ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের বাংলোতে অস্বাভাবিক দামি আসবাবপত্র
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তার বাসভবনে নিজে বসার জন্য দু'টি চেয়ার ব্যবহার করেন - একটি তার অফিস কক্ষে, আর অন্যটি চা পান কক্ষে। একেকটি ৫০ হাজার করে উপাচার্যের ব্যবহৃত এই দু'টি চেয়ারের দাম পড়েছে এক লাখ টাকা!
উপাচার্যের বাংলোর অভ্যর্থনা কক্ষে বিশালাকার যে টেবিলটি আছে তা ঘিরে রয়েছে ৩৮টি মিটিং চেয়ার। চেয়ারগুলোর মোট দাম পড়েছে ১৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। অর্থাৎ বৈঠকের জন্য ব্যবহৃত একেকটি চেয়ারের দাম ৩৮ হাজার টাকা! টেবিলটির দাম পড়েছে ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা।
তালিকার এখানেই শেষ নয়। উপাচার্যের বসার কক্ষে ১০ লাখ ৫৪ হাজার টাকায় কেনা হয়েছে ১৭ টি সোফা। প্রতিটির দাম পড়েছে ৬২ হাজার টাকা করে।
উপাচার্য বাসভবনের অফিস কক্ষের পাশেই ছোট আরেকটি মিটিং রুমের জন্য কেনা হয়েছে আরও চারটি চেয়ার, যার প্রতিটির দাম ৪০ হাজার টাকা।
সব মিলিয়ে উপাচার্যের বাড়ির জন্য শুধু আসবাবপত্রই কেনা হয়েছে মোট ৪৩ লাখ ৩৬ হাজার টাকার। খরচের কাগজপত্র অন্তত তাই বলছে।
দেশের শীর্ষস্থানীয় ফার্নিচার প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো বলছে, রাজধানীতে তাদের কোনো শো-রুমেই এত দামি চেয়ার নেই।
আখতার ফার্নিচারের নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম জানান, তাদের শো-রুমে সবচেয়ে দামি চেয়ারটি পাওয়া যায় ২৫ হাজার টাকায়।
পারটেক্স গ্রুপের ম্যানেজার মো. আলমগীর হোসাইন জানালেন, তাদের কোনও চেয়ারের দামই ৩০ হাজারের বেশি নয়।
আসবাবপত্রের এমন অস্বাভাবিক দাম নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো আখতারুজ্জামান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমি কখনোই দামি জিনিসপত্র ব্যবহার করি নি। এ ব্যাপারে আমি কিছু জানিই না। দামি জিনিসপত্রের প্রতি আমার আগ্রহও নেই।"
উপাচার্য জানান, এই সমস্ত আসবাবপত্র বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কমিটি কিনেছে। কমিটিতে যারা ছিলেন, এ ব্যাপারে তারাই ভালো বলতে পারবেন।"
২০১৮ সালে কোটা-সংস্কার আন্দোলন চলাকালীন সময়ে ৮ এপ্রিল মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাড়িতে হামলা ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। ওই হামলায় ঐতিহাসিক এই ভবনটির প্রায় সবকিছুই ভেঙে ফেলার পর আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। এর পরবর্তীতে ভবনটির সংস্কার করা হয় এবং নতুন করে কেনা হয় সব আসবাবপত্র।
এই হামলার পর ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ এবং উপাচার্যের বাসভবন সংস্কারে কি পরিমাণ অর্থ খরচ হবে তার বাজেট তৈরি করতে ১০ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির নেতৃত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম।
কমিটির প্রথম বৈঠকে, উপাচার্যের বাসভবন সংস্কারের মোট ১ কোটি ৩৯ লাখ টাকার এক বাজেট অনুমোদন করা হয়। এর মধ্যে আসবাবপত্র কেনার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় ৪৩ লাখ ৩৬ হাজার টাকা।
কোন ধরণের উন্মুক্ত টেন্ডার ছাড়াই 'কে রেহনুমা ইভেন্টস লিমিটেড' নামের একটি প্রতিষ্ঠাকে আসবাবপত্রগুলো সরবরাহের জন্য চূড়ান্ত করা হয়।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, কমিটির নেতৃত্বে তিনি থাকলেও, উপাচার্যের বাসভবন সংস্কারের পুরো কাজটিই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে হয়েছে।
তিনি বলেন, "এটা খুব বড় কোন ইস্যু নয়। এসব নিয়ে কথা বলাটাই তো ক্ষুদ্র মানসিকতার পরিচয়। যারা আপনাদের এসব তথ্য দিচ্ছে, তারা সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে দিচ্ছে না।"
জানা গেছে, উপাচার্যের বাসভবন সংস্কার ও আসবাবপত্রের সরবরাহের পুরো প্রক্রিয়াটি দেখাশোনা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আকরাম হোসাইন।
আসবাবপত্রের পেছনে এমন খরচের ব্যাপারে তাকে প্রশ্ন করা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, "কাগজপত্র না দেখে আমি কিছুই বলতে পারব না। পুরো কাজটাই করা হয়েছে কমিটির প্রধান, বিজনেস ফ্যাকাল্টির ডিন স্যারের এর অনুমোদন নিয়ে।"
"আর জিনিসপত্রের দাম, তার মানের উপরই নির্ভর করে।"
অতিরিক্ত দাম রাখার অভিযোগ অস্বীকার ফার্নিচার কোম্পানির
উপাচার্যের বাসভবনে ফার্নিচার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কে রেহনুমা ইভেন্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেহনুমা ইয়াসমিন বলেন, "আমরা অন্য কারও কাছ থেকে চেয়ারগুলো কিনে আনি নি, আমাদের নিজেদের কারখানায় বানানো হয়েছে সেগুলো।"
দামের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, "আমি ঠিক জানি না এত দামেই চেয়ারগুলো বিক্রি করা হয়েছিল কি না, তবে এই চেয়ারগুলোর দাম ২৮ থেকে ২৯ হাজার টাকার বেশি নয়।"
"বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি হয়তো পার্সেন্টেজ হিসেব করে বাড়তি দামটুকু যোগ করে নিয়েছে"।
বরাদ্দ থাকার পরেও উপাচার্যের বাংলোর সংস্কারের জন্য তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন অধ্যাপক শিবলী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত ভবন রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের জন্য বার্ষিক একটি বাজেট বরাদ্দ থাকে। এর মধ্যে একাডেমিক ভবন, শিক্ষকদের বাসভবন এবং শিক্ষার্থীদের হলগুলোও অন্তর্ভুক্ত। উপাচার্যের বাসভবনের আসবাবপত্রগুলোও এই বরাদ্দকৃত বাজেট থেকে কেনা হয়েছে।
তবে কাগজপত্র ঘেঁটে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সংস্কারের জন্য তহবিল সংগ্রহ করেছেন ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত। উপাচার্যের বাসভবনের জন্য 'গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি জিনিস' কেনার নাম করে বাণিজ্য অনুষদের অন্তর্গত ৯ টি বিভাগের প্রত্যেকের কাছ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে সংগ্রহ করেছেন তিনি।
উপাচার্যের বাসভবনে হামলার চারদিন পর এই ৯ টি বিভাগের চেয়ারম্যানদের নিয়ে একটি বৈঠক করেন তিনি। সেখানেই তহবিলের জন্য টাকা দেয়ার এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
তবে উপাচার্যের বাসভবনে সংস্কারের জন্য যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই বরাদ্দ রয়েছে, সেখানে আলাদা করে অধ্যাপক শিবলী কেনো তহবিল সংগ্রহ করেছেন সেটি নিয়েও দেখা দিয়েছে প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, "হামলার পর উপাচার্যের বাসভবনে আর কোনকিছুই অবশিষ্ট ছিল না। এমন জরুরি অবস্থায় আমরা হাত বাড়িয়ে দিয়েছি, যাতে করে তারা অন্তত খাবার রান্না করে খেতে পারেন।"
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক তিনজন উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। উপাচার্যের বাসভবনে অফিস কক্ষের জন্য আদতে এত দামি আসবাবের প্রয়োজন আছে কি না এমন প্রশ্ন করা হলে তারা বলেন, একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চলে সাধারণ জনগণের টাকায়। সেই টাকার এমন 'যথেচ্ছাচার ব্যবহার সত্যিই লজ্জাজনক'।
নাম না প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক উপাচার্য বলেন, "একজন মানুষ কি করে এত নিচে নেমে যাতে পারে, আমি জানি না। এই ব্যাপারে মন্তব্য করাটাও লজ্জার"।
"আমি যতদিন উপাচার্যের দায়িত্বে ছিলাম, বাসভবনে অনেক পুরোনো আসবাব ছিল। তাদের সংস্কার বা নতুন করে আসবাব কেনার কথা আমি চিন্তাও করি নি। একজন উপাচার্য হিসেবে আমার দায়িত্ব ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা আর গবেষণার মানোন্নয়নের দিকে লক্ষ্য রাখা।"