খরচ বৃদ্ধি, অতিরিক্ত উৎপাদন ও চাহিদা কমায় মন্দার মুখে দেশের কাগজ শিল্প
অভ্যন্তরীণ চাহিদার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ উৎপাদন, বিক্রিতে মন্দা এবং উৎপাদন খরচ বাড়তে থাকায় এক সময়ের স্বয়ংসম্পূর্ণ কাগজ শিল্প এখন টিকে থাকার লড়াইয়ে নেমেছে। খরচ পোষাতে না পেরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনেক পেপার মিল। এতে চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ছেন অনেকে, একইসঙ্গে ক্ষতি হচ্ছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিনিয়োগের।
বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, এই শিল্পে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা, যেখানে কর্মরত রয়েছেন ২৫ লাখেরও বেশি মানুষ।
উদ্যোক্তারা জানান, এক সময়ে আমদানি নির্ভর পেপার শিল্পখাত বেসরকারি খাতের ব্যাপক বিনিয়োগে ২০০৯ সালের পরে স্বনির্ভরতা অর্জন করে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে প্রায় ৪০টি দেশে রপ্তানিও হয় বাংলাদেশে উৎপাদিত পেপার ও পেপারজাত পণ্য।
তবে করোনা মহামারি এবং পরবর্তীতে অর্থনৈতিক সংকট, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ডলারের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি বিশ্ববাজারে কাঁচামাল ও গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়ে যায় পণ্যের উৎপাদন খরচ। এতে আরও সংকটে পড়ে কাগজ শিল্পখাত।
প্রায় ১০০ পেপার মিলের মধ্যে ৭০টি বিগত কয়েক বছরে নানামুখী সংকটে বন্ধ হয়েছে। এছাড়া, বেশকিছু মিল ঋণখেলাপী হয়ে বন্ধের দ্বারপ্রান্তে।
শিল্পখাতটিতে চলমান সংকটে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থার ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে বলে শঙ্কা প্রকাশ করে সরকারের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন শিল্প সংশ্লিষ্টরা।
শিল্পের অবস্থা জানিয়ে গত অক্টোবরে অর্থ উপদেষ্টাকে দেওয়া চিঠিতে মিলগুলোর বকেয়া ঋণের সুদ ও আসল সুদবিহীন ব্লকড হিসাবে স্থানান্তরপূর্বক ব্লকড ঋণের কিস্তি ২ বছরের মোরাটোরিয়াম সুবিধাসহ ১৫ বছরে পরিশোধে সময়সীমা নির্ধারণ এবং হ্রাসকৃত সুদে নতুন চলতি মূলধন চেয়েছে বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশন।
মাগুরা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মোস্তফা কামাল মহিউদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ইতোমধ্যে প্রায় অর্ধশতাধিক পেপার মিল বন্ধ হয়ে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি ও কাঁচামাল সংকটে আরও কিছু মিল বন্ধের উপক্রম। পণ্যের চাহিদায় ভাটা পড়ায় অনেক পেপার মিল ঋণখেলাপী হয়ে পড়েছে।"
অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে পেপারের চাহিদা ৯ লাখ টন হলেও উৎপাদন প্রায় ১৫ লাখ টন।
মিলগুলো বন্ধের প্রভাবের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজ যথাসময়ে সরবরাহ ব্যাহত হবে। কাগজ শিল্পখাতে ১ লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে; এই খাতের ওপর নির্ভরশীল ৩০০টির অধিক লিংকেজ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রায় ১ কোটি লোকের কর্মসংস্থান ও জীবন জীবিকা হুমকির সম্মুখীন হবে।"
"একইসঙ্গে, পুনরায় আমদানি নির্ভর হয়ে পড়বে কাগজ শিল্প এবং প্রতিবছর বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা অপচয় হবে। কাগজ শিল্পখাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে সরকার প্রায় ৫০০০ কোটি টাকার মতো রাজস্ব হারাবে," যোগ করেন তিনি।
পেপার শিল্পের উত্থান ও নতুন বিনিয়োগ
স্বাধীনতার আগে মাত্র ৪টি কাগজ কল ছিল দেশ। পরে নব্বইয়ের দশকে, ১৯৯৬ সালের পর থেকে দেশের পেপার শিল্পে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ শুরু হয়। ধীরে ধীরে এই শিল্পখাত স্বর্ভিরতা অর্জন করে।
নব্বইয়ের দশকে পেপার শিল্পখাতে ছোট ছোট মিল গড়ে উঠলেও ক্রমবর্ধমান চাহিদা বিবেচনায় পরবর্তীতে বসুন্ধরা, মেঘনা, টিকে গ্রুপ, পারটেক্স গ্রুপ ও মাগুরা গ্রুপের মতো বড় বড় গ্রুপও কাগজ শিল্পে ব্যাপক বিনিয়োগ করে।
মোস্তফা কামাল জনান, ১৯৯৬ সালের পর থেকে কাগজ শিল্পখাতে বিনিয়োগ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ১২৮টি নিবন্ধিত মিলের মধ্যে ১০৬টি মিল স্থাপিত হয়।
তিনি বলেন, "২০০৮ সালের শেষের দিকে একটি অপ্রচলিত রপ্তানি পণ্য হিসাবে ০.৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়ে যাত্রা শুরু করে কাগজ শিল্প। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কাগজ ও কাগজ জাতীয় পণ্যের রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ২৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়।"
এদিকে, নব্বইয়ের দশকে বিনিয়োগ শুরু হলেও ২০০৯ সাল থেকে দেশের পেপার শিল্পে বেসরকারি খাতের ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ শুরু হয়। পাঠ্যপুস্তকের সংকট কমাতে ২০০৯ সালে সরকার বিনামূল্যে বই বিতরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১০ সাল থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে সব শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে নতুন পাঠ্যবই দেওয়া শুরু হয়।
শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা জানান, কাগজ শিল্পে সংকটের শুরু হয় মূলত ২০১৫-২০১৬ সালের পর থেকে।
টিকে গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান টিকে পেপার প্রডাক্টস লিমিটেড কোম্পানিটির প্রকল্প পরিচালক মো. রেজাউল হক— যিনি ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পেপার শিল্পের সঙ্গে জড়িত— বলেন, "বাজার ও চাহিদা যাচাই না করে একের পর এক বিনিয়োগ ও কম দাম ও নিম্নমানের পণ্য বিক্রির প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এই শিল্পে সংকট তৈরি হয়।"
"প্রাযুক্তির উৎকর্ষতায় পেপারভিত্তিক ডকুমেন্টেশন, ছাপা বইয়ের চাহিদা কমে যাওয়ায় বড় ধাক্কা খেয়েছে দেশের কাগজ শিল্প," যোগ করেন তিনি।
১২টি বড় এবং ৪৭টি পেপার মিল বন্ধ
অ্যাসোসিয়েশনের দেওয়া তথ্য মতে, বিগত কয়েক বছরে কাগজ খাতের ১২টি বড় মিল এবং মাঝারি ও ছোট আকারের ৪৭টি মিল বন্ধ হয়ে গেছে।
অ্যাসোসিয়েশন থেকে পাওয়া তালিকা অনুযায়ী, এর কয়েকটি মিলের সাথে কথা বলে জানা গেছে— কিছু উদ্যোক্তা করোনার পর, আবার কেউ কেউ করোনার আগেই মিল বন্ধ করেছেন।
করোনার সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘসময় বন্ধ থাকায় ওইসময় কাগজের চাহিদা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেলে, তারা বন্ধ করে দেন কারখানা। পরবর্তীতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু হলেও তারা আর মিল চালু করেননি।
টিকে গ্রুপের অন্তত ৪টি অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পেপার শিল্পখাতে ব্যাপক বিনিয়োগ ছিল। অনেক কোম্পানি গড়ে উঠায় দুর্বলমানের কাগজের সঙ্গে তালমিলিয়ে ব্যবসা করতে না পারায় ২০১৮-১৯ সালের দিকে মিলগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
রেজাউল হক জানান, বর্তমানে ওই গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান টিকে পেপার প্রডাক্টস লিমিটেড তার সক্ষমতার মাত্র ২৫ শতাংশ বা একটি মেশিনের মাধ্যমে উৎপাদন সচল রেখেছে। সাম্প্রতিক সময় আংশিকভাবে মিলটি চালু করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
রেজাউল হক বলেন, "চাহিদা এতই হ্রাস পেয়েছে যে, দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা ২০০ টন হলেও এখন মাত্র ২০-৩০ শতাংশ ক্যাপাসিটিতে উৎপাদন চালু রাখা হয়েছে।"
চট্টগ্রামের আরেকটি কোম্পানির মালিক নাম ও কোম্পানির নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, "চাহিদা কমে গেছে। মিল চালাতে না পেরে কোভিড শুরুর পর বন্ধ ঘোষণা করেছি। আর চালু করা হয়নি। এই খাতে প্রতিযোগিতা বেড়ে গেছে। অনেক কোম্পানি দুর্বলমানের কাগজ তৈরি করে বাজারে বিক্রি করছে, ফলে কোয়ালিটি পেপার উৎপাদকরা টিকতে পারছে না।"
হোয়াইট প্রিন্ট পেপার উৎপাদক ও রপ্তানিকারক লিপি পেপার মিলস, পুরনো কাগজ ও কাগজজাত পণ্যকে রিসাইকেইল করতে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।
লিপি পেপারের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার হাসান খান বলেন, "পেপার খাতে নানামুখী সংকট চলছে। তারমধ্যেও তাদের উৎপাদন চলমান। ভালোমানের কাগজ উৎপাদন করায়, আমরা এনসিটিবি'র বই তৈরির কাজ করছি। তবে কাঁচামাল আমদানিতে এলসি খুলতে সমস্যা হচ্ছে।"
দেশীয় কাগজ শিল্পখাতে বিপর্যয়
অর্থ উপদেষ্টাকে দেওয়া চিঠিতে পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশন বলেছে, নানান প্রতিকূলতায় দেশীয় কাগজ শিল্পখাত চরম বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে। বৈশ্বিক মন্দায় অভ্যন্তরীণ চাহিদা সংকুচিত হওয়া এবং রপ্তানিবাজার সম্প্রসারণে অপরাগতার কারণে এই খাত এখন রুগ্ণ শিল্পখাতে পরিণত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, সংযোগ প্রদানে দীর্ঘসূত্রিতা ও ঘনঘন লোডশেডিংসহ নানাবিধ সমস্যা এই শিল্পকে লাভজনক শিল্পে পরিণত হওয়ায় ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। জ্বালানির মূল্য প্রায় ৩০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকটের ফলে ২০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, ব্যাংক সুদের হার ৯ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ হয়েছে— যা কাগজশিল্পকে প্রতিযোগিতমূলক বাজারে টেকস্ই স্থানে পৌঁছে দিতে পারছে না। কাগজশিল্পের প্রধান কাঁচামাল ওয়েস্ট পেপার, পাল্প কেমিক্যালস ইত্যাদি ৭০ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। তারল্য সংকটের কারণে প্রধান কাঁচামাল পাল্প আমদানি করা যাচ্ছে না বিধায় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চাহিদাকৃত কাগজ সরবরহ ব্যহত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বন্ড সুবিধায় বিনাশুল্কে আনা কাগজ খোলাবাজারে কম মূল্যে বিক্রির কারণে দেশীয় কাগজশিল্প বিপর্যায়ের মুখোমুখি হয়েছে বলে জানানো হয় চিঠিতে।
ঋণ পরিশোধে ১৫ বছর সময়
এদিকে, পেপার শিল্পের উদ্যোক্তাদের চলমান ও বকেয়া ঋণের কিস্তি সহজে পরিশোধ করার সুবিধা চেয়েছে পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশন।
ওই চিঠিতে কাগজ শিল্পখাতে ব্যাংক ঋণের বকেয়া সুদ/মুনাফা ও আসল হাল তারিখ ভিত্তিক ভিন্ন ভিন্নভাবে ব্লকড হিসাবে স্থানান্তরপূর্ব দুই বছরের মোরাটোরিয়াম সুবিধা ১৫ বছরে ষান্মাষিক কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ চেয়েছে অ্যাসোসিয়েশন।
চিঠিতে বলা হয়েছে, আমদানি বিকল্প ও রপ্তানিমুখী এবং জাতীয় শিক্ষা প্রসারে কাগজ শিল্পখাতে আবদান বিবেচনায় ঋণ গ্রহীতাদের ঋণ হিসাবের জন্য ব্লকড সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে ঋণস্থিতির ১ শতাংশ হারে ডাউন পেমেন্ট গ্রহণ এবং ইতোমধ্যে পুনঃতফসিলকৃত ঋণ ও বিলম্বিত ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে ২ বছরের মোরাটোরিয়াম সুবিধাসহ ১৫ বছরের পুনরায় পুনঃতফসিলকরণের সুবিধা দিয়ে যেন ঋণ পরিশোধের সুবিধা প্রদান করা হয়।
এক্ষেত্রে ঋণের পরিমাণ নির্বশেষে ডাউন পেমেন্টের শর্ত বাদ দেওয়া বা সর্বোচ্চ ১ শতাংশ হারে ডাউন পেমেন্ট নেওয়া ও এ ধরনের ঋণকে কোনো প্রকার শ্রেণিবন্ধ না করা এবং সহজ শর্তে নতুন চলতি মূলধন প্রদানের অনুরোধ জানিয়েছে অ্যাসোসিয়েশন।