৪০০ বছরের পুরোনো মন্দিরে নতুন করে ফিরল ইতিহাসের ছাপ
সুন্দরবনের শেখের টেক এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকা ৪০০ বছরের পুরোনো কালী মন্দির যেন ইতিহাসের এক নীরব সাক্ষী। সময়ের নিষ্ঠুর স্পর্শে ক্ষয়ে যাওয়া মন্দিরটির স্থায়িত্ব রক্ষায় প্রথমবারের মতো সংস্কার করা হয়েছে। মন্দিরের চারপাশে এক ফুটেরও বেশি ইটের নতুন গাঁথুনি দেওয়া হয়েছে, যা এর স্থাপত্যকে আরও মজবুত করেছে। সংস্কার কাজের পুরো প্রক্রিয়ায় পুরোনো নকশার আদল অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, সুন্দরবনের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং প্রাচীন স্থাপনা হিসেবে এই মন্দিরটির নাম বারবার উঠে আসে।
খুলনা রেঞ্জের কালাবগি ফরেস্ট স্টেশনের অধীনে থাকা আদাচাই টহল ফাঁড়ির ১৬ নম্বর কম্পার্টমেন্টে, শিবসা নদীর পূর্ব পাড়ে এই মন্দিরটির অবস্থান। ওই এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে আছে মধ্যযুগীয় স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ, ইটের দেয়াল এবং ঢিবি, যা ইতিহাস অনুযায়ী শিবসা দুর্গ নামে পরিচিত।
সম্প্রতি মন্দিরটি পরিদর্শন করে দেখা যায়, এর চারপাশে নতুন ইটের গাঁথুনি তৈরি করা হয়েছে। তবে গম্বুজের উপরে পুরোনো অংশের একটি অংশ খোলা রাখা হয়েছে। মন্দিরের ভেতরেও কংক্রিটের ঢালাই দিয়ে শক্তি বৃদ্ধি করা হয়েছে।
এই সংস্কার কাজ যৌথভাবে পরিচালনা করেছে বন বিভাগ এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। অর্থায়ন করেছে বন বিভাগ, আর কারিগরি সহায়তা দিয়েছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।
সংস্কার কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিক রাজমিস্ত্রি মো. সোহানুর রহমান সোহান। তিনি বলেন, "আমরা পুরোনো ইটের আদলে নতুন ইট বানানোর জন্য ইটের ভাটায় বিশেষ অর্ডার দিই। এরপর সেই ইটের উপর পুরোনো নকশা অনুযায়ী হাতুড়ি-বাটালের সাহায্যে নতুন নকশা তৈরি করি। হুবহু একই রকম নকশা রেখে আমরা মন্দিরটির অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ করেছি।"
২০২১ সালে মন্দিরটির সংরক্ষণে একটি ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। এখন সেখানে শেখের টেক খাল থেকে মন্দির পর্যন্ত প্রায় এক সোয়া কিলোমিটার দীর্ঘ কংক্রিটের ফুট ট্রেইল তৈরি করা হয়েছে। ফুট ট্রেইলটি মন্দিরের চারপাশ ঘুরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পর্যটকদের জন্য তৈরি করা হয়েছে একটি ওয়াচ টাওয়ার এবং বনের ভেতরে কিছু ইটের রাস্তা। পর্যটকদের সুবিধার্থে টয়লেটও নির্মাণ করা হয়েছে।
সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্প থেকে মন্দির সংস্কারে ৭৫ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) এ জেড এম হাসানুর রহমান বলেন, "মন্দিরটি অত্যন্ত ভঙ্গুর অবস্থায় ছিল। চারপাশে আগাছা, আর গাছপালা জন্মে যাওয়ায় যে কোনো সময় এটি ধ্বংস হয়ে যেতে পারত। তাই প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কারিগরি সহায়তায় আমরা এটি মজবুত করার কাজ করেছি।"
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর জানিয়েছে, মন্দিরটি নির্মাণে ৪০০ বছর আগে স্থানীয় শামুকের তৈরি চুন এবং শিবসা নদীর বালু ব্যবহার করা হয়েছিল। বাইরের দিকে জ্যামিতিক নকশা, ফুল, লতা, এবং পাতার মতো পোড়ামাটির অলংকৃত ইট দিয়ে সাজানো হয়েছিল। মন্দিরটির দক্ষিণ এবং পশ্চিম দিকে ছিল দুটি প্রবেশপথ। চার ধরনের ইট দিয়ে নির্মিত মন্দিরটির গঠনশৈলী ছিল অনন্য।
মন্দিরের বাইরের অংশ ৬৫৫ সেন্টিমিটার বর্গাকার, আর ভেতরের অংশ ৩২৫ সেন্টিমিটার। দেয়ালের পুরুত্ব ১৬৫ সেন্টিমিটার। মন্দিরের উত্তর দিকে একটি ছোট কুঠুরি এবং দক্ষিণ ও পশ্চিম পাশের প্রবেশপথের প্রস্থ ছিল ৯৭ সেন্টিমিটার।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন বলেন, "সংস্কারের সময় মন্দিরটির মূল নকশা ঠিক রেখে এর কাঠামো মজবুত করা হয়েছে। এতে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি।"
১৯১৪ সালে প্রকাশিত সতীশ চন্দ্র মিত্রের 'যশোহর-খুলনার ইতিহাস' গ্রন্থে এই মন্দিরের ঐতিহাসিক বিবরণ পাওয়া যায়। সেখানে মন্দিরটিকে রাজা প্রতাপাদিত্যের শিবসা দুর্গের অংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বন বিভাগের মতে, এই স্থাপনাটি বারোভূঁইয়া বা মোগল আমলের সময়ের।