পড়া বনাম সোশ্যাল মিডিয়া
- একটা শেয়াল তারের মধ্যে পেঁচিয়ে গেছে; একটা বুড়া লোক তাকে উদ্ধার করছে।
- নিম্মির (মেজর ডালিমের স্ত্রী) ক্যান্সার ছিল, তাকে হাউস অ্যারেস্ট করে রাখা হয় ১৯৯৬ থেকে... এমনকি খালেদা জিয়াও তাকে পাসপোর্ট দেয় নাই, ফলে ক্যান্সারে মারা যায়: মেজর ডালিম
- হোটেল এবং বাড়ির বুকিং বিভিন্ন দেশে
- একটা মেয়ে অযথা নাচছে
- একটা মেয়ে মার্কেট দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে (নেপথ্যে বিশ্রী হিন্দি গান)
এই হলো আমার টিকটকে এক মিনিট দেখা। এক মিনিটে কত কিছু দেখে ফেললাম। ভিডিওগুলো ১৫ সেকেন্ড; কোনোটা ক্যাপশনওয়ালা স্থির চিত্র। এবং আমরা সোশ্যাল মিডিয়াতে ইদানীং এসবই দেখি। দেখতে দেখতে আসক্ত হয়ে যাই। মনে হয় পুরো পৃথিবীর সবকিছু দেখে আমি জ্ঞানের ডিপো হয়ে গেলাম।
তারপর কোনো এক ফাঁকে কাজে ফিরে গেলাম। কী জানি লিখতে হবে। লিখতে বসে বাক্য শেষ করতে পারি না। মাথাটা ইদানীং কেমন যেন হয়ে গেছে। ছোট ছোট জিনিস অতিমাত্রায় দেখতে দেখতে বেশিক্ষণ মনোযোগ রাখতে পারি না।
এই ব্যাপারটা আমরা সবাই কমবেশি জানি। সোশ্যাল মিডিয়া খুবই আসক্তিকর। পাশ্চাত্যে এই নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। ২০১৮ সালের ব্রিটিশ একটা গবেষণা বলছে যে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে ঘুম বিঘ্নিত হয় এবং পর্যায়ক্রমে ছাত্রদের একাডেমিক পারফরম্যান্স খারাপ হয়ে যায়; বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয় এবং সরাসরি শারীরিক অবনতি ঘটে।
এত কিছু জানলেও আমাদের এই নিয়ে বিকার নেই। আমরা ব্যবহার করে যাচ্ছি এবং কেউ এটা নিয়ে কিছু বললে আমরা বলি, 'কথাটা একদম ঠিক!' তারপর এই কথাটা আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করি!
আবার কেউ এই ধরনের লেকচার দিলে খেঁকিয়ে ওঠে, আব্বে যা...নিজের চরকায় তেল দে!
সোশ্যাল মিডিয়ার সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে, যে কেউ সোশ্যাল মিডিয়ার তারকা হয়ে যেতে পারে। এর জন্য আপনার শিক্ষার দরকার নেই। আপনার কারও দয়ার ওপর নির্ভর করতে হবে না। আপনার যদি কোনো গুণ থাকে, আপনি গুছিয়ে কথা বলতে পারেন; সুন্দর রান্না পারেন; সেলাই পারেন কিংবা মানুষকে হাসাতে পারেন...এসব দিয়েই আপনি মানুষের কাছে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারেন। সফল না হলেও নিঃসংকোচে চেষ্টা করতে পারেন। কোনো গুণ না থাকলেও আপনি চেষ্টা করতে পারেন। বেসুরো গান গাইতে পারেন; আজাইরা নাচতে পারেন। কারণ, সোশ্যাল মিডিয়ার কনটেন্ট ক্রিয়েটর কিংবা শ্রোতাকে শিক্ষিত হতে হয় না।
এর ওপরে আপনি এখানে সফল হলে ডলার কামাতে পারবেন। বাংলাদেশের কত ইউটিউবার তাদের অতি সাধারণ কিন্তু জনপ্রিয় শো করে এত টাকা কামিয়েছে যে তারা তাদের বাবা-মাকে বিএমডব্লিউ গাড়ি উপহার দেয়। তাদের ওই বয়সে কোনো চাকরি বা ব্যবসা করে এই গাড়ি কেনা সম্ভব না!
এবং এই জন্য এখনকার অনেক ছেলেমেয়ে স্বপ্ন দেখে, সে ইউটিউব-ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামে ক্যারিয়ার গড়বে। সেপ্টেম্বরে একটা সংবাদ পড়েছিলাম, আমেরিকার ৫৭ শতাংশ জেন জি ছেলেমেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার ইনফ্লুয়েন্সার হতে চায়। কল্পনা করুন, একটা সমাজে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আর্কিটেক্ট, পুলিশ কিংবা আমলা যত, তার চেয়ে বেশি মানুষ ইনফ্লুয়েন্সার হতে চায়। এত লোক কি ইনফ্লুয়েন্স করবে? ফুড ব্লগার বলবে, এই রেস্টুরেন্টে খাও; ফ্যাশন ব্লগার বলবে, এই পোশাক কেনো; সিনেমা ক্রিটিক বলবে, এই সিনেমাটা দেখো; কিন্তু আসল ব্যবসাটা করবে কে? অধিকাংশই তো ইনফ্লুয়েন্সারÑকথা বলা ভাব নেওয়া কিছু মানুষ। তারা ইনকাম করে আসলে ব্যবসার বিজ্ঞাপন- প্রমোশন থেকে। সবাই ইনফ্লুয়েন্সার হলে ওই সব ব্যবসা চালাবে কে?
সোশ্যাল মিডিয়ার ভালো দিক বললাম; এবার খারাপ দিকটা বলি।
সোশ্যাল মিডিয়ার সবচেয়ে বড় শিকার হয়েছে মানুষের পড়ার অভ্যাস। যেই মানুষ এক মিনিটে পাঁচটা ভিডিও দেখে, সে পড়বে কীভাবে? তার মনোযোগ নষ্ট হতে বাধ্য। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে পড়াশোনা এক্সাইটিং কিছু না; যেখানে পড়ার জিনিসের প্রচুর অভাব; যেখানে পারিবারিকভাবেও বই কিংবা পত্রিকা পড়ার অভ্যাস অধিকাংশ মানুষের নেই।
বাংলাদেশের পত্রিকার কাটতি ৭-৮ বছর আগে যা ছিল, তা এখন অনেক নিচে নেমে গেছে। যে পত্রিকার দৈনিক কাটতি ছিল ৫.৫ লাখ, সেটা এখন দুই লাখের নিচে। যার বই ৬০০০ কপি বিক্রি হয়েছে এক বইমেলায়, এখন সেটা কমে ২৫০০-এ নেমে এসেছে। কোনো বাংলা বইয়ের ডিজিটাল কপি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছে পাইরেটেড কিংবা অফিশিয়ালভাবে, সেটাও শুনিনি।
বাংলাদেশে আশির দশকে সেবা প্রকাশনীর বই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হতো! মাসুদ রানার বইগুলো একেকটা এক-দুই মাসে ৪০০০০ কপিও বিক্রি হতো (আমাকে সেবা প্রকাশনীর একজন সম্পাদক বলেছিল); যা বোধ হয় বাংলাদেশের যেকোনো টাইটেলের মধ্যে স্বল্প সময়ে সর্বাধিক বিক্রিত। হুমায়ূন আহমেদের বই হয়তো লাখ কপি বিক্রি হতো (আমি ঠিক জানি না)! তবে বাংলাদেশে কখনোই কোনো গল্পের বই মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়নি, সেটা আমি নিশ্চিত!
এদিকে গত ৭-৮ বছরে বাংলাদেশের মিডিয়াগুলো ডিজিটালি আরও জনপ্রিয় হয়েছে। কিন্তু তাদের সংবাদ ওয়েবসাইট যত না জনপ্রিয়, তার চেয়ে জনপ্রিয় তাদের ইউটিউব চ্যানেল, যেটা দেখতে শিক্ষা লাগে না বা পড়তে হয় না।
আপনি বলবেন, এই যুগে এটাই স্বাভাবিক।
না, এটা স্বাভাবিক না। আমাদের সমাজ পড়তে চায় না। যেকোনো সমাজ থেকে আমরা বেশি পড়াবিমুখ। জাপানে শিশু-কিশোর-তরুণেরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মাঙ্গা (কমিকস) পড়ে এবং পৃথিবীতে একসময় পত্রিকার সবচেয়ে বেশি প্রিন্ট সার্কুলেশন ছিল জাপানে। সেখানেও ডিজিটাল পরিবর্তন হয়েছে। এখন তাদের মাঙ্গা ডিজিটালি প্রকাশিত হয়। এবং সেসব ডিজিটাল বইয়ের পাঠক কেমন, শুনলে বুঝবেন আমরা আসলে কিছুই পড়ি না!
জুজুৎসু কাইসেন নামের একটা মাঙ্গা কয়েক বছর ধরে ব্যাপক জনপ্রিয়। এই পর্যন্ত এই মাঙ্গা সিরিজ বিক্রি হয়েছে ১০০ মিলিয়ন কপি! মানে ১০ কোটি! এটা শুধু একটা টাইটেল!
জাপানে কি মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় নাচানাচি করে না? সেখানে কি পিনাকী-ইলিয়াস নেই? সেখানে কি আজাইরা ইনফ্লুয়েন্সারদের দাপট নেই? সব আছে! কিন্তু তার চেয়ে বেশি আছে পাঠক!
পাঠক না থাকলে সমস্যা কী? আপনি বলতেই পারেন!
পাঠক নেই মানে লেখক নেই; লেখাপড়া নেই! এখানে চাপাবাজি সবকিছু। আমেরিকায় বসে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র বানিয়ে দিব্যি 'সত্যি বলিয়ে' সাহসী সাংবাদিক হওয়া বাংলাদেশেই সম্ভব।
লেখাপড়া নেই মানে জটিল চিন্তা করার ক্ষমতাও নেই আমাদের। আর তাই আমরা সোশ্যাল মিডিয়াতে যা খুশি খাই। আমরা সোশ্যাল মিডিয়ার ভালো কোনো কনটেন্ট তৈরি করার ক্ষমতা রাখি না।
আমরা টিবিএসে ভিডিও বানাই। একবার একজন আমাদের কাছে এসেছিল ভিডিও সেকশনে চাকরির জন্য। তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, আপনি কী ধরনের কনটেন্ট বানিয়ে আমাদের চ্যানেল পপুলার করতে পারেন? তার উত্তর ছিল চমৎকার: আপনি যেই ভিডিওই বানাবেন, তার কিছু দর্শক থাকবেই! আমি যদি পাঁচ মিনিটে একটা রাস্তার গাড়ি চলাচলের ভিডিও বানাই, দেখবেন সেটাও কিছু লোক দেখবে! সে কিন্তু সত্যি কথাই বলেছিল!
পড়া হচ্ছে ব্রেনের ব্যায়াম। আপনি পড়বেন, আপনার ব্রেন আপনার মনে সিনেমা তৈরি করবে; আপনাকে গুছিয়ে কথা বলা বা লেখা শেখাবে। আপনি যখন পড়ছেন এবং পড়াটা অনুধাবন করছেন, আপনার মনোযোগ তখন তুঙ্গে। আপনার অন্য সব ইন্দ্রিয় তখন একটা জায়গায়! পড়া হচ্ছে প্রার্থনার মতো শক্তিশালী মানবিক একটা কাজ।
আর আপনি কিন্তু টিভি ছেড়ে ফোনে সোশ্যাল মিডিয়া দেখেন। আপনার কোনো মনোযোগ কোথাও নেই। চোখ একবার টিভিতে, একবার সোশ্যাল মিডিয়ায়। আপনার মন নেশাখোরের মতো আচ্ছন্ন। আপনি কিছুই দেখছেন না! একটা মজার মিম দেখে হাসছেন; একটা নিউজ হেডলাইন দেখে রিঅ্যাক্ট করছেন; তারপর বিজ্ঞের মতো আপনি কমেন্ট করছেন। আপনি আপনার ডেভেলপমেন্ট বন্ধ করে ভাসছেন।
হ্যাঁ। বেশি পড়াশোনা করা মানুষ আবার বিপদে পড়ে।
আমি ছোটবেলায় ভালো ছাত্র ছিলাম না। কিন্তু আমার বাবা ছিল বইপোকা। ছোটবেলা থেকে আমাদের বাসায় হাজার হাজার বই, শত শত কমিকস ছিল। বইয়ের আলমারি আর ট্রাঙ্কে ইঁদুর আশ্রয় নিত। আমার ছোটবেলায় আমি বইয়ে আসক্ত ছিলাম। আমরা প্রতি মাসে বেইলি রোডের বাসা থেকে সেগুনবাগিচায় সেবা প্রকাশনীর অফিস যেতাম গরম গরম 'কুয়াশা' সিরিজের বই কেনার জন্য কারণ, তখন 'কুয়াশা' ছিল শিশু-কিশোরদের সবচেয়ে জনপ্রিয় সিরিজ! এখন এ ধরনের কিছুই নেই!
আমার স্কুলের বন্ধুরা অধিকাংশই এত বই পড়েনি। এর ফলে আমার কমন সমস্যা ছিল, অনেকে আমাকে আঁতেল বলে ভেঙ্গাত (কারণ, আমি একটা জিনিস জানি, ওরা জানে না)! আমার এক খালাতো ভাই প্রায়ই বলত, এহ, উনি সব জানেন!
আপনি বেশি পড়লে আরেকটা সমস্যা হচ্ছে, আপনি প্রচুর মানুষের ওপর বিরক্ত হবেন! বিশেষ করে যখন দেখবেন, তারা কত স্টুপিড!
সে জন্য বলি, অনেক পড়ার সাথে সাথে নিয়ন্ত্রিতভাবে সোশ্যাল মিডিয়া দেখে নিজেকে আপডেট করে রাখবেন, যাতে মানুষের গাধামি আর অজ্ঞতা দেখে অবাক না হয়ে যান! কিন্তু আপনি পড়ুন এবং আপনার পরিবারকে পড়তে উৎসাহ দিন! তারা প্রিন্ট বই কিংবা লেখা না পড়ুক, ডিজিটালি পড়ুক! তবে তা সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট না, পরিপূর্ণ গল্প, প্রবন্ধ, সংবাদ কিংবা গবেষণাপত্র! আপনারা না পড়লে বাংলাদেশে ভবিষ্যতে শুধুই অন্তঃসারশূন্য চাপাবাজ থাকবে! আর কিছুই থাকবে না!