আপনার স্মার্টফোনে কেউ আড়ি পাতছে? হয়তো শুধু বিজ্ঞাপনের টার্গেট করতে নয়
কর্তৃপক্ষের নজরদারির এ যুগে ডিজিটাল যোগাযোগের যন্ত্রে আড়িপাতা বা গুপ্তচরবৃত্তির ঝুঁকি থাকে সবসময়। শুধু কর্তৃত্ববাদী বা উন্নয়নশীল দেশে নয়— খোদ পশ্চিমা দেশগুলোতেও নজরদারি চলে নাগরিকদের মুঠোফোনে। এজন্য দুর্দান্ত সব স্পাইওয়্যার তৈরি হয়েছে। যেমন ইসরায়েলি সংস্থা এনএসও গ্রুপের তৈরি পেগাসাস স্পাইওয়্যার। স্মার্টফোনে আপনার একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার আরও উপায় আসছে প্রতিনিয়ত।
সরকারি গোয়েন্দাদের পাশাপাশি বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও ভোক্তার তথ্য হাতাতে আজ বিশ্বজুড়ে তৎপর। এই ধরনের তথ্য হ্যাকিং এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, মানুষের কথাবার্তা শুনে তিনি আগ্রহী হবেন এমন সব বিজ্ঞাপন তাঁর ফোনের অ্যাপগুলোতে দেখানো হচ্ছে। উন্নত বিশ্বে কেউ কেউ লক্ষ করেছেন, হয়তো তিনি দিনকতক আগে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছিলেন বাচ্চাদের একটি খেলনা কেনার বিষয়ে। আর কিছুদিন পর তাঁর ফোনের অ্যাপগুলোতে আসলো সেই খেলনারই বিজ্ঞাপন! তাহলে কী এসব বিজ্ঞাপনদাতারা আড়ি পেতে জেনে নিয়েছে?
ফোনে আড়িপাতার ভয় আরও উস্কে দিয়েছে সাম্প্রতিক এক ঘটনা। সম্প্রতি একটি মামলা আদালতের বাইরে বাদীপক্ষের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে নিষ্পত্তিতে রাজী হয়েছে অ্যাপল। পাঁচ বছর ধরে চলছিল এই মামলা, যেখানে অভিযোগ আনা হয়, ব্যবহারকারীদের অনুমতি ছাড়াই অ্যাপলের সিরি তাঁদের কথাবার্তা রেকর্ড করে সেই অনুযায়ী বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করেছিল ফোনে। মামলার একজন বাদী অভিযোগ করেন, চিকিৎসকের সাথে তিনি যে আলোচনা করেছিলেন— অবিকল একই শল্যচিকিৎসার বিজ্ঞাপন তাঁর ফোনের পর্দায় দিনকয়েকের মধ্যেই দেখতে পান।
অ্যাপল আদালতে দাবি করেছে, 'সিরির তথ্যকে কখনোই বিজ্ঞাপনী প্রোফাইল তৈরিতে কাজে লাগানো হয়নি, বা এজন্য তথ্য কারো কাছে বিক্রিও করা হয়নি।' এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো দোষ না থাকলে– আপসে মামলার নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিল কেন অ্যাপল?
আধুনিক যুগে স্মার্টফোন থেকে শুরু করে স্মার্টওয়াচ—আরও নানান স্মার্ট গ্যাজেট নিত্যদিন মানুষ ব্যবহার করছে। এগুলো আমাদের ওপর আড়িপাতে বলে যে তত্ত্ব রয়েছে, সেটি সবক্ষেত্রেই সত্য নয়। তবে প্রকৃত বাস্তবতা আমাদের ধারণার চেয়েও খারাপ।
ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট, এআই চ্যাটবট, গাড়ির স্মার্ট অ্যাপ বা অনেক ওয়েবসাইট আপনার কার্যক্রমের খতিয়ান রাখে। এমনকি আপনার লোকেশন, কথাবার্তা ও বাড়ির ভেতরে করা ভিডিও ট্র্যাকও করতে পারে— অনেক সময় আপনার অনুমতি ছাড়াই। পরে সেসব তথ্যকে বিজ্ঞাপন বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে কাজে লাগানো হয়।
বিজ্ঞাপনের জন্য কথাবার্তায় আড়িপাতার প্রয়োজন অতোটা নেই
স্মার্টফোনের বিভিন্ন অ্যাপ ও ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট সফটওয়্যারের ব্যবহারকারীর অনুমতি ছাড়াই অডিও রেকর্ড ধারণের বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ-ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ডেভিড শোফেন্স। স্মার্টফোন বা গ্যাজেটের মাইক্রোফোন কথাবার্তা রেকর্ডে ব্যবহার করে— সেই তথ্য দিয়ে বিজ্ঞাপন তৈরি করা হচ্ছে কিনা, সেটিই খতিয়ে দেখছেন তিনি।
অধ্যাপক শোফেন্স বলেন, এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা আমরা পুরোপরি উড়িয়ে দিচ্ছি না, তবে তা খুবই কম। তবে ঠিক কী হচ্ছে তা বলা মুশকিল। কোম্পানিগুলোর কাছে আমাদের তথ্য সংগ্রহের অনেক উপায় আছে, সেজন্য আমরা যা যা বলছি— তার সবকিছু শোনার প্রয়োজন নেই তাদের।
'তারা আমাদের সম্পর্কে এমন গভীরভাবে জানতে পারছে, যেটা কথাবার্তায় আড়িপাতার চেয়েও বেশি ভালোভাবে ব্যক্তির চরিত্রকে তুলে ধরে'- বলেন তিনি।
প্রথমে দেওয়া বাচ্চার খেলনা কেনার উদাহরণটিকে এবার অন্যভাবে ব্যাখ্যা করা যাক। ধরুন আপনি হয়তো খেলনা খুঁজতে অনলাইনে সার্চ করেননি, কিন্তু আপনার স্ত্রী করেছিলেন। সেই সূত্র ধরেই বিজ্ঞাপনদাতারা আপনার ফোনেও খেলনার বিজ্ঞাপন পাঠিয়ে থাকতে পারে। হয়তো আপনার স্ত্রী–ও এমন বিজ্ঞাপন দেখেছেন। অথবা কোনো বাচ্চাদের পার্কের বিজ্ঞাপন পেয়েছেন ফোনে? তাঁর উত্তরও আছে। আপনার গাড়ির স্মার্ট সফটওয়্যার মনে রাখে আপনার ভ্রমণের স্থান। হয়তো পরিবার নিয়ে কিছুদিন আগেই ঘুরে এসেছিলেন কোনো শিশুপার্কে। অনলাইনে সেই অবস্থান (আপনার অজ্ঞাতেই) শেয়ার করেছিল ট্র্যাকিং সফটওয়্যার। এরকম বিভিন্ন সেবা প্রদানকারী সফটওয়্যার কোম্পানির থেকে বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠান আপনার ব্যক্তিগত তথ্য কিনে নেয়। ফলে আপনার বাচ্চাদের বয়সের তথ্যও আছে তাঁদের কাছে।
তবে অনলাইনে এই বিজ্ঞাপন আপনি কেন পেলেন, সেবিষয়ে ব্যাখ্যা চাইলে স্পষ্ট ব্যাখ্যা পাবেন না। যা পাবেন তাও এতটাই অস্পষ্ট যে আপনি কিছুই বুঝবেন না। আর একারণেই আমরা ধরে নেই, ফোনে বিজ্ঞাপনদাতারা প্রায়শই আড়ি পাতে। আসলে কিন্তু তা নয়। আমাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিচরণ, বিভিন্ন ই-কমার্স সাইট বা সার্চ ইঞ্জিনে করা অনুসন্ধান—এসবই হচ্ছে বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে সম্ভাব্য ভোক্তার প্রোফাইল তৈরি করার মূল তথ্যসূত্র।
আন্তর্জাতিক একটি ভোক্তা অধিকার গোষ্ঠী— ইলেকট্রনিক ফ্রন্টিয়ার ফাউন্ডেশন এর পরিচালক জেসন কেলি বলেন, 'যখন তারা (বিজ্ঞাপনদাতারা) এসব তথ্য লুকায়, তখনই সেটা আপনাকে ভাবিত করে, এবং একটি উপসংহারে আপনি পৌঁছান।'
এরপরেও যদি আপনি মনে করেন ফোনের মাইক্রোফোন-ই যত নষ্টের গোঁড়া, তা ভেবে সান্ত্বনা পেতেই পারেন। আসলে তা কিন্তু নয়। কারিগরি বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, আপনার ফোনে যদি সবসময় আড়ি পাতা হতো— তাহলে ব্যাটারির চার্জ দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়াটা আপনার নজর এড়াতো না। তাছাড়া, এভাবে আড়িপাতার খরচ অনেক, এত খরচ বিজ্ঞাপন কোম্পানি করে না। এজন্য তাঁদের সহজ ও কম খরচের অন্যান্য উপায় আছে।