সুন্দর জীবনের খোঁজ করতে করতেই মানুষগুলো হারিয়ে যাচ্ছে
কয়েকবছর আগে ট্রেনে করে স্পেন থেকে রোমে যাওয়ার পথে বেশ রাতে হঠাৎ দুপদাপ শব্দ। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখলাম ৭/৮ জন লম্বা চওড়া পুলিশ আমাদের কামরায় এসে ঢুকেছে। বিদেশ-বিভূঁইয়ে হঠাৎ এরকম পুলিশ দেখে ভয়ই পেয়ে গেলাম। নিজের অজান্তে পাসপোর্টে হাত চলে গেল। দেখলাম তারা গিয়ে পাশের কামরা থেকে ৩ জন যুবককে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। ছেলেগুলোকে দেখে মনে হল পাকিস্তানি বা ভারতের বিহার অঞ্চলের। পরনে জিনস, জ্যাকেট হলেও বোঝা যাচ্ছিল যে এরা এশিয়ান। টানাটানি করে নিয়ে যাওয়ার সময় সবাই জেগে গেলেও, কিছুক্ষণ পর সব চুপচাপ।
খানিকক্ষণ পর আমি অযাচিতভাবে এগিয়ে ট্রেনের এটেন্ডেসকে জিজ্ঞাসা করলাম কাদের নিয়ে গেল পুলিশ? সাধারণত এসব দেশে এভাবে বাঙালী স্টাইলে কেউ কিছু জানতে চায়না। মেয়েটি একটু অবাক হয়ে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলল, এরা রিফিউজি। লুকিয়ে রোমে যাচ্ছিল। এখন এদের ক্যাম্পে নিয়ে গেল।
সেদিন প্রথম আলোতে মধ্য ইউরোপের দেশ বসনিয়া-হার্জেগোভিনা ও স্লোভেনিয়ার জঙ্গলে প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যে বাংলাদেশিসহ ছয়শো'রও বেশি অভিবাসন প্রত্যাশীর আটকা পড়ার খবর দেখে আমার ট্রেনে দেখা সেই যুবকদের কথা মনে হল। মানব পাচারকারী চক্রগুলো এদেরকে অ্যাড্রিয়াটিক সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিসহ ইউরোপের সমৃদ্ধ দেশগুলোতে পাঠানোর পায়ঁতারা করে। এরপর মানুষগুলো কেউ ঠাণ্ডায় মরে, কেউ মরে অনাহারে, আর কেউবা সাগরে ডুবে। ইউরোপ যাওয়ার জন্য ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে বাংলাদেশিদের মৃত্যুর খবর এখন আর নতুন কিছু নয়।
মানব পাচার একটি জঘন্য অপরাধ। মানুষকে ভাল জীবনের নিশ্চয়তা দিয়ে, তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে, কোমরে দঁড়ি বেঁধে পথে নামিয়ে দেয়। এরপর মানুষগুলো হয় মারা যায়, নতুবা বিদেশের জেলে পঁচে। রয়টার্সের প্রকাশিত প্রতারিত মানুষের ২৫টি ছবির সব কটিতেই বাংলাদেশিদের মুখ দেখা গেছে।
সেই বহু বছর আগে মনে হয় ৮০ এর দশকে আমার এক ভাই লিবিয়া গিয়েছিল এরকম আদম পাচারকারী গ্রুপের খপ্পরে পড়ে। পথে যেতে যেতে এমন কোন কষ্ট নাই, যা তাদের করতে হয়নি। বহু সময় পার হয়েছে পথে, না খেয়ে, শোয়ার জায়গা ছিলনা, টয়লেট ছিলনা। লিবিয়া যাওয়ার পর মোটামুটি ২ বছর বন্দী জীবন কাটিয়ে ফিরতে পেরেছিল। ফেরার সময় পকেটে ছিল না একটি টাকাও। পরে ভাইটা বুঝতে পেরেছিল সে ফ্রিডম পার্টির হাতে পড়ে লিবিয়া গিয়েছিল।
সেই থেকে বা তারও আগের থেকে চলছে। মরিয়া এই অভিবাসীদের কোনকিছুই আটকে রাখতে পারে না। এখান থেকে যারা যায়, তারা উন্নত জীবনের খোঁজে যায় কিন্তু মানব পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে জীবন শেষ হয়ে যায়। মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে বাংলাদেশিদের অবৈধভাবে ইউরোপ পাড়ি দেওয়ার ঘটনা অনেক দিন ধরে চলছে। এই মানুষগুলো এতটাই ডেসপারেট যে সাগর, নদী, আকাশ, বন-জঙ্গল, মরুভূমি কিচ্ছু তাদের ঠেকাতে পারেনা।
প্রথম আলোর রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে যে ২০১৫ সালে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে মালয়েশিয়ায় অভিবাসন প্রত্যাশীদের গণকবর আবিষ্কৃত হওয়ার পর বিষয়টি সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। গত মে মাসে খবরে দেখেছি ত্রিপোলী থেকে একটু দূরের একটি শহরে একজন লিবিয়ান স্মাগলারকে অভিবাসীরা রাগ হয়ে মেরে ফেলায়, তার পরিবার ৩০ জনকে হত্যা করেছিল। আর নিহতদের মধ্যে ২৬ জন বাঙালী।
বালি হয়ে পূর্ব তিমুরে যাওয়ার জন্য আগে বাংলাদেশীদের কোন ভিসা লাগতো না। কিন্তু বছর দুই আগে তিমূর যাওয়ার পথে দেখলাম নিয়ম খুব কড়াকড়ি হয়ে গেছে। আমন্ত্রণ পত্র ছাড়াও নানান কাগজপত্র ও নাড়ি-নক্ষত্র পরীক্ষা করছে। কারণ হচ্ছে এর আগে বহু বাংলাদেশী তিমূর হয়ে নৌকাতে চেপে অস্ট্রেলিয়াতে চলে গেছে বা যাওয়ার চেষ্টা করেছে। তাই এখন বেদম কড়াকড়ি এবং যাতায়াত বন্ধই বলা যায়। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা এ বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ভূমধ্যসাগর এবং স্থলসীমান্ত পাড়ি দিয়ে ইউরোপ পৌঁছানো ব্যক্তিদের তালিকা করতে গিয়ে উল্লেখ করেছে এদের মধ্যে বহু লোক মারা গেছে।
এরপরও পাচারকারীদের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করা যাচ্ছেনা। পাচারকারীরা নানা উপায়ে মানুষ ধরার ফাঁদ পাতে। কেউ বুঝে, কেউ না বুঝে এতে ঝাঁপ দেয়। অধিকাংশ মানুষই একটা উন্নত জীবনের কথা ভেবে যেকোন প্রকারে ইউরোপীয় দেশগুলোতে বা আমেরিকায় ঢোকার চেষ্টা করে। এভাবে ঢোকার চেষ্টা করে কেউ কেউ সফল হয়েছে। আর এই সফল হওয়া লোকগুলোর গল্প মানুষের মুখে মুখে ফেরে। এদের মতোই সবাই তখন সফল হতে চায়।
সেরকমই একজন মানুষ গোলাম রহমান। বার্লিনে একটি টেলিফোন বুথে দাঁড়িয়ে আমি দেশে কথা বলছিলাম। বাইরে বেরিয়ে এসে দেখলাম একজন বাঙালি ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। জিজ্ঞেস করলেন আমি বাংলাদেশী কিনা? বললেন, ভেতর থেকে আপনার গলা শুনে দাঁড়িয়ে গেছি। সেই ৮০ দশকের শুরুতে এদেশে এসেছি ভাগ্যের অন্বেষণে। কোথাও কোন বাংলাদেশীর খোঁজ পেলে এখনো পাগলের মতো ছুটে যাই। মনটা কান্দে দেশের জন্য।
টিকে থাকার জন্য জার্মান মেয়ে বিয়ে করেছিলেন কিন্তু বিয়েটা টেকেনি। উনি বলেছিলেন ওনাদের গ্রুপটা কীভাবে কত পথ পাড়ি দিয়ে এখানে এসেছিলেন, দালালের মারফত। তখন এত কড়াকড়ি ছিলনা বলে সেটেল করে গিয়েছিলেন। তবে বহুবছর দেশে ফিরতে পারেননি। উনি বলেন এখন আর সেটেল করা সম্ভব নয়। যদিও এখনো অনেক টাউট এটা রটিয়ে বেড়ায় যে একবার এদেশে ঢুকতে পারলে জায়গা করে নেয়া সম্ভব। উনি ২০০২ সালে একথা বলেছিলেন। সম্প্রতি ডয়েচে ভেলে জানিয়েছে জার্মানিতে আশ্রয় নেয়ার জন্য আবেদনকারী শরণার্থীদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর হার দ্রুতগতিতে বাড়ছে। তিউনিশিয়া, মরক্কো, আলজিরিয়া, রাশিয়া, আফগানিস্তান, পোলান্ডসহ আফ্রিকার অনেক দেশেই শরণার্থীদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে। তবে এই শরণার্থীরা সবাই ঠিক প্রকৃত শরণার্থীও সংজ্ঞায় পড়েননা। এরাও উন্নত জীবনের আশায় দেশ ছেড়েছিলেন।
যখন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে যুদ্ধ, গণহত্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এড়াতে দেশান্তরী হতে হয়, তখন তাদের শরণার্থী বলে। যেমন আমাদের দেশের রোহিঙ্গারা। তাদের হাতে আর কোন উপায় ছিলনা। তাদের বেঁচে থাকা বা মরে যাওয়া ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এরা জান বাঁচাতে নৌকা নিয়ে সমুদ্রে ভাসতে বাধ্য হয়েছিলেন। অনেকে সমুদ্রে ভেসে গেছেন, অনেকে হারিয়ে ফেলেছেন স্বজন, সহায়-সম্পত্তি, ভিটেমাটি। নারীরা হয়েছেন ধর্ষণের শিকার। এরপর প্রতিবেশি রাষ্ট্র বাংলাদেশ তাদের গন্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। যখনই কোন দেশ কাউকে শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দেবে, তখনই তার নির্দিষ্ট কিছু অধিকারকেও স্বীকৃতি দিতে হবে। যা দেয়া হচ্ছে রোহিঙ্গাদের। তারা আমাদের এখানে অনেকধরণের সমস্যাও তৈরি করেছেন। কিন্তু এরপরও তাদের সহায়তা দেয়ার বিষয়টি আমরা অস্বীকার করতে পারছিনা।
আমাদের মুক্তি সংগ্রামের সময় যারা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তারাও ঠিক এমনই শরণার্থী ছিলেন। দেশবিভাগের সময় বহু মানুষ ভিটেমাটি ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে গেছেন। আবার অনেকেই ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে এসেছেন। ধর্মের উপর ভিত্তি করে দেশভাগ যে কত শরণার্থী সৃষ্টি করেছিল, এর সঠিক হিসেব করা কঠিন।
মানুষের যেটা জন্মস্থান, সেটাই থাকে তার মনজুড়ে। তাই একান্ত নিরুপায় না হলে মানুষ কখনো স্থানচ্যুত হতে চায়না। দেশ থেকে দেশে শরণার্থী হওয়া ছাড়াও মানুষ নিজের দেশের ভেতরেও শরণার্থী হতে পারে। যেমন নদী সিকোস্তি মানুষজন। এদেরও পরিচয় হয় রিফিউজি নামে। আমি নীলফামারিতে গ্রামের বাড়িতে দেখেছি এরা গ্রামের অনেক বাসিন্দাকে নিপুজি (রিফুজি) পরিচয় দেয়। কেন এরা রিফিউজি? কারণ এরা নদীভাঙনের শিকার হয়ে এখানে বহুবছর ধরে বসবাস করছে। সময় এদের পরিচয় বদলে দেয়নি। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এবং সাম্প্রতিককালেও এই শরণার্থী হওয়ার বহু উদাহরণ আছে আমাদের সামনে। আমরা দেখেছি সেই শুরু থেকে ধর্মভেদ, নৃতাত্ত্বিক ভেদাভেদ, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক আগ্রাসন, স্বৈরাচারী মনোভাব, ক্ষমতার টানাপোড়েণ বিভিন্ন রাষ্ট্রকে ভেঙে টুকরা টুকরা করছে। মানুষ মারা যাচ্ছে, মানুষ পরিচয় হারাচ্ছে।
আলোচনা শুরু করেছিলাম সেইসব মানুষদের নিয়ে, যারা ভাল থাকার বা টাকা আয় করার জন্য যেকোন প্রকারে দেশ ত্যাগ করতে চায়। এরা যে সবাই নিরক্ষর তা কিন্তু নয়, সবাই যে বিভিন্ন দুর্ঘটনার কথা জানছেন না, তাও নয়। তবে অধিকাংশই আছেন, যারা কোন খোঁজখবর না জেনেই, দালালদের সাথে পরামর্শ করে পা বাড়াচ্ছেন এবং বিপদে পড়ছেন।
শুধু পুরুষরাই যে পাচারকারীদের হাতে পড়ছেন, তা নয়। বাংলাদেশি অনেক নারীকে পাচারের পর ভারতের বিভিন্ন যৌনপল্লীতে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে। প্রতিবছর কয়েক হাজার বাংলাদেশি নারীকে ভারতে পাচার করা হয় বলে বাংলাদেশ ও ভারতের মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে উল্লেখ করে ২০১৯ সালে ব্রিটিশ সংবাদসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে। তবে কত সংখ্যক নারীকে পাচার করা হয় সেই বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো পরিসংখ্যান নেই বলেও উল্লেখ করে সংবাদ সংস্থাটি।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন কাজ করতে গিয়ে দেখেছে যে অনেক মেয়েই ভারতে পাচার হয়ে যায় এবং যখন ফিরে আসে, তখন এইডস আক্রান্ত হয়ে এবং যৌন হয়রানির শিকার হয়ে ফিরে আসে। এদের অনেককেই শ্রম দাস হিসেবেও বিক্রি করা হয়। আর পরিবারও এদের ফেরত নেয়না।
২০১৬ সালে বিবিসি'র একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল জাতিসংঘের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে বিশ্বের ৩৪ শতাংশ নারী নিজ দেশেই পাচার হয়। আর ৩৭ শতাংশ আন্ত:সীমান্ত পাচারের শিকার হয়। বাংলাদেশ থেকে ভারত, মালযেশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদিসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে নারীদের পাচার করা হয়।
নারীদের পাচাররোধে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও দালালরা বসে নেই। দিনে দিনে নতুন নতুন পদ্ধতি খুঁজে বের করছে। জাতীয মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী গণমাধ্যমের কাছে বলেছিলেন পাচারের মামলার তদন্ত এবং বিচার যে হারে হচ্ছে তা সন্তোষজনক নয় বলেই, পাচার থামানো যাচ্ছেনা।
বাংলাদেশে দালালরা খুব শক্তিশালী। এদের শাখা-প্রশাখা দেশে বিদেশ ছড়ানো। এদেশের সেইসব মানুষকে এরা পুঁজি করে, যারা ভাগ্যের খোঁজে বুঝে, না বুঝে দেশ ছেড়ে চলে যেতে চায়। যেসব রিক্রুটিং এজেন্সি এসব অসাধু কাজের সাথে জড়িত, তাদের নাম পরিচয় সব জানে কর্তৃপক্ষ। কাজেই কঠোর হাতে এদের দমন করা উচিৎ। যেসব সংস্থা ও এজেন্সি পরস্পরকে দোষারোপ করে দায় এড়িয়ে যেতে চাইছে, তাদেরও নজরদারিতে আনা দরকার। নয়তো আরো বিপদ বাড়বে অসম্ভব স্বপ্ন দেখা সেই মানুষগুলোর
- লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন