন আমাদের সোনার ভারতবর্ষকে শ্মশানে পরিণত করেছে। সারা ভারতের চেহারাই তখন বদলে গিয়েছে। ইংরেজ রাজের ভারতগ্রাস ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে আরম্ভ হয় বাংলা ও বিহার হতে। পাঞ্জাবেই সেই গ্রাসের অবসান ঘটে। তখন দেশের মধ্যে এক বিরাট পরিবর্তনের সূচনা হয়। সেই সময় দেশীয় রাজারা নামমাত্র স্বাধীনতা নিয়ে নিজ নিজ রাজ্যের গদি আঁকড়ে ছিলেন। ইংরেজরা এবার দেশীয় রাজ্যগুলোকেও গ্রাস করতে শুরু করে। ইংরেজ রাজের এই রাক্ষুসে ক্ষুধা মেটানোর ভার নিয়ে লর্ড ডালহৌসি বড় লাট হয়ে এলেন।
বাহাদুর শাহ সিংহাসনে আরোহণের কুড়ি বছর পর ঐতিহাসিক সিপাহি বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়। পলাশী যুদ্ধের পর একশত বছর কেটে গেছে তত দিনে। ছলেবলে কৌশলে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সমগ্র ভারতবর্ষ দখল করে নিয়েছে। দেশের জনগণ ও ভারতীয় সেনাদের ওপরও চলছে জুলুম, বঞ্চনা ও নির্যাতন। একের পর এক দেশীয় রাজ্য ইংরেজ অধিকারে নিয়ে যাওয়া, লাখেরাজ ও দেবোত্তর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা, কারাগারে হিন্দু-মুসলমান সিপাহিদের জন্য একই খাবারের ব্যবস্থা, ঘিয়ের মধ্যে চর্বি ও আটার মধ্যে হাড়গুঁড়োর সংমিশ্রণ, গরু ও শূকরের চর্বি মিশ্রিত কার্তুজ বিতরণ প্রভৃতি ঘটনা ভারতবর্ষের মানুষের মনে এবং সৈনিকদের অনুভূতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
ভারতীয় সিপাহিদের মধ্যে ধূমায়িত বিক্ষোভ ও অস্থিরতার প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ২২ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের দমদম সেনাছাউনিতে। সিপাহিরা ইংরেজ অফিসারকে জানায়–– এনফিল্ড রাইফেলের জন্য যে কার্তুজ তৈরি হয়, তাতে গরু ও শূকরের চর্বি মেশানো থাকে। এতে তাঁদের ধর্ম কলুষিত হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ সিপাহিদের বুঝিয়ে শান্ত করে। কিন্তু খবরটি একে একে বিভিন্ন সেনাছাউনিতে পৌঁছে যায় এবং তা সিপাহিদের মধ্যে বিদ্রোহের রূপধারণ করে। তারই ফলশ্রুতিতে প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর সেনাছাউনিতে ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি। ১৯ নম্বর পদাতিক বাহিনীর সিপাহিরা কার্তুজ নিতে অস্বীকার করেন। রাতে অস্ত্রাগারের দরোজা ভেঙে তাঁরা পুরনো মাসকেট বন্দুক ও কার্তুজ সংগ্রহ করেন। তাঁরা তখন ভীষণ উত্তেজিত অবস্থায় ছিলেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে সিপাহিদের নিরস্ত্র ও বরখাস্ত করা হয়। এই সংবাদও দ্রুত পৌঁছে যায় বিভিন্ন সেনানিবাসে। ২৯ মার্চ রোববার ব্যারাকপুরের দেশীয় সিপাহিদের বিদ্রোহ শুরু হয়। মঙ্গল পাণ্ডে নামের একজন সিপাহি গুলি চালিয়ে ইংরেজ সার্জেন্টকে হত্যা করেন। এই সংবাদ শোনামাত্র এই অঞ্চলের সকল ইংরেজ সৈন্য ছুটে এলো দেশীয় সিপাহিদের শাস্তি দিতে। মঙ্গল পাণ্ডেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর সাতদিন পর ৮ এপ্রিল সকাল ১০ টায় তাঁকে ফাঁসিকাষ্ঠে হত্যা করা হলো।
এর পরিণতিতে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে হিন্দুস্তানের উত্তর থেকে মধ্যপ্রদেশ এবং জলপাইগুড়ি থেকে পূর্ববাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ) দক্ষিণ-পূর্ব কোণের চট্টগ্রাম পর্যন্ত। ৯ মে উত্তর প্রদেশের মিরাটের সিপাহিরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং দিল্লির পথে অগ্রসর হন। ১১ মে সিপাহিরা দিল্লি অধিকার করে বহু ইংরেজকে হত্যা ও বিতাড়ন করেন। এদিকে দিল্লির পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে অবস্থিত সমস্ত ভারতীয় সৈনিক বিদ্রোহ ঘোষণা দিয়ে দিল্লি অভিযান করেন। স্থানীয় কৃষকরা তাঁদের সঙ্গে বিদ্রোহে যোগদান করেন। তাঁরা রেললাইন উপড়ে, টেলিগ্রাফের লাইন কেটে এবং ইংরেজ সৈন্যদের ব্যারাক ভেঙ্গে চুরমার করে দিলেন। দেশপ্রেমিক সিপাহিরা এই দিন লালকেল্লায় প্রবেশ করেন এবং তাঁরা সিংহাসন-হারা মুঘল বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফরকে ভারতবর্ষের স্বাধীন বাদশাহ বলে ঘোষণা দেন। ওই মুহুর্ত থেকে বাহাদুর শাহ জাফর হলেন বিদ্রোহের প্রধান পরিচালক ও কেন্দ্রস্বরূপ। এইভাবে বাহাদুর শাহের নেতৃত্বে সিপাহিদের এই অভ্যুত্থান সমগ্র উত্তর ও মধ্যভারতে বিস্তার লাভ করে ভারতের ইংরেজ শাসনের ভিত্তিমূল কাঁপিয়ে দেয়। উল্লেখ্য, ওই রাতে লালকেল্লায় সিপাহিরা বাদশাহের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের মধ্য দিয়ে শপথ গ্রহণ করেন। গভীর রাতে লালকেল্লায় একুশবার তোপধ্বনির মাধ্যমে ৮২ বছরের বৃদ্ধ বাদশাহকে দিওয়ান-ই-খাসে সম্মান জানানো হয়। বাহাদুর শাহ জাফর সিপাহিদের বিপ্লব তথা ভারতবর্ষের প্রথম সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিচ্ছেন–– এই সংবাদে কানপুর, লক্ষৌ বিহার, ঝাঁশি, বেরিলি থেকে শুরু করে পশ্চিম ও পূর্ব বাংলার সর্বত্র সিপাহিরা গর্জে ওঠেন। তাঁদের মুখে উচ্চারিত হয়––
"খালক-ই-খুদা, মুলক-ই-বাদশাহ, হুকুম-ই-সিপাহি।"
অর্থাৎ 'আল্লাহ্র দুনিয়া, বাদশাহের রাজ্য, সিপাহির হুকুম।'
বিদ্রোহ ক্রমশ বিস্তৃতি লাভ করে। একের পর এক সেনা ছাউনিতে বিদ্রোহ হতে থাকে। ইংরেজরা অতি নির্মমভাবে বিদ্রোহ দমন করে। হাজার হাজার স্বাধীনতাকামীর রক্তে রঞ্জিত হয় ভারতবর্ষের মাটি। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ বিক্ষুদ্ধ। কিন্তু ভারতীয়দের এই সংগ্রাম সফল হতে পারেনি। ১৮৫৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া বিক্ষোভ ও বিদ্রোহের পর কয়েক মাস কেটে যায়। ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে স্পষ্ট হয়ে উঠে ব্রিটিশ বাহিনী কর্তৃক লালকেল্লা দখল সময়ের ব্যাপার মাত্র।
একগুয়েঁ চরিত্রের মোহাম্মদ বখত খান তাঁর অনুগত সৈন্যদলসহ দিল্লি ছেড়ে দিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বাদশাহকে বিশেষভাবে পীড়াপীড়ি করেন তাঁর সঙ্গে যাওয়ার জন্য। বয়সের কারণে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সাহস বা মনোবল বৃদ্ধ বাদশাহ জাফরের মধ্যে ছিলো না। দিল্লি ছেড়ে যাওয়া ও চোরাগুপ্তা হামলা চালিয়ে যাওয়ার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বাদশাহ'র সাধ্য ও পরিস্থিতি অনুকূলে ছিলো না। তাৎক্ষণিক কোনো উত্তর না পেয়ে বখত খান বাদশাহকে ছেড়ে চলে যান। শুধুমাত্র একটি প্রতিশ্রুতি তিনি বাদশাহ'র কাছে পান–– পরদিন হুমায়ূনের সমাধিতে তাঁদের সাক্ষাৎ হবে।
এই পর্যায়ে মির্জা ইলাহি বখশকে অত্যন্ত সক্রিয় দেখা যায়। ইলাহি বখশ ছিলেন মুঘল সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী ফখরুদ্দিনের শ্বশুর। উল্লেখ্য, অসুস্থতাজনিত কারণে বাদশাহ জাফরের দ্বিতীয় পুত্র ফখরুদ্দিনের (জীবনকাল: ১৮১৮-১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দ) জীবনাবসান হয়। মুঘল পরিবারে ইলাহির প্রভাব ছিলো। তিনি বাহাদুর শাহকে অনুরোধ জানালেন, রাতে তাঁর গৃহে আশ্রয় গ্রহণের জন্য। বখত খানের সঙ্গে যাওয়ার ফলে বাদশাহ জাফরকে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে এবং এই প্রচেষ্টা যে পরাজয়ে পর্যবসিত হবে, সেসব বিষয়ে ইলাহি সাহেব বাদশাহকে অবগত করেন। সম্রাজ্ঞী জিনাত মহলও ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে সমঝোতায় উপনীত হওয়ার জন্য বাদশাহ জাফরকে পরামর্শ দেন। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ১৭ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতের পর জাফর তাঁর প্রধানমন্ত্রী এমনকি সম্রাজ্ঞী জিনাত মহলকে পর্যন্ত কোনো কিছু অবগত না করে পানি-ফটক দিয়ে নিঃশব্দে লালকেল্লা ত্যাগ করেন। তিনি ছিলেন দেহরক্ষীদের দলবিহীন, একা। এই যাত্রায় জাফর সাথে নিয়েছেন তাঁর পূর্বপুরুষের সম্পদের মধ্য থেকে সুনির্বাচিত কিছু জিনিস। সেসবের মধ্যে ছিলো শাহি রত্মরাজি এবং একটি পালকি। ভোরে জাফর একটি নৌকায় উঠে ভাটির দিকে পুরনো কেল্লার ঘাটে যান। সেখান থেকে গেলেন মহান সূফি সাধক হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজারে। যা শাহজাহানাবাদের তিন মাইল দক্ষিণ দিকে অবস্থিত। মাজারের খাদেমদের অধঃস্তন বংশধর নিজামী পরিবারের সংরক্ষিত বিবরণ অনুযায়ী জানা যায়, বাদশাহ জাফর তাঁর পরিবারের প্রাচীন নিদর্শনগুলো নিরাপদে রাখার জন্য তাঁদের কাছে হস্তান্তর করেন।
এ সবের মধ্যে ছিলো লালকেল্লা থেকে নিয়ে আসা একটি বাক্স। যাতে সংরক্ষিত ছিলো মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর তিনটি শ্মশ্রু-মুবারক। যা পবিত্র আমানত হিসাবে চৌদ্দশত শতাব্দি থেকে তৈমুরের বংশ পিতা থেকে পুত্রের কাছে হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় সংরক্ষিত হয়েছে। এই অমূল্য নিদর্শনের সাথে বাদশাহ জাফরের গভীর আবেগময় সম্পর্ক ছিলো। প্রাসাদের দিনপঞ্জি এবং অন্যান্য বিবরণী থেকে এ বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়। তিনি ব্যক্তিগতভাবে গোলাপজল দিয়ে এই পবিত্র শ্মশ্রু-মুবারক ধৌত করতেন। মাজারে মোনাজাত শেষ করে পিরজাদাদের দেয়া সামান্য নাশতা খাওয়ার পর বাদশাহ সহসা ক্রন্দনসিক্ত হন। তিনি মাজারের প্রধান সূফির উদ্দেশ্যে বলেন––
"সর্বদা অমার মন বলছে, এইসব বিদ্রোহী সিপাহিরা আমাদের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে। গোড়া থেকেই এই আশঙ্কা ছিলো, যা এখন সত্যে পরিণত হয়েছে। সিপাহিরা ইংরেজদের আগেই পালিয়েছে। হে ভাই! আমার গভীর অনুরাগ রয়েছে ফকির ও সূফি জীবনের প্রতি। তা সত্ত্বেও আমার শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হচ্ছে সেই শাহি রক্ত, যা দেহে শেষ বিন্দু থাকা পর্যন্ত আমাকে যুদ্ধে অবিচল রাখবে। আমার পূর্বপুরুষেরা এখনকার চাইতেও জটিল পরিস্থিতির মধ্যে ছিলেন। তাঁরা কখনোই হতাশ হন নি। কিন্তু আমি নিয়তির লিখন পাঠ করতে পেরেছি। আমি নিজের চোখে দ্রুত এগিয়ে আসা বিপর্যয় দেখতে পাচ্ছি। যা আমার বংশের ঐশ্বর্যের পরিসমাপ্তি ঘটাবে। এখন আর সন্দেহের কিছু বাকি নেই যে, হিন্দুস্তানের সিংহাসনে আসীন মহান তৈমুর বংশের আমিই শেষ ব্যক্তি। মুঘল সাম্রাজ্যের চেরাগ দ্রুত জ্বলে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। এটা জ্বলবে আর মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্য। যেহেতু আমি বিষয়টি জেনেছি, অতএব আমি কেন আরো রক্তপাতের কারণ হবো ? এই বিবেচনায় আমি লালকেল্লা ত্যাগ করেছি। রাজ্যের মালিক আল্লাহ্। তিনি যাকে খুশি এর মালিকানা দিতে পারেন।"
এই কথা বলে বাদশাহ শাহি নির্দশনগুলো মাজারের খাদেমদের জিম্মায় রাখেন। এরপর তিনি পালকিতে উঠে মেহরুলিতে অবস্থিত কুতুব শাহির মাজার সংলগ্ন তাঁর গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। বাদশাহ বাহাদুর শাহ্ জাফরের আধ্যাত্বিক ক্ষমতা সম্পর্কে সম্যক অবহিত হওয়া যায় তাঁর উপরোক্ত জবানি থেকে। তিনি আগেই উপলব্ধি করেন যে, তাঁর জন্য কী করুণ নিয়তি অপেক্ষমাণ। বাদশাহ জাফরের ইচ্ছে ছিলো নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজার থেকে বের হয়ে দিল্লি নগর ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাবেন। কিন্তু ইলাহি বখশের পীড়াপীড়িতে বাদশাহ সেই পরিকল্পনা বাতিল করেন। পালকি বাহকদের তিনি নির্দেশ দেন নিজামুদ্দিনের মাজারে ফিরে যেতে। সেখানে তিনি সম্রাজ্ঞী জিনাত মহলের জন্য অপেক্ষা করেন। এরপর তাঁরা একত্রে বাদশাহ হুমায়ুনের সামধিসৌধে প্রবেশ করেন। নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজারের নিকটেই রয়েছে মার্বেল পাথরের গম্বুজ সম্বলিত দ্বিতীয় মুঘল বাদশাহ হুমায়ূনের সমাধিসৌধ। যা তিনশো বছর আগে নির্মিত হয়েছে এবং বর্তমানেও দিল্লির একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ নান্দনিক সৌধ। এখানে অবস্থানকালে জাফর একটি বার্তা প্রেরণ করেন। তা হলো, হেকিম আহসান উল্লাহ খানের হাভেলিতে যেন হাতি পাঠানো হয়। যাতে তিনি সৌধে এসে রাজ পরিবারের সাথে যোগ দেন। এরপর বাদশাহ জাফর তাঁর পূর্বপুরুষের সমাধিসৌধের প্রকোষ্ঠে চলে যান এবং প্রতীক্ষা ও প্রার্থনায় মনোনিবেশ করেন। বাদশাহ হুমায়ুনের সমাধিসৌধে বাহাদুর শাহ জাফর আশ্রয় নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু দু'দিন পর ২০ সেপ্টেম্বর ইংরেজ সেনাপতি হডসন তাঁকে গ্রেপ্তার করে লালকেল্লায় নিয়ে যান। তখন প্রহরায় নিয়োজিত ছিলেন কেন্ডাল কোগিল নামে এক ইংরেজ সেনা। কোগিল বাড়িতে চিঠি লিখে জানান, "হিন্দুস্তানের রাজা এখন আমার হাতে বন্দি। সেন্ট্রিদের বলেছি, জানোয়ারটা মুখ তুলে তাকালেই গুলিতে ঝাঁজরা করে দিতে।" এই সময়ের মধ্যেই বাদশাহ জাফরের দুই পুত্রকে সেনাপতি হডসন নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে হুমায়ুনের সমাধিসৌধ থেকে বের করে আনেন। তারপর মাঝরাস্তায় তাঁদের নগ্ন করে গুলি চালান। খবর পেয়ে বাদশাহ জাফর স্তম্ভিত। গভীর শোকে অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারেন নি তিনি।
আজ যেন তিনি আর বাদশাহ নন। পূর্বপুরুষ কর্তৃক নির্মিত লালকেল্লার দু'টো ছোট্ট খুপরিতে তিনি বন্দি। সেখানে শোবার খাটিয়ায় রয়েছে শতচ্ছিন্ন রজাই। তাঁর রোজকার খানাদানার জন্য বরাদ্দ হয়েছে মাত্র দু'আনা। কিছুদিন আগেও অনুমতি ছাড়া উজির থেকে আমির কেউই আসতে পারেন নি বাদশাহ জাফরের সামনে। এখন ধোবি, ক্ষৌরকার থেকে হাকিম কাউকে আসতে দেওয়া হয় না তাঁর কাছে। ব্রিটিশ সেনাধ্যক্ষ স্যার জন লরেন্স কঠোরভাবে নির্দেশ দিলেন, "রাজপরিবারের কেউ বিন্দুমাত্র সুবিধা পাওয়ার যোগ্য নয়। সামান্য সমবেদনা জানানোও ভুল।"
তিন.
১৮৫৮ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে মুঘল রাজদরবারের প্রায় সকল সদস্যের প্রহসনমূলক বিচার ও ফাঁসি দেয়ার কাজ শেষ হয়। এরপর খোদ বাদশাহ জাফরের বিচারের পালা আসে। তাঁকে বিদ্রোহ, চক্রান্ত ও হত্যাকা-ের জন্য অভিযুক্ত করা হয়। সামরিক কমিশন কর্তৃক একজন ব্রিটিশ প্রজা হিসাবে তাঁর আনুগত্যকে বিবেচনায় আনা হবে না বলেও সিদ্বান্ত হয়। ১৮৫৮ সালের জানুয়ারির শেষভাগে শুরু হয় বাদশাহের বিচারের শুনানি। মেজর হ্যারিওট, যিনি অত্যন্ত কঠোরভাবে বাদশাহ জাফরের দরবার ও পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের বিচার সম্পন্ন করে ফাঁসির রায় দেন। হ্যারিওট এখন বাদশাহের বিচার করবেন। বাদশাহ জাফরকে তিনি বিদ্রোহীদের নেতৃত্বদানকারী প্রধান ব্যক্তি মনে করেন। রাজদ্রোহের অভিযোগে শুরু হয় তাঁর বিচার। শীতের সকাল, অশক্ত বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ জাফর মাঝে মাঝে দিওয়ান-ই-খাসের বিচারালয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। কিছু না বোঝে বিহবল চোখে তাকিয়ে থাকেন। তাঁর পূর্বপুরুষ চতুর্থ মুঘল বাদশাহ জাহাঙ্গীর (শাসনকাল: ১৬০৫-১৬২৭ খ্রিষ্টাব্দ) একদা ইংরেজ বণিকদের হিন্দুস্তানে অনুপ্রবেশ ও ব্যবসার জন্য অধিকার দিয়েছেন। তারাই আজ বিচারক। ব্রিটিশদের এই বেঈমানি ও নিষ্ঠুরতা চিরঘৃণ্য। বস্তুত তারা এই বিচারকার্যের কোনো এখতিয়ার রাখে না। ইংরেজ সিপাহিরা মির্জা মুঘল, মির্জা খিজির সুলতান, মির্জা আবু বকরসহ ২৯ জনকে হত্যা করার পর আরো ক'জন মুঘল শাহজাদা, আমির, ওমরাহ, সেনাপতি ও দেশীয় সিপাহিকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। বাদশাহকে বিচারের মুখোশে বস্তুত প্রহসনের আদালতে দাঁড় করানো হয়। সেখানে হাজির করা হয় বানোয়াট সাক্ষী। বিচারকরা রায় দেন–– দিল্লির সাবেক বাদশাহ ১০ মে থেকে ১ অক্টোবর ১৮৫৭ পর্যন্ত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংগঠনের দায়ে অপরাধী। তাঁর শাস্তি চরম অর্থাৎ মৃত্যুদ- হওয়া উচিত। কিন্তু তাঁর বার্ধক্যের কথা বিবেচনা করে প্রাণ দণ্ডাদেশ না দিয়ে নির্বাসনে পাঠানোর সুপারিশ করা হয়। মার্চ মাসে সাজা ঘোষণা হলো, নির্বাসন। কিন্তু বাদশাহকে কোথায় পাঠানো যায়, এ নিয়ে কোম্পানির মধ্যে নানা উৎকণ্ঠা দেখা দেয়। যুদ্ধ পুরোপুরি শেষ না হলে অথবা সে অবস্থায় যদি জাফরকে পাঠানো হয়, তাহলে পথিমধ্যে বিদ্রোহীরা তাঁকে উদ্ধারের চেষ্টা চালাতে পারেন।
শেষ পর্যন্ত ১৮৫৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, জাফরকে দিল্লি থেকে দূরে পাঠানো নিরাপদ নয়। যদিও তখন পর্যন্ত তাঁর চূড়ান্ত গন্তব্য নির্ধারণ করা হয় নি। এরপর সাব্যস্ত হয় লেফটেন্যান্ট ওমানে সাহেব নির্বাসনে বাদশাহের সাথে থাকবেন এবং নিশ্চিত করবেন যে, 'রাজবন্দি' (রায়ের পর জাফরকে এ বিশেষণে উল্লেখ করা হয়েছে) যেন পথে কারো সাথে কোনো যোগাযোগ করতে না পারেন।
মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ জহির উদ-দীন-মুহম্মদ বাবুর দিল্লি নগরী অধিকার করার ৩৩২ বছর পর ১৮৫৮ সালের ৭ অক্টোবর ভোর চারটায় শেষ মুঘল বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফর একটি গরুর গাড়িযোগে দিল্লি ত্যাগ করেন। তাঁর সঙ্গে যান স্ত্রী ও সম্রাজ্ঞী জিনাত মহল, অন্য এক স্ত্রী তাজ মহল বেগম, দুইপুত্র মির্জা জওয়ান বখত (সস্ত্রীক) ও মির্জা শাহ আব্বাস। এছাড়া ভৃত্য ও রক্ষিতা মিলে জাফরের মোট সফরসঙ্গী ছিলো ৩১ জন। পাহারার জন্য তাঁদের সাথে নিয়োজিত ছিল ৯ নম্বর ল্যান্সারবাহিনী। বাহন হিসাবে ছিল পালকি ও পালকি বহনকারী গরুর গাড়ি। এই পুরো দলটি একযোগে পথ চলেছে। অগ্রবর্তী দল হিসাবে সামনে ছিল ল্যান্সার অশ্বারোহীরা। একটি পালকিতে উঠেন জাফর ও তাঁ দুই পুত্র। এর চারপাশে ঘিরে ছিল ল্যান্সার প্রহরীরা। ছই ঢাকা গাড়িতে ছিল বেগম জিনাত মহল ও জওয়ান বখতের তরুণী স্ত্রী নওয়াব শাহ জমানী বেগম ও তাঁর মা মুবারক-উন-নিসা। তৃতীয় গাড়িতে ছিল রাণি তাজ মহল ও তাঁর সুদর্শন খোজা এবং পরিচারিকা। এর পেছনে রয়েছে পাঁচটি গোলা ভর্তি গরুর গাড়ি এবং জাফরের হারেমের পুরুষ ও মহিলা অনুচর। প্রতি গাড়িতে চারজন করে আরোহী এবং প্রতিটি গাড়ির প্রহরায় ল্যান্সারদের একটি দল নিয়োজিত ছিলো।
ইলাহাবাদে পৌঁছানোর পর ওমানে সাহেবকে বড় লাট জানালেন, বন্দিদের নিয়ে যেতে হবে রেঙ্গুনে (বর্তমান ইয়াঙ্গুন)। এই পুরো ঘটনায় অত্যন্ত গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়। তত দিনে দিল্লি থেকে বেরোনো ৩১ জন যাত্রীর অনেকে পিছু হটেছেন। ইলাহাবাদ থেকে 'টেমস' নামের স্টিমারে উঠলেন বাদশাহসহ ১৫ জন। ৪ ডিসেম্বর স্টিমার কলকাতার কাছে ডায়ম- হারবার গিয়ে থামে। এরপর স্টিমার পরিবর্তন করে বন্দিদের তোলা হলো 'এইচ এম এস মগারা' জাহাজে। সেখানে বাদশাহের জন্য আলাদা বিছানা ও তাকিয়া পেতে দেওয়া হয়। দিল্লি থেকে আসার পথে কানপুরে প্রথমবার রেলগাড়ি দেখেন বাদশাহ জাফর। জেলার ওমানে সাহেবকে সেদিন তিনি বলেন, "আচ্ছা, সমুদ্রে জাহাজ কিভাবে যায়? আমার খুব জাহাজে চড়তে ইচ্ছে করে।" প্রথমবার জাহাজে চড়ে এই ছিলো তাঁর রেঙ্গুন-যাত্রা। রেঙ্গুনের ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ছোট ছোট ৪টি কক্ষ। একটিতে বাদশাহ, অন্যটিতে বেগম জিনাত মহল, আর বাকি দু'টোয় সস্ত্রীক মির্জা জওয়ান বখত এবং মির্জা শাহ আব্বাস। এখানে দিনের বেলায় মাসকেট হাতে দু'জন ও রাতে তিনজন পাহারাদার নিয়োগ করা হয়েছে। বাদশাহকে এখানে কাগজ কলম দেওয়াও নিষিদ্ধ। গভীর বিষাদে গড়গড়ার নল মুখে নিয়ে শুয়ে থাকেন বৃদ্ধ বাদশাহ জাফর। রেঙ্গুন নদী বেয়ে ছুটে আসে হাওয়া, বেদনার মতো। ১৮৬২ সালের শেষ দিকে, বর্ষা মৌসুমের সমাপ্তির পর সহসা জাফরের অবস্থার অবনতি ঘটে। ক্যাপ্টেন ডেভিস এ সময়ে লেখেন, "তিনি (বাদশা) ঢোক গিলতে বা কিছু উদরস্থ করতে পারছেন না। তাঁর জীবন এখন সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। বৃদ্ধ লোকটিকে চামচ দিয়ে স্যুপ খাওয়ানো হচ্ছিল। কিন্তু ৩ নভেম্বরের মধ্যে দেখা গেল যে, তিনি আর স্যুপও গলধঃকরণ করতে পারছেন না।" ৫ নভেম্বর ডেভিস লেখেন, "সিভিল সার্জন মনে করেন যে, আবু জাফর আর বেশিদিন বাঁচবেন না।" পরদিন তিনি আবার উল্লেখ করেন যে, "বৃদ্ধ লোকটি নিশ্চিতই বার্ধক্যজনিত জীর্ণতা ও গলার পক্ষাঘাতে মৃত্যুপথযাত্রী।" মৃত্যুর পরে কবর তৈরির প্রস্তুতি হিসাবে ডেভিস ইট ও চুন সংগ্রহ করে রাখার নির্দেশ দেন। উল্লেখ্য, বাদশাহের মরদেহ দাফনের জন্য তার-বেষ্টনীর পেছনের দিকে একটি কবরও খুঁড়ে রাখা হয়।
চার.
অতঃপর সারারাত মৃত্যুর সাথে লড়াই করে বাহাদুর শাহ জাফর ১৮৬২ সালের ৭ নভেম্বর শুক্রবার ভোর পাঁচটায় ইন্তেকাল করেন। কোম্পানির জঘন্য প্রশাসনযন্ত্র শেষ মুঘল বাদশাহ'র মৃত্যু-সংবাদ যথাসম্ভব গোপন ও আড়ম্বরহীন নিশ্চিত করতে তৎপর হয়ে উঠে। জাফরের মৃত্যু ৩৫০ বছরের গৌরবময় একটি রাজবংশের অবসানের সূচক হতে পারে। এরূপ ভাবনা থেকে ক্যাপ্টেন ডেভিস নিশ্চিত করতে চেয়েছেন যে, এই দুঃখজনক ও ঐতিহাসিক মুহুর্ত যেন অতি কম সংখ্যক লোক অবলোকন করে। তিনি লেখেন, "সবকিছুই প্রস্তুত ছিল। তাঁকে সেদিনই বিকেল চারটায় কবরস্থ করা হয়। মূল প্রহরী-চৌকির পেছনে ইট দিয়ে গাঁথা একটি কবরে ঘাসের চাপড়া বসিয়ে দেয়া হয়।" জাফরের দুই পুত্র ও তাঁর পুরুষ অনুচরগণ শেষকৃত্যে উপস্থিত হন। ডেভিস তা উল্লেখ করেন। কিন্তু ইসলামি রীতির অনুসরণে মহিলারা উপস্থিত হন নি। ডেভিসের লেখা থেকে আরও জানা যায়, "কবরের চারপাশে বেশ কিছু জায়গা রেখে পুরো স্থানটিতে বাঁশ দিয়ে বেষ্টনী তৈরি করা হয়। যেন দ্রুত সময়ের মধ্যে বাঁশের বেষ্টনী বিনষ্ট হয়ে যায়। এতে ক্রমশ ঘাস স্থানটিকে আচ্ছাদন করবে। শেষ মুঘল বাদশাহ'র সমাধি কোথায়, তা আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।" পরদিন ডেভিস তাঁর দায়িত্বে ন্যস্ত করা মৃতের (বাদশাহ) ওপর একটি রিপোর্টে উল্লেখ করেন, "এ ঘটনার খুব সামান্য প্রভাব পড়েছে তাঁর আত্বীয়স্বজন ও শহরের মুসলমান জনগোষ্ঠীর ওপর। তাঁর জানাজার সময় সম্ভবত কয়েকশত লোক সমবেত হয়েছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে ছিল কিছু অলস প্রকৃতির লোক। যারা এসেছিল সদর বাজার থেকে এবং তারা যাচ্ছিল নিকটস্থ রেসকোর্সে ঘোড়দৌড় দেখতে। রেঙ্গুনের মুসলমান জনগোষ্ঠীর ওপর সাবেক বাদশাহের মৃত্যুতে তেমন প্রভাব পরিলক্ষিত না হলেও সম্ভবত কিছুসংখ্যক ধর্মানুরাগী মানুষ ঘটনা প্রত্যক্ষসহ ইসলামের চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য প্রার্থনা করেছে।" বাহাদুর শাহ জাফরের মৃত্যুর খবর দিল্লিতে পৌঁছে ২০ নভেম্বর। কবি মির্জা গালিব খবরটি পাঠ করেন 'অবধ আখবার'-এ। সেদিন ঘোষণা করা হয়, জুমা মসজিদ অবশেষে দিল্লির মুসলমানদের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে। অন্যান্য বহু মৃত্যু ও দুঃখজনক ঘটনার খবরে পাথর হয়ে যাওয়া গালিবের প্রতিক্রিয়া ছিল অনিবার্যের কাছে নিজেকে সমর্পণ করার মতো। তিনি লেখেন, "শুক্রবার, ৭ নভেম্বর, ১৪ জমাদিউল আউয়াল তারিখে আবু জাফর সিরাজ-আল-দ্বীন বাহাদুর শাহ বিদেশিদের বন্ধন ও রক্তমাংসের বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করেন। আমরা আল্লাহর কাছ থেকে এসেছি এবং তাঁর কাছেই আমাদের ফিরে যেতে হবে।" বাহাদুর শাহ জাফরের মৃত্যুর বিশ বছর পর ১৮৮২ সালে জিনাত মহল রেঙ্গুনে ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুর সময়ে জাফরের কবর সম্পর্কে কারো সঠিক ধারণা ছিল না । সবকিছু ততদিনে বিস্মৃত হয়ে গেছে এবং তা শনাক্ত করা সম্ভব হয় নি। ফলে জিনাত মহলের মরদেহ স্বামীর কবরের কাছাকাছি বলে অনুমিত একটি বৃক্ষের পাশে কবরস্থ করা হয়। দুই বছর পর মির্জা জওয়ান বখত হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র বিয়াল্লিশ বছর।
১৯০৩ সালে ভারত থেকে একদল দর্শনার্থী শেষ মুঘল বাদশাহের অন্তিম বিশ্রামস্থল পরিদর্শনে আসেন। কিন্তু তখন পর্যন্ত জিনাত মহলের কবরের সঠিক স্থানও শনাক্ত করা যায় নি। যদিও স্থানীয় কিছু লোক একটি গাছ দেখিয়ে তা নির্দেশ করেছে। ১৯০৫ সালে রেঙ্গুনের মুসলমানগণ প্রতিবাদের মাধ্যমে জাফরের কবর শনাক্ত ও চিহ্নিতকরণের দাবি তোলেন। তাঁরা তাদের দাবিনামায় উল্লেখ করেন যে, "গর্বিত মুঘল বংশের শেষ বাদশাহ'র শেষ বিশ্রামস্থলের ব্যাপারে রেঙ্গুনের মুসলমান সম্প্রদায় ক্ষুদ্ধ। একজন মানুষ অথবা একজন বাদশাহ হিসাবে বাহাদুর শাহকে প্রশংসা নাই-বা করা যেতে পারে, কিন্তু তাঁকে অবশ্যই স্মরণ করা উচিত।" তাঁরা সরকারের কাছে দাবি তোলেন, যে স্থানে কবরটি আছে বলে মনে করা হয়, সেই স্থানটি ক্রয় করে বাহাদুর শাহ জাফরের মর্যাদার উপযোগী একটি সমাধিসৌধ নির্মাণ করার জন্য। ১৯৯১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বাহাদুর শাহ জাফরের মাজারের পেছনে একটি নর্দমা খননের কাজে নিয়োজিত শ্রমিকগণ ইটে গাঁথা একটি কবর আবিস্কার করেন। এটির গভীরতা ছিল তিন ফুট। এতদিন ধরে যেটি বাদশাহের কবর হিসাবে পরিচিত ছিল তা থেকে আবিস্কৃত কবরের দূরত্ব প্রায় ২৫ ফুট। উল্লেখ্য, কবরের অভ্যন্তরে শেষ মুঘল বাদশাহ'র কঙ্কাল সম্পূর্ণ অক্ষত ছিল।
বর্তমানে বাহাদুর শাহের ইটে গাঁথা কবরটি, যা পুরনো কবর থেকে একটু নিচু অবস্থানে বিদ্যমান, সেটি রেঙ্গুনের মুসলমান জনগোষ্ঠীর কাছে তীর্থস্থান হিসাবে বিবেচিত। স্থানীয় মুসলমানগণ বাদশাহ জাফরকে এক ক্ষমতাবান সূফি দরবেশ বলে বিশ্বাস করেন। এবাদত-বন্দেগির জন্য তারা বাদশাহের সমাধিতে আসেন। তাদের বিশ্বাস, এতে মৃত বাদশাহের আত্মা নিশ্চয়ই শান্তি লাভ করবে। যেহেতু জীবদ্দশায় তিনি তাঁর অনুরাগী মানুষকে মুরিদ করতে পছন্দ করতেন। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিগণ (বিশেষত বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান) যখন রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে রেঙ্গুনে যান, তখন তাঁরা স্বভাবত বাদশাহ জাফরের কবর জিয়ারত করেন। এছাড়া সমাধিতে গিলাফ বিছিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফর জন্মভূমির প্রতি গভীর ভালবাসা, আবেগ ও দুঃখবোধ নিয়ে একদা লিখেছেন--
"কিতনা হ্যায় বদনসীব জাফর দাফন কে লিয়ে
দো-গজ জমিন ভি না মিলি কুওয়ে ইয়ার মে"।
অনুবাদ:
"জাফর, তুমি কতো দুর্ভাগা, নিজের দাফনের জন্য
প্রিয় জন্মভূমিতে দু'গজ মাটিও জুটলো না"।
রাজীব গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী থাকা কালে বাহাদুর শাহ জাফরের মাজারে মূল্যবান গিলাফ উপহার প্রদান করেন এবং দর্শনার্থী-বইতে একটি আবেগময় কবিতা লেখেন––
"দু'গজ জমিন তো না মিলি হিন্দুস্তান মে,
পার তেরী কোরবানী সে উঠি আজাদী কি আওয়াজ,
বদনসীব তো নাহি জাফর।
জুড়া হ্যায় তেরা নাম ভারত শান আউর শওকত মে
আজাদী কি পয়গাম সে"।
অনুবাদ:
"হিন্দুস্তানে আপনি দু'গজ মাটি পান নি সত্য,
তবে আপনার আত্মত্যাগ থেকেই আমাদের স্বাধীনতার
আওয়াজ উঠেছিলো,
দুভার্গ্য আপনার নয় জাফর।
স্বাধীনতার বার্তার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের সুনাম ও
গৌরবের সঙ্গে আপনার নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।"
রেঙ্গুনের ৬ জি'ওয়াকা সড়কে বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফরের সমাধি কমপ্লেক্স অবস্থিত। সেখানে এক শুক্রবার বাদশাহের কবর জিয়ারত করতে গিয়ে মনটা অতল বিষাদে ঢেকে যায়। বাদ-জুম্মা কবরের পাশে দাঁড়িয়ে এই মুসাফিরের জবানিতে বাদশাহের মর্মন্তুদ আখ্যান শোনে দূর-দেশের অভিন্নহৃদয় বান্ধবী অ্যামি লিলিয়ান। সহসা তার চোখ টলমল করে ওঠে। বাদশাহের জন্য তার নীল চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে যমুনার জলের মতো অশ্রু। অ্যামিকে ওই মুহুর্তে শান্তনা দেওয়ার মতো ভাষা অধমের জানা ছিল না। দীর্ঘ সময় ধরে নীরবতায় ডুবে যাই আমরা দু'জন। সত্যিকার অর্থেই বাহাদুর শাহ জাফর ইতিহাসের এক ট্র্যাজিক নায়ক। তাঁর জীবন বিষাদ-বঞ্চনা-অবহেলা আর উপেক্ষার চাদরে আচ্ছাদিত ছিল। তিনিই ছিলেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা। স্বাধীনতার চেতনার ভিত্তি তাঁর হাত ধরেই নির্মিত হয়েছে। তাই এই ইতিহাসের দিকে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে। বিপ্লবের ব্যর্থতা কেবল শোকগাথা নয়। এর মধ্যেই লুকানো থাকে উপনিবেশবাদ ও সা¤্রাজ্যবাদকে শনাক্ত করার দিক-নির্দেশনা। মুঘল ভারতে বাহাদুর শাহ জাফর ছিলেন শেষ প্রজ্জ্বলিত চেরাগ। তাঁর মর্মান্তিক আখ্যানের সঙ্গে সিপাহি বিদ্রোহের রক্তে রঞ্জিত ইতিহাসের পৃষ্ঠাগুলো নিঃশব্দে কাঁদছে। এ অবিস্মরণীয়।
- লেখক: চিত্রশিল্পী ও গবেষক