অবশেষে আশা জাগাচ্ছে ক্যানসারের ভ্যাকসিন
১৯শ শতকের শেষের দিকে নিউইয়র্কের সার্জন উইলিয়াম কোলি একটি চমকপ্রদ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তার একজন রোগী, যার গলার টিউমার তাকে মৃত্যুর প্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল, ত্বকের একটি গুরুতর ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণের পর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন। এরপর তিনি ভিন্ন রোগীদের শরীরে মৃত ব্যাকটেরিয়ার মিশ্রণ দিয়ে ক্যানসার চিকিৎসার চেষ্টা করেন এবং বেশ ভালো ফল পান।
কোলির ধারণা ছিল, সংক্রমণ রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে ক্যানসারের বিরুদ্ধে সক্রিয় করতে পারে। তার এই তত্ত্ব প্রথমদিকে বিতর্কিত থাকলেও ১৯৫০ সালের পর বিজ্ঞানীরা এটি মেনে নিতে শুরু করেন। বর্তমানে এটি ক্যানসার ভ্যাকসিন তৈরির একটি প্রধান ভিত্তি হয়ে উঠেছে। এই ভ্যাকসিনের লক্ষ্য হলো রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে প্রশিক্ষিত করে টিউমার সনাক্ত করা এবং তার বিস্তার রোধ করা।
মানবদেহের প্রায় যেকোনো কোষ থেকে ক্যানসার শুরু হতে পারে। স্বাভাবিকভাবে রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা টিউমারের মতো অস্বাভাবিক কোষগুলোকে শনাক্ত করে ধ্বংস করে। তবে, ক্যানসারের কোষগুলো প্রায়ই নিজেকে রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার নজর এড়িয়ে যাওয়ার মতো করে বিকশিত হয়। এই দুর্বলতাকেই এখন ওষুধ তৈরির নতুন লক্ষ্য হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ক্যানসার ভ্যাকসিন তৈরির জন্য প্রথমে টিউমারের নমুনা সংগ্রহ করে তার জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হয়। এরপর এতে থাকা মিউটেশনগুলো বিশ্লেষণ করে এমন প্রোটিন বা নিউঅ্যান্টিজেন সনাক্ত করা হয় যা রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সক্রিয় করতে পারে। এই ভ্যাকসিন শরীরে ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরকে এসব প্রোটিন তৈরি করতে বলে এবং টিউমারকে ধ্বংস করতে সাহায্য করে।
কোভিড-১৯ মহামারির সময় এমআরএনএ ভ্যাকসিনের দ্রুত উন্নয়নের কারণে ক্যানসার ভ্যাকসিন তৈরির প্রযুক্তিও দ্রুত এগিয়েছে। আমেরিকান কোম্পানি মডার্না এবং মার্ক সম্প্রতি তাদের তৈরি এমআরএনএ ক্যানসার ভ্যাকসিনের পরীক্ষা চালিয়েছে, যা মেলানোমা (এক প্রকার ত্বকের ক্যানসার) রোগীদের মধ্যে ক্যানসার পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি প্রায় অর্ধেক কমিয়ে দিয়েছে।
তবে এই ধরনের ভ্যাকসিনের উৎপাদন ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ। আরও সহজলভ্য ভ্যাকসিন তৈরির জন্য বিজ্ঞানীরা সাধারণ ক্যানসার মার্কার ব্যবহার করে 'অফ-দ্য-শেলফ' ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা করছেন। উদাহরণস্বরূপ, বায়োনটেকের একটি এমআরএনএ ভ্যাকসিন ফুসফুসের ক্যানসারের বিরুদ্ধে পরীক্ষাধীন রয়েছে।
ক্যানসার ভ্যাকসিন একদিন কেমোথেরাপি এবং সার্জারির মতো চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে আনতে পারে বলে আশা করছেন বিজ্ঞানীরা। এমনকি ভবিষ্যতে এই ভ্যাকসিনগুলো ক্যানসার প্রতিরোধের জন্যও ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এটি এখনো ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ। বিজ্ঞানীরা সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা করছেন।
ইতিমধ্যে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা একটি প্রতিরোধমূলক ওভারিয়ান ক্যানসার ভ্যাকসিন তৈরির জন্য তহবিল পেয়েছেন।
তবে এখনও অনেক প্রশ্নের উত্তর অজানা। ক্যানসারের কোষগুলো যখন একটি নিউঅ্যান্টিজেন তৈরি করে, তখন রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা কেন সেটিকে এড়িয়ে যায়, কিন্তু ভ্যাকসিন দিলে তা সক্রিয় হয়ে ওঠে—এটা এখনও স্পষ্ট নয়। তবুও, উইলিয়াম কোলির ধারণা শতাব্দী পরেও সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। ২০২৫ সাল হয়তো ক্যানসার ভ্যাকসিনের যুগ শুরু করার বছর হতে পারে।