রোদের ঘ্রাণ আর বাতাসের রঙ
১.
রেডিওর সকাল
সকাল ছ'টায় কেউ রেডিও খুলে দিলে স্টেশন খোলার আগের ট্রেডমার্ক যন্ত্রসঙ্গীতটা শুনে সকালের ঘুম ভাঙতো। অত সকালে আমাদের ওঠার তাড়া ছিল না। স্কুল ছিল দশটার পরে – সোয়া দশটায় অ্যাসেমব্লি, সাড়ে দশটায় রোল কল। বাসা থেকে সাড়ে নয়টায় বের হলেও চলে, হেঁটে হেঁটে ঠিক সময়ে পৌঁছে যাওয়া যেত। কিছু মেয়ে ছিল যারা আটটা বাজলেই ইউনিফর্ম পরে বাসা থেকে বের হয়ে পড়তো। আমরা এদেরকে বলতাম 'পাড়া টোকানি'। এরা এক বাসা থেকে আরেক বাসায় গিয়ে সেই বাসার মেয়েকে রেডি করিয়ে নিয়ে বের হতো। এভাবে পৌনে দশটা বাজতে বাজতে মেয়েদের একটা বড় দল জড়ো হয়ে একসাথে হেঁটে সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে যেত। ছুটির সময়ও এরা দল বেঁধে গল্প করতে করতে ফিরত।
'অ্যাই মাঠা, মাখন, ক্ষীরমোহঅঅন' বলতে বলতে অত সকালেই ঘোষ কাকা চলে এসেছেন। একটা বাঁশের বাঁকের একপ্রান্তে একটা বড় ঝকঝকে স্টিলের টিনে মাঠা। তার উপরে কাঠের খাঞ্চাতে মাখন আর কাঁচা ছানা রাখা। আরেক প্রান্তে একটা বড় অ্যালুমিনিয়ামের হাড়িতে সিরায় ডোবানো ক্ষীরমোহন। তার উপরের ছোট হাড়িতে পানিতে ডোবানো ছোট ছোট কাচের গ্লাস। এটা পেট সচেতন বড়দের মাঠা বা ঘোল পানের সময়। কাশেম আলী তার মুদি দোকানের সামনে মাঠার গ্লাসে মাখন ভাসিয়ে বেশ তরিবত করে খাচ্ছেন। যেদিন পাড়ার দোকান থেকে কলি ব্রেড বা মডার্নের পাউরুটি কেনা হতো, অথবা আগের দিন সন্ধ্যায় আব্বু যদি মৌচাকের পলি ব্রেড থেকে আভেন-ফ্রেশ পাউরুটি নিয়ে আসতেন তাহলে ঘোষ কাকার কাছ থেকে কলাপাতায় মোড়ানো মাখন কেনা হতো।
সোয়া ছয়টায় টুউট্ টুউট্ টুঁঊঊ শব্দে 'রেডিও বাংলাদেশ' অনুষ্ঠান শুরু করত। পবিত্র কোরআন তিলওয়াত, তরজমা ও তাফসীরের পর প্রভাত সঙ্গীত বেজে উঠত। আমরা তখনও বিছানায়। আম্মু রান্নাঘরে রুটি বা পরোটা, আলু ভাজি, ডিম অমলেট, চা বানাতে ব্যস্ত। আব্বু পেতলের রেজরে সেভেন ও'ক্লক ব্লেড লাগিয়ে শেভ করে রেডি হচ্ছেন। ব্লেডের প্যাকেটের উপরে লেখা 'Do not wipe blade'। আমি আব্বুর কাছ থেকে wipe শব্দটার মানে শিখলাম।
সুবলের চায়ের দোকানের শিকের চুলায় কয়লা ভরে আগুন দেয়া হয়েছে। সুবলের ছেলে শহীদ তালের পাখা দিয়ে প্রাণপণে চুলায় বাতাস করছে, আর অহিদ চায়ের কেতলিগুলো ধুচ্ছে। সকালের প্রথম কাপ চা পানের জন্য মুরুব্বীদের দল হাজির হয়ে রেডিওতে খবর ধরার জন্য তাড়া দিচ্ছেন। হকার বজলু আর তার কিশোর শ্যালক বাসায় বাসায় খবরের কাগজ বিলি শুরু করেছে। আমাদের বাসায় 'ইত্তেফাক' রাখা হয়। অত সকালে আমাদের বাসায় কেউ 'পেপার' পড়ত না, আমরা স্কুল থেকে ফিরে আদ্যোপান্ত পড়তাম।
সকাল সাতটা, আপা আমাদেরকে তাড়া দিয়ে ঘুম থেকে তুলছেন। আমরা মটকা মেরে আরেকটুক্ষণ বিছানায় থাকার চেষ্টা করছি। রেডিওতে সরকার কবীর উদ্দিন বা সিরাজুল মজিদ মামুন খবর পড়ছেন। আফগানিস্তানের কুনার প্রদেশে সোভিয়েত বিমান হামলা, ফকল্যান্ডে ব্রিটিশ ডেস্ট্রয়ার এইচএমএস শেফিল্ডে আর্জেন্টিনার মিসাইল হামলা, ইরাকের বিমান হামলায় ইরানের আবাদান শহরের তেল শোধনাগার জ্বলছে, ৬৬ দিন অনশন শেষে ববি স্যান্ডস আর ৫৯ দিন অনশন শেষে ফ্রান্সিস হিউজেসের মৃত্যু মার্গারেট থ্যাচার নির্বিকার। আমরা ইয়ারা বা উইজডম বা গ্লোব টুথব্রাশে ডি-ফাইভ বা স্পার্কল বা পেপস টুথপেস্ট লাগিয়ে প্রাণপণে ব্রাশ করছি। মাথার ভেতর সুইমিং পুলের পাশে বিচ চেয়ারে টী-শার্ট পরা নাজমা জামান গিটারে ঝংকার দেয় –
ঝকঝকে দাঁত যদি চান, সুন্দর হাসি যদি চান
পেপস ফ্লোরাইড টুথপেস্ট ব্যবহারে
ভরে উঠবে সদা মন-প্রাণ
দাঁতের ক্ষয়রোধ করবে, আজীবন সুন্দর রাখবে
পেপস ফ্লোরাইড টুথপেস্ট, পেপস ফ্লোরাইড টুথপেস্ট
বাসার ছোট গেটটা ঠেলে নরেশ কাকা তাঁর শাক-সবজির টুকরি নিয়ে হাজির। আম্মু দুপুরে রান্নার জন্য সবজি দরদাম করছেন। ভূত চতুর্দশীর দিন চৌদ্দ রকমের শাক, শাকরাইনের দিন একুশ রকমের সবজি, আশ্বিনে রেঁধে কার্তিকে খাওয়ার দিন নারকেল, কলা। ভাড়ালি, মোচা, বন ভাড়ালি, পঞ্চমুখি, পেস্তা আলু, তরুকলা, মৌ সীম, বক ফুল... অন্য ভুবনের সব সবজি। গিমা, মেথি, বথুয়া, ঘাগড়া, হেঁচি, কুসুইল্যা... অন্য পৃথিবীর সব শাক।
সোয়া সাতটা, আব্বু অফিসে চলে গেছেন, খবরের নামে সামরিক শাসক আর তার গোলামদের গুণকীর্তন শেষ, এখন কৌশিক আহমেদ 'আজকের ঢাকা' শুরু করেছেন। আমরা কান খাড়া করে শুনি কোথায় কী অনুষ্ঠান আছে। সন্ধ্যা সাতটায় গাইড হাউজ মিলনায়তনে অথবা মহিলা সমিতি মঞ্চে নাটক।'পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়', 'দুই বোন', 'দেওয়ান গাজীর কিস্সা', 'গরুর গাড়ীর হেডলাইট', 'আজরাইলের পোস্টমর্টেম', 'কীর্ত্তনখোলা', 'কেরামতমঙ্গল', 'ওরা কদম আলী'...... থিয়েটার, আরণ্যক, প্রতিদ্বন্দ্বী, পদাতিক ......। বিকাল পাঁচটায় পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে শর্ট ফিল্ম। 'আগামী', 'হুলিয়া' ......।
শুক্রবার হলে বায়তুল মোকাররম, রমনা ভবন, গুলিস্তান হকার্স মার্কেট বন্ধ। সোমবার হলে শিশু পার্ক, নিউ মার্কেট, গাউছিয়া মার্কেট, চাঁদনী চক, চিশ্তিয়া মার্কেট, বলাকা ভবন আর ঢাকা কলেজের সামনের দোকানপাট বন্ধ। কোন দিন বাহাদুর শাহ্ পার্কের ইতিহাস, কোন দিন গুলিস্তানের কামানের ইতিহাস, কোন দিন বাখরখানি রুটির ইতিহাস। মঙ্গলবার হলে কৌশিক আহমেদ 'মঙ্গলবার দিনটি আপনাদের জন্য মঙ্গলময় হোক' বলে শেষ করতেন।
সাড়ে সাতটা, আমাদের হাত-মুখ ধোয়া হয়ে গেছে, নাশতা দেয়া হয়েছে– রুটি-ভাজি অথবা রুটি-গুড় অথবা পরোটা-ডিম অমলেট অথবা পাউরুটি-মাখন। রেডিওতে সপ্তাহের সেরা গান এন্ড্রু কিশোরের গলায় 'সাগরের বিশালতায় ছড়িয়ে দিয়েছ হাসি, নীলাকাশ কত সুন্দর' বাজছে। আমরা সকালের পড়া পড়তে বসেছি। বাংলা আর ইংলিশ হাতের লেখা, অংকের হোমওয়ার্ক বাকি। দ্রুত গতিতে পাইলট, উইং সাং বা হোয়াইট ফেদার কলম চলছে। আপার পছন্দ পেলিকানের ব্ল্যাক কালি, আমার পছন্দ ইয়োথের রয়্যাল ব্লু। পঁচা হচ্ছে কমেটের ব্লু-ব্ল্যাক কালি। লেখা শেষে দ্রুত হাতে ব্যাগ গোছানো হচ্ছে, ক্লাসের বইয়ের ফাঁকে 'পেনসিল আর সর্বকর্মার অ্যাডভেঞ্চার' অথবা 'তিয়াপা, বরকা আর রকেট' ঢুকে যায়।
অ্যালুমিনিয়ামের বড় হাড়িতে করে মাছ নিয়ে মাছওয়ালারা হাজির হয়ে গেছেন। বজরি, কাইক্যা, খইলসা, গুতুম, খল্লা, রাগা, ঘাউড়া, চাপিলা, চেলি ...... কখনো কখনো সাত দিন ধরে নানা রকম সামুদ্রিক মাছ আসে, কেউ কোনটার নাম জানেন না। একেক বাসায় একেক রকমের সামুদ্রিক মাছ কিনে ভাগ্য যাচাই করা হয়। বিকালের মেয়েলী আড্ডায় খালাম্মা-মাসীদের মধ্যে মত বিনিময় হয় কার মাছটা কেমন ছিল। পোয়া মাছ দেখে নাক সিঁটকে বললাম, পোয়া মাছ খাবো না। বিস্মিত বিক্রেতা বলেন, পোলায় কয় কী! গাঙ্গের মাছ বলে খাইত না!
আটটা বাজে। রেডিওতে আবারও কৌশিক আহমেদ অথবা আবু নওশের রেডিও ম্যাগাজিন 'দর্পণ' শুরু করেছেন। আমরা কান পেতে থাকি কখন আশীষ কুমার লোহের রেডিও কার্টুন শুরু হবে। তিনি একাই চারটা-পাঁচটা চরিত্রে অভিনয়ের সাথে কয়েকটা পশুপাখির আওয়াজ পর্যন্ত করেন। এখনো গোসল করা, ইউনিফর্ম পরা বাকি। আমাদের টিফিন নেবার কোন ব্যাপার নেই। বোনদের স্কুলে টিফিন দেয়, আমি স্কুলের গেটের বাইরে সিরাজ বা পাপ্পুর কাছ থেকে ঝালমুড়ি, চানাচুর, ঘুঘনি, সেদ্ধ ডিম আর আরও দশটা লোভনীয় খাবার থেকে কিছু একটা খাই।
সুরবানু খালা এসে গেছেন। গতকাল রাতের থালাবাসন হাড়িপাতিল ধুয়ে ছাই দিয়ে মাছ কুটতে বসেছেন। আম্মু শাক সবজি কুটছেন। রাস্তায় কালা সাবান আর ছাই বেচার খালাদের ডাক শোনা যায় 'কালা সাবান নিবেন নি, কালা সাবান'!
সকাল নয়টা। রেডিওতে পাঁচ মিনিটের খবর শুরু হয়েছে। এই খবরে কারো মন নেই। কারণ, এটা সাতটার খবরের সংক্ষিপ্তরূপ। লেইসফিতাওয়ালা তালেব আলী তার জাদুর বাক্স নিয়ে হাজির। ডান হাতে একটা কাচের ঢাকা লাগানো কাঠের বাক্স, বাঁ কাঁধে কাপড় পেঁচিয়ে বাঁধা দুটো মস্ত কাগজের কার্টন। নিউ মার্কেট গাউছিয়ার ফুটপাথে মেলে এমন সব জিনিসের কমপ্লিট সম্ভার! এক বাসাতে নামলে আশেপাশের মেয়ে-মহিলারা এসে ভীড় জমান।
সাড়ে নয়টা বেজে গেছে, আর সময় নেই। কাঁধে নীল শোল্ডারলেস দেয়া দুই পকেটওয়ালা সাদা শার্ট, বাম বুকে প্লাস্টিকের মনোগ্রাম, নেভি ব্লু প্যান্ট, সাদা মোজা, কালো লেদার শু। গোলাপী কামিজ, সাদা ভাঁজ করা ওড়না, সাদা তিনকোনা স্কার্ফ, গোলাপী বেল্ট, সাদা সালোয়ার, সাদা কাপড়ের জুতা। ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে একের পর এক চেঁচিয়ে 'আম্মু যাই!' বলে স্কুলের দিকে ছুট। হুশ করে সকালটা ফুরিয়ে যায়।
২.
বাজে বকা রাত্রি দিন, অ্যাসটেরিক্স টিনটিন
১৯৭৭ সালে রেনে গসিনি যখন চলে যান আমি তখন স্কুলের একেবারে নিচু ক্লাসের ছাত্র। তখন তাঁর লেখা কমিক পড়া দূরে থাক তাঁর নামও শুনিনি। তার অনেক বছর পরে আমি যখন তাঁর লেখা কমিক পড়তে পাই তারও আগে তাঁর কাজ সম্পর্কে টুকটাক জানতে পাই। কিন্তু তখনও তাঁর কমিক পড়তে না পাবার কারণ দুটো। এক, আমার সার্কেলে অ্যাসটেরিক্স কখনো জনপ্রিয় কমিক ছিল না। দুই, অ্যাসটেরিক্সের দাম বেশি।
আমার সার্কেলে জনপ্রিয় ছিল আর্চি আর টিনটিন। আর্চির জনপ্রিয়তার কারণ সেখানে কাহিনীগুলো ছোট ছোট, সহজ। সেই কাহিনীতে ছুটকা-ছাটকা রোমান্টিকতার ছোঁয়া আছে। সেখানে ভেরোনিকা লজ আর বেটি কুপার আছে। তাদেরকে আবার প্রায়ই আবেদনময় ভঙ্গীতে দেখায়।
আরও একটা কারণ হচ্ছে আর্চি পাতলা কাগজে ছাপানো ছোট আকারের বই বলে দাম কম। কাগজটাও কেমন যেন লালচে। পক্ষান্তরে অ্যাসটেরিক্স মোটা, সাদা কাগজে ঝকঝকে রঙে ছাপা, ফুল সাইজের বই –দাম আমার নাগালের বাইরে। টিনটিন অ্যাসটেরিক্সের মতই দামী কিন্তু টিনটিনের অ্যাডভেঞ্চার শিহরণ জাগানো তাই অনেকেই কেনে। হ্যাঁ, এটাও আরেকটা কারণ – অ্যাসটেরিক্স অ্যাডভেঞ্চার অনেকের কাছে দুর্বোধ্য ঠেকে। আর রোমানদের সাথে অনিঃশেষ সংঘর্ষের ব্যাপারটাও অনেকের কাছে বোরিং ঠেকে। তাই অ্যাসটেরিক্স আর আমার হাতের নাগালে আসে না।
হঠাৎ করে কার কাছ থেকে যেন অ্যাসটেরিক্সের একটা অন্য রকম এডিশন পাই। তিনটা বই একসাথ করে আর্চির মত ছোট আকারে বের করা হয়েছে। দাম কম বলে কেউ কেউ কিনেছে। সেই প্রথম আমি পড়তে পেলাম Asterix and the Soothsayer।
আমাদের দেশে লাইব্রেরিগুলোতে সাধারণত কমিক রাখা হয় না। আর রাখলেও 'নন্টে-ফন্টে', 'হাঁদা-ভোঁদা' বড়জোর উন্মাদের দুয়েকটা সংখ্যা। তাই লাইব্রেরিগুলোতে যে অ্যাসটেরিক্স পাওয়া যাবে না সেটা কয়েকটাতে হানা দিয়ে আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। এরপরে হঠাৎ কী করে যেন আমার কাছে অ্যাসটেরিক্সের বন্ধ দরজা খুলে যায়। আমি কার কার কাছে অ্যাসটেরিক্স আছে তার খোঁজ পেতে থাকলাম। আমি জনে জনে ধরনা দিতে লাগলাম। কেউ কেউ বিরক্ত হতেন, কেউ কেউ সটান না বলে দিতেন। আমি হাল না ছেড়ে লেগে থাকতাম। ফলে এক এক সময় অ্যাসটেরিক্সের একটা সংখ্যা পড়তে পেতাম।
অ্যাসটেরিক্স কেনার যখন সামর্থ্য হল তখন দেখলাম বাজারে খুব অল্প কয়েকটা সংখ্যা পাওয়া যায়। সোজা হিসাব –ডিমান্ড কম, তাই সাপ্লাই কম। যখন থেকে সফট বই বাজারে চলে আসলো তখন থেকে প্রায়ই খোঁজ করি অ্যাসটেরিক্স মেলে কিনা। এক সময় সত্যি সত্যি তার সন্ধান পাওয়া গেলো। আমি যা যা পাওয়া যায় জোগাড় করে ফেললাম। শেষে দেখা গেলো জাঁ-ইয়েভেস ফেরি আর দিদিয়ের কনরাডের করা ৩৫তম থেকে ৩৮তম সংখ্যা ছাড়া আগের রেনে গসিনি-অ্যালবার্ট উদের্যো জুটির করা বা উদের্যোর একা করা সবগুলো সংখ্যা জোগাড় হয়ে গেছে। এগুলো আমি কত বার পড়েছি বলতে পারব না।
অ্যাসটেরিক্সের আসল মজা বুঝতে গেলে প্রাচীন ইতিহাস, বিশেষত পশ্চিম ইউরোপের ইতিহাস, সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা থাকতে হবে। জানা থাকতে হবে বাস্তবের আর সাহিত্যের ঐতিহাসিক চরিত্রগুলো সম্পর্কেও। জুল ভার্নের কাহিনীতে যেমন ফরাসী শ্রেষ্ঠত্ব আর উন্নাসিকতার সগৌরব উপস্থিতি থাকে অ্যাসটেরিক্সেও তাই। বরং দুই হাজার বছর আগে রোমানদের কাছে ফরাসীদের পূর্ব পুরুষদের পরাজয়ের সদম্ভ অস্বীকৃতি জানাতে অ্যাসটেরিক্সের সৃষ্টি। অ্যাসটেরিক্সের বৈশিষ্ট্য আমার পক্ষে লিখে শেষ করা সম্ভব না। এর মজা পরতে পরতে। এর মাছ বিক্রেতার নাম 'আনহাইজেনিক্স', যার বাবার নাম 'আনহেলদিক্স'আর স্ত্রীর নাম 'ব্যাকটেরিয়া'। নাম নিয়ে এমন খেলা খোদ 'অ্যাসটেরিক্স' নামটা থেকে শুরু করে প্রতিটি নামে। সেখানে বিভিন্ন জন যখন বিভিন্ন ভাষায় কথা বলেন তখন কমিকে ফন্ট পালটে যায়। ঐতিহাসিক বিপর্যয়ের ঘটনাগুলো মজার হয়ে যায় –যেমন, ওবেলিক্স স্ফিংস বেয়ে ওঠার সময় তার নাক ধরায় আজকের দিনে আমরা নাকভাঙা স্ফিংস দেখতে পাই।
আজকের কিশোররা অ্যাসটেরিক্স পড়ে বলে শুনিনি। আমার কিশোর পুত্রকে অনেক চেষ্টা করেও অ্যাসটেরিক্স ধরাতে পারিনি। সে টিনটিন পড়লেও তার জগত জাপানী Manga, কোরিয়ান Manhwa আর চীনা Manhua দিয়ে পূর্ণ। এগুলোর বৈশ্য-বিস্তৃতির গভীরতা ও প্রসার এতো ব্যাপক যে সেখানে কমিক বই সর্বস্ব অ্যাসটেরিক্স প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারারই কথা।
২৫ মার্চ ২০২০ সালে উদের্যো চলে গেলেন। ৪৩ বছর আগে সঙ্গী গসিনির সাথে ১৬ বছরের একত্রে পথ চলার সমাপ্তি হবার পর তিনি একাই তরীটা বেয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন আরও ৩৬ বছর। ২০১৩ থেকে অন্যরা যখন হাল ধরেছে ততদিনে অ্যাসটেরিক্সের বাজার শেষ হয়ে গেছে। উদের্যোর বিদায়ে অ্যাসটেরিক্স রূপকথার শেষ আলোটাও নিভে গেছে।
বিদায় উদের্যো! মৃত্যুর পরে যদি কোন জীবন থাকে তাহলে সেই জীবনে নিশ্চয়ই আগে থেকে অপেক্ষমান গসিনির সাথে মিলে অ্যাসটেরিক্সের নতুন নতুন গল্প লিখবেন।