অনলাইনে হয়রানির শিকার নারীদের ৭০ শতাংশের বয়স ১৫-২৫
রাজধানীতে যেসব নারী অনলাইনে হয়রানির শিকার হন তাদের ৭০ শতাংশের বয়স ১৫-২৫ বছরের মধ্যে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাইবার নিরাপত্তা ও অপরাধ বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মিশুক চাকমা।
এসব নারীর মধ্যে বেশিরভাগ যৌন হয়রানি, হ্যাকিং, সাইবার পর্নোগ্রাফি ও ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হন।
সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) আয়োজিত ‘বাংলাদেশে প্রযুক্তির মাধ্যমে নারীর প্রতি সহিংসতা’ শীর্ষক এক সভায় এ তথ্য জানান তিনি। রাজধানীর আদাবরে উন্নয়ন সহযোগী টিমের (ইউএসটি) মিলনায়তনে এই সভার আয়োজন করে মত প্রকাশের অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘আর্টিকেল নাইনটিন’।
এ সভায় গণমাধ্যমে কর্মরত দেশের বিভিন্ন জেলার নারী সাংবাদিক, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, নারী মানবাধিকার কর্মী ও সংস্কৃতি কর্মীরা অংশগ্রহণ করেন।
আর্টিকেল নাইনটিনের বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মিশুক চাকমার পাশাপাশি আলোচক হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ও আইনজীবী সাইমুম রেজা তালুকদার।
সভায় পরিসংখ্যান উপস্থাপন করে মিশুক চাকমা জানান, দেশের একমাত্র সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে যেসব হয়রানির অভিযোগ ও মামলা আসে সেগুলোর মধ্যে হ্যাকিং ২০ শতাংশ, ফেক আইডি ২০ শতাংশ, হয়রানি/মানহানি ১৮ শতাংশ, সাইবার পর্নোগ্রাফি ১৪ শতাংশ, মোবাইলের মাধ্যমে আর্থিক প্রতারণা ১৪ শতাংশ, ব্ল্যাকমেইল/চাঁদাবাজি ৭ শতাংশ, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ১ শতাংশ ও অন্যান্য ৬ শতাংশ।
‘এ হিসেব কেবল রাজধানী ঢাকার। ঢাকার বাইরের চিত্রও প্রায় একই রকম। তবে মফস্বলে অনলাইনে হয়রানির শিকার বেশিরভাগ ভুক্তভোগী থানায় যান না,’ বলেন তিনি।
সাইবার অপরাধ তদন্তে নিজেদের সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে পুলিশ কর্মকর্তা মিশুক চাকমা বলেন, মফস্বল পর্যায়ের থানা-পুলিশের সাইবার বিষয়ক পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নেই। অনলাইন হয়রানির অভিযোগের প্রাথমিক তদন্ত কীভাবে করতে হয় এ বিষয়ে বর্তমানে পুলিশের সব পর্যায়ে প্রশিক্ষণ দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
‘অনেক অভিযোগের তদন্ত করতে ফেসবুকের কাছে তথ্য চাইলেও সহজে পাওয়া যায় না। এছাড়া দেশের বাইরে থেকে অনলাইনে যারা গুজব ছড়ায় ও অপরাধে জড়িয়ে পড়েন তাদের আইনের আওতায় আনা কঠিন,’ জানান তিনি।
তিনি বলেন, পুলিশের একার পক্ষে সাইবার অপরাধ মোকাবিলা সম্ভব নয়। এ জন্য পরিবার থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
অনলাইনে হয়রানির বিষয়ে অভিযোগ জানাতে সাইবার নিরাপত্তা বিভাগের ফেসবুক পেজে (https://www.facebook.com/cyberctdmp) এবং হেল্প ডেস্কে (০১৭৬৯৬৯১৫২২) যোগাযোগ করার জন্য তিনি পরামর্শ দেন।
এছাড়াও ব্যক্তিগত সুরক্ষার স্বার্থে বিভিন্ন প্রযুক্তি ও অ্যাপ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভূমিকার শুরুতেই ‘নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের’ কথা বলা হয়েছে। অথচ আইনের কোনো ধারায় নিরাপত্তার বিধান নেই। তাই অনলাইনে বিচরণের ক্ষেত্রে পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে পার্থক্য রাখাটা জরুরি। আইনী সুরক্ষার আগে অনলাইন ব্যবহারীকে প্রযুক্তির কারিগরি দিকগুলো সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হবে।
অনলাইন মৌলিক মানবাধিকার চর্চায় আইনি চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাইমুম রেজা তালুকদার বলেন, অফলাইনের মৌলিক মানবাধিকারগুলো অনলাইনেও কার্যকর হবে কি না সে বিষয়ে আইনে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। অনলাইনে তথ্যের সুরক্ষা, বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ও ব্যক্তিগত সুরক্ষার বিষয়েও আইনে সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই। এছাড়া অনলাইন অপরাধের বিপুল অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য বিদ্যমান সাইবার ট্রাইবুন্যাল যথেষ্ট নয় বলে তিনি মনে করেন।
ফারুখ ফয়সল বলেন, প্রযুক্তিকে ভয় নয় বরং এর প্রায়োগিক ও ব্যবহারিক দিক জেনে এগিয়ে যেতে হবে। কারণ প্রযুক্তির ব্যবহার জানা ছাড়া নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়। ডিজিটাল লিটারেসি বা প্রযুক্তি শিক্ষার মাধ্যমে অনলাইনে নারীরা বুলিংয়ের মতো নেতিবাচক বিষয় থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেন।
দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে প্রযুক্তি ব্যবহারে নারীদের সচেতনতা বৃদ্ধি, অভিজ্ঞতা বিনিময় ও হয়রানি প্রতিরোধে আইনগত আশ্রয় নেয়ার ক্ষেত্রে ভয়-বাধা এবং এ ক্ষেত্রে করণীয়গুলো চিহ্নিত করা, আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা এবং অনলাইন হয়রানি প্রতিরোধ ও প্রতিকারের ক্ষেত্রে সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সহজে যোগাযোগ করা প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা করা হয়।