রাজস্বের বিপরীতে ঋণের হার বাড়ছে—বাংলাদেশ এ চাপ সামাল দিতে পারবে ?
সরকারের বৈদেশিক ঋণের বোঝা ক্রমাগত বাড়লেও সেই সঙ্গে তালমিলিয়ে রাজস্ব আহরণ বাড়ছে না। যে কারণে রাজস্ব আদায়ের বিপরীতে ঋণের হার বিপজ্জনকভাবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ১৮ শতাংশের সীমার (থ্রেশহোল্ড লেভেলের) দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) এক প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে।
ঋণের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক রিটার্ন যাচাই না করেই সরকার বিদেশি ঋণের দিকে ঝোঁকায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজস্বের বিপরীতে ঋণের হার বা অনুপাত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬.৫৩ শতাংশ, এক বছর আগেও যা ছিল ১২ শতাংশ।
ইআরডির তথ্য বলছে, সরকারের বৈদেশিক ঋণের স্টক প্রায় ৬.৫ বিলিয়ন ডলার বেড়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৬৯ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এই অবস্থায়, ২০২৭ ও ২০২৮ অর্থবছরে ঋণের আসল পরিশোধ প্রতিবছর ৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে।
প্রতিকূলতার চাপ যদিও আরও গভীর। সরকার এখন মার্কিন ডলার ও জাপানি ইয়েনে প্রদত্ত বাজার-ভিত্তিক ঋণের দিকে ঝুঁকছে। অন্যদিকে, স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস (এসডিআর) এর আওতায় রেয়াতি বা সহজ শর্তের ঋণ কমছে।
এই পরিবর্তন ঋণ পরিশোধের চাপ আরও বাড়াচ্ছে, কারণ বাজারভিত্তিক ঋণের সুদহার যেমন বেশি হয়, তেমনি বিনিময় হারের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার ঝুঁকিও থাকে বেশি। এতে করে দেশের আর্থিক সক্ষমতাও নাজুক হচ্ছে।
এনিয়ে সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞরা। হুঁশিয়ারি দিয়ে বলছেন, এতে করে সরকারি ব্যয়ের মধ্যে ঋণের সুদ পরিশোধের অংশ বাড়বে, ফলে অবকাঠামো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো খাতে বিনিয়োগের জন্য দরকারি আর্থিক সম্পদে টান পড়বে। অথচ অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির জন্য এসব খাতে বিনিয়োগ অপরিহার্য।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের অবস্থা দুর্দশার দিকে যাচ্ছে, চাপ বাড়ছে। আগে যেটা আশঙ্কা ছিল— সেটাই এখন বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ইআরডির ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চূড়ান্ত পরিসংখ্যানে। এখনো ঋণ পরিশোধের চাপটা যে বাড়ছে, তার সিগনাল পাওয়া যাচ্ছে। ডেবট -টু- রেভিনিউ (রাজস্বের বিপরীতে ঋণের হার) এর ক্ষেত্রে দুই দিকে সমস্যা রয়েছে।'
তিনি বলেন, 'অর্থনীতির আকার তুলনায় রাজস্বের চেয়ে বেশি বেড়েছে ঋণ। কোভিডের পরে সুদহার বেড়ে যাওয়ার কারণে সুদ পরিশোধে এটা বেড়ে গিয়েছিল। এর সঙ্গে সম্প্রতি সময়ে আমরা যেসব ঋণ নিয়েছি, সেগুলোর গ্রেস পিরিয়ড, ম্যাচিউরিটি পিরিয়ড কমে গেছে। বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আগে ঋণ পরিশোধের সময় ৪০ বছর ছিল, এখন তা ৩০ বছরে নেমে গেছে। আগে যেখানে ১০ বছর গ্রেস পিরিয়ড পাওয়া যেত, সেখানে এখন পাঁচ বছরের বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকাসহ সবার ঋণের সুদহার বেড়েছে।'
বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদের মতে, 'রাজস্ব বাড়াতে হবে— এটা যেমন সত্য, একইসঙ্গে ঋণ ব্যবস্থাপনায়ও পরিবর্তন আনতে হবে। এই ব্যবস্থাপনায় বড় সমস্যা হলো— অনেক প্রকল্প থেকে প্রত্যাশিত রিটার্ন বা সুফল আসেনি। কঠিন শর্তে ঋণ নিয়ে প্রকল্প থেকে যদি আয় না আসে— তাহলে রাজস্ব বাড়বে কীভাবে?'
দুর্বল হয়েছে এসডিআরের অংশ
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শেষে বৈদেশিক ঋণের স্টক এর মধ্যে স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস (এসডিআর) দুর্বল হয়েছে। গত অর্থবছর শেষে এসডিআর এর অংশ কমে ৩৫.১ শতাংশে নেমেছে। এর আগের অর্থবছরে এসডিআর সর্বোচ্চ ছিল, যা ছিল মোট ডেবট স্টক বা ঋণ স্থিতির ৩৮.১ শতাংশ।
এসডিআর কমে যাওয়ায় ডেবট স্টক এর শীর্ষে উঠে এসেছে ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যা বেড়ে ৩৮.৪ শতাংশ হয়েছে, যা এর আগের অর্থবছর ছিল ৩৬.৪ শতাংশ। এর মধ্যে বাজারভিত্তিক বা সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট (সোফর) ভিত্তিক ঋণও রয়েছে।
ডলারভিত্তিক ঋণের উচ্চ সুদহার এড়াতে সম্প্রতি সরকার জাপানি ইয়েনে বেশকিছু বাজটে সহায়তা ও প্রকল্প ঋণ নিয়েছে। এতে ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে ডেবট স্টকে ইয়েন এর অংশ বেড়ে ১৭.৪ শতাংশ হয়েছে। এর আগের অর্থবছরে তা ছিল ১৬.৭ শতাংশ।
ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, এসডিআর কমার কারণে ঋণ পরিশোধে চাপ আরো বাড়বে। এসডিআরে নেওয়া ঋণ এসডিআর বাস্কেটের যেকোনো মুদ্রায় (মার্কিন ডলার, ইউরো, চীনের ইউয়ান, জাপানি ইয়েন বা ব্রিটিশ পাউন্ড স্টার্লিংয়ে) পরিশোধ করার সুযোগ থাকে। এতে ঋণ পরিশোধের চাপ কমে।
তবে কর্মকর্তারা এটাও জানান যে, জাপানি মুদ্রার ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণেও ঋণ পরিশোধে চাপ বাড়বে। একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, 'ডলারের বিপরীতে ইয়েন এর মূল্য বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এতে আমাদের অনেক বেশি পরিশোধ করতে হবে।'
এই প্রসঙ্গে জাহিদ হোসেন ব্যাখ্যা করেন, 'আমরা বিভিন্ন কারেন্সিতে ঋণ দিয়েছি, বাজারের অবস্থার ওপর নির্ভর করে আমাদের কারেন্সি মিক্সে বৈচিত্র্য এসেছে। এটা যে বাই চয়েজ হয়েছে, তা নয়। এখানে ভালো নিউজও আছে, আবার খারাপ নিউজও আছে। ভালো খরচ হলো, মুদ্রায় বৈচিত্র্য থাকার ফলে বিনিময় হারের ওঠানামা থেকে আমাদের দেনা রক্ষা পাবে বা বাড়বে না।'
তিনি বলেন, সম্প্রতি ডলার অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েছে, যেকারণে আমাদের দেনার বোঝা বাড়ছে। কোভিডের পর থেকে ডলার অনেক শক্তিশালী হয়েছে। ডলারের দর কারেক্টেড হওয়ার কথা বলা হলেও— বর্তমানে এটিকে ওভার ভ্যালুড (অতি-মূল্যায়িত) মনে হচ্ছে। দীর্ঘসময় ধরে ডলার ওভার ভ্যালুড থাকলে টাকার অংকে ঋণের বোঝা বাড়তে থাকবে। সম্প্রতি ডলারের চরিত্র দেখলে মনে হয়, এই কারেন্সির ওপর নির্ভশীলতা মানে মহাবিপদ।'
'এখানে খারাপ সংবাদ হলো- এসডিআর কমে যাওয়া। এসডিআর হলো পাঁচটি কারেন্সির বাস্কেট। এসডিআর ডলার বা ইয়েনের মতো খুব বেশি ওঠানামা করে না। এসডিআরের মধ্যেই একটা ডাইভারসিকেশন আছে। কিন্তু, বহুপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগীরা অন্য কারেন্সিতে ঋণের সুযোগ দিচ্ছে। যেকারণে এসডিআর থেকে ডলারে শিফট হয়েছে। সুদহারের পাশাপাশি নন-ইন্টারেস্ট রেটও বিবেচনায় নিতে হবে। কারেন্সির বৈচিত্র্য ভালো খবর, কিন্তু সেটা যেভাবে হয়েছে সেখানে ঝুঁকি কমে যায়নি'- যোগ করেন তিনি।
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, ডলারের বিনিময় হারের ঝুঁকি কমাতে সরকার সম্প্রতি জাপানি মুদ্রায় ঋণ নিয়েছে। এর ফলে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে যেসব বিদেশি ঋণ নিয়েছে, তার গড় সুদহার কমে ২.২৫ শতাংশ হয়েছে। আগের অর্থবছরে গড় সুদহার ছিল ২.২৭ শতাংশ। এর আগে ২০২১-২২ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে গড় সুদহার ছিল যথাক্রমে ২.১১ এবং ১.৩৫ শতাংশ।
ইআরডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশ যেসব বিদেশি ঋণ নিয়েছে তার জন্য ২০২৯ থেকে ২০৩২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে প্রতিবছর ৩.৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি আসল পরিশোধ করতে হবে।
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের ঋণের ভার বা স্টক বেড়ে হয়েছে ৬৮.৮২১ বিলিয়ন ডলার, যা এর আগের অর্থবছর ছিল ৬২.৪ বিলিয়ন ডলার।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শেষে সবচেয়ে বেশি ঋণের স্থিতি বিশ্বব্যাংকের কাছে ২০.৬২২ বিলিয়ন ডলার, এরপরে এডিবির কাছে ১৫.৭৪ বিলিয়ন ডলার, জাপানের কাছে ১১.২৫ বিলিয়ন ডলার এবং চীনের কাছে ৫.৮৩৭ বিলিয়ন ডলার।