২১ বছর পর নগর নীতির খসড়া করল এলজিআরডি মন্ত্রণালয়, সমালোচনা বিশেষজ্ঞদের
২১ বছর পর অবশেষে একটি নগর নীতির খসড়া তৈরি করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ (এলজিআরডি)। এর লক্ষ্য, নগর খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা, টেকসই নগর পরিকল্পনার প্রচার এবং ভারসাম্যপূর্ণ নগর উন্নয়ন অর্জন করা।
"জাতীয় নগর নীতিমালা (এনইউপি)-২০২৫" শিরোনামের এই খসড়াটি নগর পরিকল্পনাবিদ এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে। তারা বলছেন, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ নগর নীতি নয় এবং এতে আরও কিছু সংশোধন প্রয়োজন।
এদিকে, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নগর উন্নয়ন পরিচালক "বাংলাদেশ জাতীয় নগরায়ণ নীতি প্রণয়ন" শিরোনামে একটি স্বাধীন নীতি তৈরি করেছেন, যেটি এলজিডির খসড়া নীতি থেকে একেবারে আলাদা।
জাতীয় নগর নীতিমালা বা এনইউপি-২০২৫ মূলত এমন একটি নীতিমালা, যেটি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি এবং দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নির্দিষ্ট খাতের জন্য দিকনির্দেশনা প্রদান করে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলজিডি-এর একজন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ২০০৪ সালে জাতীয় নগর নীতি নিয়ে কাজ শুরু হলেও পরবর্তীতে আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় এসে বিষয়টি স্থগিত রাখে। তিনি বলেন, "পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে বিষয়টি নিয়ে কাজ করার তাগিদ আসলেও, সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এই নীতি তৈরি ও অনুমোদন প্রক্রিয়া বন্ধ রাখা হয়।"
ওই কর্মকর্তা বলেন, আগের সরকারের সময় নীতিটি তৈরি হলে ঢাকার প্রকল্পসহ দেশের বেশিরভাগ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হতো না।
তিনি বলেন, "যদি এটি [আওয়ামী লীগ সরকারের সময়] অনুমোদিত হতো, তাহলে ফ্লাইওভার এবং মেট্রোরেলের মতো উন্নয়ন প্রকল্পগুলো নীতির বাইরে চলে যেতো।"
তিনি আরও বলেন, "এছাড়া ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণ এবং নগরের সংস্থাগুলোর সমন্বয় নিয়ে যে বিষয়গুলো আছে সেগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হতো।"
২০০৪ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে শুরু হওয়া নীতির খসড়াটি ২০১১ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বিভিন্ন পর্যালোচনা, অংশীদারদের পরামর্শ এবং সংশোধন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছে। এর মধ্যে মন্ত্রণালয়, গবেষক এবং নগর নেতাদের মতামত অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
২০১৫ সালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ খসড়াটি এলজিডির কাছে সুপারিশসহ ফেরত পাঠায় এবং ২০১৬ সালে সেটি পুনঃসংশোধন করা হয়। তবে ২০২২ সাল পর্যন্ত আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। ২০২৪ সালের মধ্যে নীতিটি চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে ২০২৩ সালে একটি নতুন কমিটি গঠন করা হয়। এখন পর্যন্ত চারটি এনইউপি কমিটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সর্বশেষ বৈঠক হয়েছে গত বছরের ৮ ডিসেম্বর।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আক্তার মাহমুদ টিবিএস-কে বলেন, বর্তমান নগরায়ণের প্রেক্ষাপটে এমন একটি নীতির বাস্তবায়নে সব পক্ষের অংশগ্রহণ জরুরি।
তিনি বলেন, "এই নীতি তৈরি ও অনুমোদন হোক, সেটা গত সরকারের সময়ে শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরাই চাননি। পরিবর্তিত এই সময়ে এই নীতি দ্রুত অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় যেতে হবে।"
গতকাল (২৮ জানুয়ারি) বিআইসিসি অডিটোরিয়ামে এনইউপি-২০২৫ খসড়ার ওপর এক অংশীদার পরামর্শ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে এলজিআরডি সচিব মো. নিজাম উদ্দীন বলেন, "গত ২১ বছর ধরে একটি নগর নীতি তৈরি না হওয়া দুঃখজনক। তবে, আমরা এই মুহূর্ত থেকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।"
তিনি উদ্যোগটি সফল করতে সম্মিলিত প্রচেষ্টার আহ্বান জানান।
সচিব আরও বলেন, "৩০টিরও বেশি মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা এবং অভিমত খসড়াতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।"
এনইউপি-২০২৫ চূড়ান্তকরণ কমিটির সদস্য এবং বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ শাকিল আখতার বলেন, "আমাদের বিভিন্ন আইনে বিভিন্নভাবে নগরের সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে। স্থানিক পরিকল্পনার আওতায় নগরের পরিকল্পনা হওয়া প্রয়োজন।"
তিনি বলেন, "আমাদের স্থানীয় সরকার কাঠামো অনেক দুর্বল। এই কাঠামো কীভাবে শক্তিশালী করা যায়, সে বিষয়ে কাজ করবে নগর নীতি।"
অধ্যাপক শাকিল বলেন, "অনেক পলিসি (নীতি) হয় কিন্তু সেগুলো ফাইলবন্দিই থাকে। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে নগর নীতিও (এনইউপি-২০২৫) যেন ফাইলবন্দি না থাকে।"
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স-এর (বিআইপি) সভাপতি আদিল মোহাম্মদ খান একই বিষয়ে দুটি মন্ত্রণালয় থেকে দুটি আলাদা নীতি তৈরি করা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এটিকে তিনি "সমন্বয়হীনতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ" হিসেবে বর্ণনা করেন।
তিনি বলেন, "যে খসড়া নীতি তৈরি করা হয়েছে সেটি একটি নখ-দন্তহীন নীতি বলে মনে হয়েছে। এখানে আরও বেশি সংশোধন প্রয়োজন।"
তিনি আরও বলেন, নীতিতে একটি নগর সরকার গঠনের জন্য কাঠামো থাকতে হবে। তার মতে, এটি একটি আলাদা নগর বিষয়ক মন্ত্রণালয় ছাড়া সম্ভব নয়।