এলসি, কাঁচামাল পাওয়ার সুযোগ কমে আসায় বন্ধের ঝুঁকিতে ১,১৫০ নন-বন্ডেড পোশাক কারখানা
সীমিত মূলধনের ছোট পোশাক কারখানাগুলো বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্সের অভাব এবং পরপর ঋণপত্র (এলসি) জোগাড় ও কাঁচামাল-অ্যাক্সেসরিজ কেনার জটিলতার কারণে টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্স না থাকায় অনেক ব্যাংক মাস্টার এলসির বিপরীতে পরপর [ব্যাক-টু-ব্যাক] এলসি ইস্যু করছে না।
শুল্ক নীতিমালার কারণে স্থানীয় বন্ডেড লাইসেন্সধারীদের কাছ থেকে সুতা, কাপড় বা অ্যাক্সেসরিজ পরপর এলসির আওতায় বাকিতে কেনা যাচ্ছে না। এমনকি নগদ অর্থে এসব পণ্য কিনতে গিয়ে উদ্যোক্তাদের বেশি খরচ করতে হচ্ছে, যা কার্যকরী মূলধনে চাপ বাড়িয়ে লাভ কমিয়ে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)-র তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রায় ১,১৫০টি কারখানায় প্রায় ৭ লাখ শ্রমিক কাজ করছেন, এবং এসব কারখানার বার্ষিক সম্মিলিত রপ্তানি মূল্য প্রায় ৬.৫ বিলিয়ন ডলার।
গত ৩০ নভেম্বর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) পাঠানো এক চিঠিতে বিজিএমইএ জানায়, "পরপর এলসি জোগাড় করতে না পারা এবং বন্ডেড কোম্পানি থেকে কাঁচামাল সংগ্রহে ব্যর্থতার কারণে ইতিমধ্যেই শতাধিক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি কারখানাগুলোও একই ঝুঁকিতে রয়েছে।"
এনবিআর কর্মকর্তারা বলেছেন, বন্ডেড ও নন-বন্ডেড প্রতিষ্ঠানের মধ্যে লেনদেন ট্র্যাক করা কঠিন হওয়ায় সরকার কড়া অবস্থান নিয়েছে। তবে বিজিএমইএর কর্মকর্তারা মনে করেন, কয়েকটি দোষী প্রতিষ্ঠানের জন্য হাজারো উদ্যোক্তাকে শাস্তি দেওয়া ঠিক নয়।
"১,১০০টির বেশি নন-বন্ডেড কারখানার মধ্যে সম্ভবত ২০টি প্রতিষ্ঠান অনিয়মে জড়িত। তাদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কিন্তু বাকিদের, বিশেষ করে ছোট রপ্তানিকারকদের, সহায়তা করা প্রয়োজন," বলেন বিজিএমইএর প্রশাসক আনোয়ার হোসেন।
সূত্র জানায়, সমস্যার সমাধানে বিজিএমইএ সম্প্রতি এনবিআর চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করেছে।
বৈঠকে উপস্থিত এনবিআরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন , "বিষয়টি সমাধানে এনবিআরের বর্তমান নেতৃত্ব ইতিবাচক।"
এনবিআরের সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, "আমরা সমস্যা সমাধানে ইতিবাচক অবস্থানে রয়েছি। অপব্যবহার বন্ধের পাশাপাশি ব্যবসার সহজীকরণে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।"
বন্ডেড ওয়্যারহাউস কীভাবে কাজ করে
পোশাক রপ্তানিকারকদের সহায়তায় সরকার পরপর এলসি এবং বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা প্রদান করে। পরপর এলসির মাধ্যমে উৎপাদকেরা কাঁচামাল ঋণে কিনে রপ্তানি থেকে প্রাপ্ত আয়ে তা পরিশোধ করতে পারেন।
বন্ডেড ওয়্যারহাউসের আওতায় রপ্তানির জন্য কাঁচামালে কোনো শুল্ক বা কর দিতে হয় না। তবে শর্ত হলো, কাঁচামাল নির্দিষ্ট গুদামে রাখতে হবে এবং পণ্য পুরোপুরি রপ্তানি করতে হবে।
বন্ডেড লাইসেন্স ছাড়া রপ্তানিকারকরা এই সুবিধা পান না। দেশে প্রায় ৩,৫০০ পোশাক কারখানায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করছেন, যা দেশের মোট রপ্তানির ৮৫ শতাংশ অবদান রাখে।
ছোট কারখানার সমস্যা
গাজীপুরের পুবাইলের ছোট নন-বন্ডেড কারখানা অ্যাপারেল বাংলা সোর্সিং লিমিটেড ২০০৯ সালে যাত্রা শুরু করে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত ব্যবসা ভালো চললেও এরপর থেকে ব্যাংকগুলো পরপর এলসি প্রদান করতে অস্বীকৃতি জানাতে শুরু করে।
স্থানীয় বন্ডেড কোম্পানিগুলো থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ কঠিন হওয়ায় কোম্পানিটি অর্ডার হারাতে থাকে। ২০১৯ সালে কারখানাটিতে ১১৭ জন কর্মী ছিল, এখন তা কমে ৫০-এ নেমেছে।
"৫০ হাজার ডলারের এলসি নিশ্চিত করলেও ২৫ হাজার ডলারের পরপর এলসি পাই না। এমনকি এলসি পেলেও বন্ডেড কোম্পানিগুলো কাঁচামাল সরবরাহ করে না," জানান কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরিফুল আলম চৌধুরী।
তিনি বলেন, "কাঁচামাল ঋণে না পেয়ে নগদ অর্থে কিনতে হচ্ছে, যা ব্যয় বাড়াচ্ছে। এখন আমি ১৪ হাজার থেকে ১৫ হাজার ডলারের ছোট অর্ডার নিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছি। ফলে কাজের চাপ ও শ্রমিক দুটোই কমে গেছে।"
তাহলে ছোট উদ্যোক্তারা কীভাবে ছোট অর্ডারের জন্য কাঁচামাল সংগ্রহ করছেন? জবাবে শরিফুল আলম চৌধুরী বলেন, "নগদ টাকা দিয়ে। যেহেতু আমি অনেকদিন ধরে ব্যবসায় রয়েছি, তাই কিছু পরিচিত সূত্র থেকে সুতা পাই। তবে এজন্য আমাকে বেশি দাম দিতে হয়।
"যদি সুতার বাজারমূল্য প্রতি পাউন্ড ২.২০ ডলার হয়, তাহলে আমাকে ২.৪০ ডলারে কিনতে হয়। এর সঙ্গে অ্যাক্সেসরিজ খরচ এবং ব্যাংকিংয়ের বাড়তি খরচও যোগ হয়।"
তিনি আরও বলেন, "বন্ডেড লাইসেন্স না থাকার কারণে আমাদের প্রতিটি পর্যায়ে অতিরিক্ত খরচ করতে হয়। এমনকি রপ্তানি-সম্পর্কিত নথি অনুমোদনের জন্যও কাস্টমসকে আলাদা ফি দিতে হয় – যদিও আমি বৈধ রপ্তানিকারক এবং আমার কোনো অনিয়ম নেই।"
শরিফুল আরও বলেন, "ব্যবসা ছেড়ে যাওয়াও সহজ নয়। আমার ব্যাংক ঋণ রয়েছে এবং প্রতি মাসে ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা কিস্তি পরিশোধ করতে হয়।"
এদিকে রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় অবস্থিত আরএল অ্যাপারেলস লিমিটেডও একই সমস্যার মুখোমুখি। ১০০ কর্মী নিয়ে পরিচালিত এ প্রতিষ্ঠানটি বছরে প্রায় ১০ লাখ ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করে।
এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রোকনোজ্জামান বলেন, "আমি নগদ অর্থ দিয়ে কিছু স্থানীয় প্রতিষ্ঠান থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করি।"
কেন বন্ডেড কোম্পানিগুলো নন-বন্ডেড কোম্পানিকে কাঁচামাল সরবরাহ করতে পারে না, তা ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, "তাদের আমাদের কাছে বিক্রি করার অনুমতি নেই। কারণ, বন্ডেড কারখানাগুলো বছরের শেষে কাস্টমসকে হিসাব মিলিয়ে দিতে পারে না। ফলে তারা নন-বন্ডেড কারখানার কাছে বিক্রি করতে চায় না।"
তিনি বলেন, "যদি এই সমস্যা চলতে থাকে, তাহলে আমাদের মতো ছোট কারখানাগুলো টিকে থাকতে পারবে না।" রোকনোজ্জামান উল্লেখ করেন, সোয়েটার কারখানাগুলোর জন্য এ সমস্যাটি সবচেয়ে গুরুতর।
বন্ড লাইসেন্স নিতে কেন আগ্রহী হন না রপ্তানিকারকেরা?
উদ্যোক্তারা বলছেন, বন্ড লাইসেন্স পেতে অনেক কঠিন শর্ত পূরণ করতে হয়, যা ছোট পুঁজির উদ্যোক্তাদের জন্য প্রায় অসম্ভব।
"লাইসেন্সের জন্য নির্দিষ্ট আয়তনের গুদাম, আশপাশে সুপরিসর রাস্তা, ১ কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধনসহ বিভিন্ন শর্ত পূরণ করতে হয়। শর্ত পূরণ হলেও লাইসেন্সের জন্য আবেদন করার পর মাসের পর মাস, কখনো বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়," বলেন রোকনোজ্জামান।
উদ্যোক্তাদের জন্য আরেকটি বড় সমস্যা হলো ঘুষ। তারা অভিযোগ করেন, লাইসেন্স পেতে, বছরের শেষের নিরীক্ষা সম্পন্ন করতে এবং ইউটিলিটি পারমিটের জন্য কাস্টমস কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে হয়।
শরিফুল বলেন, "প্রায় এক বছর আগে আমি বন্ড গুদামের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। পরে জানতে পারি, তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে প্রক্রিয়াটি দ্রুত করা সম্ভব। তবে এ প্রক্রিয়ায় ৩০ লাখ টাকা ঘুষ লাগে, যা বিভিন্ন পর্যায়ে এবং বিভিন্ন কর্মকর্তাকে দিতে হয়।"
"ঘুষ দিলে লাইসেন্সের শর্তাবলী পূরণ হয়েছে কি না, তা আর খুব বেশি বিবেচনায় আসে না," তিনি যোগ করেন।
কঠোর নিয়মকানুনের কারণ
এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, বন্ডেড লাইসেন্স ব্যবস্থার অধীনে থাকা কোম্পানিগুলোর ওপর নজরদারি সহজ। তা সত্ত্বেও, অনেক কোম্পানির অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।
"যখন বন্ডেড কোম্পানিগুলো নন-বন্ডেড কোম্পানিকে পণ্য বিক্রি করে, তখন সে লেনদেন ট্র্যাক করা কঠিন হয়ে পড়ে," নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কাস্টমস কর্মকর্তা বলেন।
"এ ধরনের অনিয়মের ফলে সরকার রাজস্ব হারায় এবং স্থানীয় উৎপাদকরা অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়ে," তিনি যোগ করেন।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, "মাথাব্যথা সারাতে মাথা কেটে ফেলা কোনো সমাধান হতে পারে না। যারা অনিয়ম করে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কিন্তু এ জন্য প্রকৃত রপ্তানিকারকদের পথে বাধা সৃষ্টি করা উচিত নয়।"