ব্যবসায়ীদের পরামর্শ নিয়ে নীতি নির্ধারণে স্বাধীন রাজস্ব কমিশন গঠনের সুপারিশ
করদাতা হয়রানি কমানো ও কর ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে 'রাজস্ব কমিশন' নামে স্বাধীন সংস্থা গঠনের সুপারিশ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংস্কার বিষয়ক পরামর্শক কমিটি। ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ ও হিসাবরক্ষকসহ এ খাতের অংশীজনদের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে রাজস্ব নীতি প্রণয়নের উপর সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে।
করদাতাদের হয়রানি কমিয়ে ন্যায্য নীতি তৈরি করার লক্ষ্যে রাজস্ব আদায় ও নীতি প্রণয়নকে আলাদা করতে নব গঠিতব্য এ কমিশন সরাসরি অর্থমন্ত্রীর অধীনে কাজ করবে। টিবিএসের হাতে আসা সংস্কার বিষয়ক কমিশনের প্রতিবেদনে এমনটিই উল্লেখ করা হয়েছে।
রাজস্ব সংক্রান্ত আইন প্রনয়নে অংশীজনদের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে কমিশনে একটি স্থায়ী উপদেষ্টা পরিষদ করার প্রস্তাব করেছে সংস্কার বিষয়ক পরামর্শক কমিটি। এ উপদেষ্টা পরিষদে হিসাববিদ, প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী নেতা, থিংক ট্যাংক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, শিল্প মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, ট্যারিফ কমিশনের প্রতিনিধিরা থাকবেন।
পরিষদের দায়িত্ব হবে অংশীজনদের সাথে আলাপ-আলোচনা ও আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার ভিত্তিতে প্রণীত নীতিমালার আলোকে ন্যূনতম ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে রাজস্ব কমিশনকে নিয়মিত পরামর্শ দেওয়া।
এছাড়া, করদাতা ও কর আদায়কারী সংস্থার মধ্যে উদ্ভূত বিরোধ নিরসনে আপিলাত ট্রাইব্যুনাল, করদাতাদের হয়রানি হওয়ার অভিযোগ আমলে নিয়ে কাস্টমস ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনাল এবং আয়কর আপিলাত ট্রাইব্যুনালকে এনবিআরের প্রভাবমুক্ত রাখতে প্রস্তাবিত রাজস্ব কমিশনের অধীনে রাখার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিটি।
গত ২২ ডিসেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে সংস্কার বিষয়ক পরামর্শক কমিটির প্রধান ড. আব্দুল মজিদ অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেন। এ সময় সংস্কার কমিটির অন্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। ওই প্রতিবেদনে এসব বিষয় উল্লেখ আছে।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০৮ সালে ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাজস্ব নীতি ও প্রশাসন বিভাগ পৃথক করার আদেশ জারি করলেও ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার তা বাস্তবায়ন করেনি।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, এতে করে করদাতারদের ওপর হয়রানি কমবে এবং কর ন্যয্যতা প্রতিষ্ঠা সহজ হবে।
তবে অর্থনীতিদিরা বলছেন, কমিশন প্রধান সাধারণ রাজস্ব কর্মকর্তা না হয়ে এমন একজন হওয়া উচিত যার সামগ্রিক অর্থনীতি নিয়ে সাম্যক ধারণা আছে; পাশাপাশি সামগ্রিক প্রশাসন চালানোরও অভিজ্ঞতা আছে। এতে করে কমিশনে ব্যালান্স (সাম্যতা) আসবে।
এনবিআর সংস্কার বিষয়ক পরামর্শক কমিটির একাধিক রিপোর্ট দেওয়ার কথা রয়েছে উল্লেখ করে এনবিআরের জেষ্ঠ্য কর্মকর্তারা জানান, এটি পরামর্শক কমিটির প্রথম রিপোর্ট ছিল। পরবর্তী রিপোর্টগুলোতে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আব্দুল মজিদের নেতৃত্বাধীন সংস্কার বিষয়ক পরামর্শক কমিটি রাজস্ব কমিশনের কর্ম পরিধি, এনবিআরের জনবল ব্যবস্থাপনা ও করদাতা হয়রানি ও কর আদায় বাড়ানোর ব্যাপারে বিভিন্ন পরামর্শ দিতে পারে।
এছাড়া, কর নীতি সংক্রান্ত সেবা গ্রহণে অংশীজনদের যাতায়াত সহজসাধ্য রাখতে সচিবালয় ও রাজস্ব ভবনের বাইরে রাজস্ব কমিশনের অফিস স্থাপন করা যুক্তিযুক্ত হবে।
রাজস্ব নীতি সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের দক্ষ, নিষ্ঠাবান ও সৎ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এই কমিশন প্রধানের দায়িত্ব পাবেন– যার পদ মর্যাদা সচিব বা সিনিয়র সচিব হবে বলে জানান তারা।
ব্যবসায়ী নেতারা এ পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন
টিবিএস-এর সাথে আলাপকালে, বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) এর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম এ পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, "প্রস্তাবিত এই রাজস্ব কমিশন ব্যবসায়ী নেতাদের অভিজ্ঞতা নিজেদের মধ্যে শেয়ার করার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করবে; এছড়া, কমপ্লায়েন্স এবং রাজস্ব বাড়তে করদাতা-বান্ধব আইনের খসড়া তৈরিতেও সাহায্য করবে।"
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে অন্তর্বর্তী সরকারের যে দৃঢ় অভিপ্রায়, তা এই সংস্কার পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রতিফলিত হচ্ছে।
"এটি বাস্তবায়িত হলে, এখানে আরও বেশি জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে। এনবিআর থেকে ট্যাক্স-কাস্টমস সম্পর্কিত আপিলাত ট্রাইব্যুনালগুলো আলাদা করতে পারলে তা সুষ্ঠু কর ন্যায় প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে," বলেন তিনি।
তিনি আশা প্রকাশ করেন, প্রস্তাবিত কমিশন এনবিআরের সম্পদকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করে কর-টু-জিডিপি রেশিও বাড়তে সমর্থ হবে।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ বলেন, রাজস্ব আইন প্রণয়ন একটি টেকনিক্যাল কাজ। এরজন্য প্রয়োজন উপযুক্ত ও দক্ষ কর্মকর্তা । তিনি বলেন, "প্রস্তাবিত কমিশনের প্রধান এমন একজন হওয়া উচিত, যার অর্থনৈতিক বিষয়গুলোর উপর গভীর জ্ঞান, এবং আইন প্রয়োগ ও জনসেবা বিষয়ে অভিজ্ঞতা রয়েছে।"
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. শাহরিয়ার সংস্কার প্রস্তাবের প্রশংসা করে বলেন, "যারা আইনের খসড়া তৈরি করেন তাদের এটি প্রয়োগ করা উচিত নয়, বরং করদাতাদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে এনবিআরের আপিল ট্রাইব্যুনালগুলোকেও বিচার বিভাগের মতো স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে।"
রাজস্ব প্রশাসন ও নীতি বিভাগ পৃথকীকরণের যৌক্তিকতা কী?
সংস্কার প্রতিবেদনে রাজস্ব প্রশাসন ও নীতি বিভাগ পৃথকীকরণের যৌক্তিকতায় বলা হয়েছে, 'কর নীতি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন কাজ একই সংস্থা/প্রতিষ্ঠানের ওপর ন্যস্ত থাকায় নীতি প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও নিয়ন্ত্রণে আপোষকামিতা, দুর্নীতি ও স্বার্থের সংঘাতসহ নানান অনিয়মের অভিযোগ আসছে।'
গুরুত্বপূর্ণ দুটো কাজ একটি প্রতিষ্ঠানকে একসাথে করতে হয় বিধায় নীতি-নির্ধারক বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে নীতি প্রণয়নে বেশি সময় দিতে হয়। এতে প্রত্যাশিত রাজস্ব আদায় হচ্ছে না এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত কার্যক্রম নেওয়া যাচ্ছে না বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রস্তাবিত রাজস্ব কমিশনের কাজ কী হবে?
রাজস্ব কমিশন সরকারের উন্নয়নের নীতি কৌশল, অংশীজনদের প্রস্তাব-পরামর্শ ও আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার ভিত্তিতে নীতি প্রণয়নের কাজ করবে।
আয়কর, ভ্রমণ কর, দানকর, আমদানি-রপ্তানি শুল্ক, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক, ভ্যাট, আবগারি শুল্কসহ অন্য শুল্ক-কর হার নির্ধারণ করবে এই কমিশন।
এছাড়া এই কমিশন প্রয়োজনে শুল্ক-কর সংক্রান্ত বিধি-বিধান প্রণয়ন, সংশোধন ও পরিবর্তন করবে। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে কর অব্যাহতি দেবে। পাশাপাশি আইন ও বিধি, প্রজ্ঞাপনের ব্যাখ্যা প্রদান করবে।
এনবিআরকে স্বতন্ত্র বিভাগ করার সুপারিশ
পরামর্শক কমিটির অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে স্বল্প মেয়াদের সংস্কার হিসেবে, পুনর্গঠিত এনবিআরের কাঠামোকে শক্তিশালী করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আদেশ ১৯৭২ এর পুনঃ সংশোধন করা এবং অর্থমন্ত্রীর অধীনে এনবিআরকে স্বতন্ত্র বিভাগ করার পাশাপাশি বোর্ডে কর্মরত সদস্যসহ ঊর্ধ্বতন পদের মর্যাদা বৃদ্ধি এবং নতুন পদ সৃষ্টি করার সুপারিশ করা হয়েছে।
এছাড়া জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, অর্থবিভাগ ও লেজিসলেটিভ বিভাগ প্রস্তাবিত রাজস্ব কমিশন গঠনের কাজ করবে বলে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে সংস্কার প্রতিবেদনে।
মধ্যমেয়াদে আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক সংক্রান্ত আইন ও বিধি-বিধান সংশোধনের পরামর্শও দিয়েছে সংস্কার কমিটি।