ইইউ’তে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধার নতুন শর্ত ‘মানবাধিকার’
এভরিথিং বাট আর্মস (ইবিএ)-এর আওতায় বাংলাদেশকে দেয়া বাণিজ্য সুবিধা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে শ্রমিক অধিকারের পাশাপাশি এবারই প্রথম বাক স্বাধীনতাসহ সার্বিক মানবাধিকার নিশ্চিত করার শর্ত জুড়ে দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
সরকারের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে ইউরোপে ইউনিয়ন বলেছে, ২০২৩ সালের পর বাংলাদেশের ইবিএ সুবিধা বহাল থাকবে কি-না, তা শ্রমিক অধিকার ও মানবাধিকার সুরক্ষার ওপর নির্ভর করবে।
ইইউ জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউর (ইউপিআর) সুপারিশ করা মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়গুলো বাস্তবায়নের ব্যাপারে বাংলাদেশের কাছে টাইমবাউন্ড কর্মপরিকল্পনা চেয়েছে।
২৯ অক্টোবরে স্বাক্ষর করা চিঠিটি ঢাকার ইইউ দূতাবাস থেকে গত ৩ নভেম্বর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, শ্রম সচিব কেএম আবদুস সালাম ও বাণিজ্য সচিব মো. জাফর উদ্দিনের কাছে পাঠানো হয়েছে।
চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন ইইউ'র ডিরেক্টরেট অব ট্রেড এর পরিচালক ইউয়া সাইনাউইক, ডিরেক্টরেট অব এমপ্লয়মেন্ট এর পরিচালক জর্ডি কিউরেন গটর এবং ইউরোপিয়ান এক্সটার্নাল অ্যাকশন সার্ভিস-এশিয়া প্যাসিফিকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর পাওলা পামপাওলিনি।
চিঠিতে বলা হয়, 'ভবিষ্যতে জিএসপি সুবিধা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে যদি ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইন কাজ করে এবং ২০২৩ সালের পরে অগ্রাধিকার মঞ্জুর করার শর্তসাপেক্ষে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে বাংলাদেশ মানবাধিকার ও শ্রম অধিকারের মানের সাথে পুরোপুরি মিলে তবে তা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হবে।'
চিঠিতে আরও বলা হয়, ইইউতে শুল্কমুক্ত রপ্তানিতে বাংলাদেশের সুবিধা অব্যাহত রাখার জন্য, জোরালো এবং ফলাফল-ভিত্তিক এভরিথিং বাট আর্মস (ইবিএ) এঙ্গেইজমেন্ট প্রক্রিয়া প্রয়োজন।
স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে শুধু অস্ত্র বাদে সব পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে থাকে। বাংলাদেশ যদি ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীতও হয়, তাতেও ২০২৭ সাল পর্যন্ত এই সুবিধা অব্যাহত থাকবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতি ১০ বছর পর পর ইবিএ কর্মসূচি পর্যালোচনা করে থাকে। চলতি ইবিএর মেয়াদ ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হবে। পরবর্তী স্কিম নিয়ে কাজ এখন ইইউ কাজ করছে।
ইইউর চিঠি সম্পর্কে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বিষয়গুলো আমরা সময়মত হ্যান্ডেল করবো। এ নিয়ে চিন্তার কোন কারণ নেই।'
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের নভেম্বরে ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউ (ইউপিআর) বাস্তবায়নের জন্য তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে চিঠি দিয়েছিল ইউএন হিউম্যান রাইটস কমিশন।
কমিশনের ইউপিআরে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকার, নাগরিকদের সভা-সমাবেশ করার অধিকারসহ রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করা, বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করা, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের ৩২ ধারা বাতিল করা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করাসহ বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভূক্ত রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবারই প্রথম মানবাধিকার সংক্রান্ত ইউপিআর বাস্তবায়নে বাংলাদেশের পরিকল্পনা চেয়েছে। এর আগে ইইউ কখনো বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বাণিজ্য সুবিধার সঙ্গে মানবাধিকারের ইস্যুকে যুক্ত করেনি।
মানবাধিকার সুরক্ষার সঙ্গে বেশ কিছু মন্ত্রণালয় ও আইন সম্পৃক্ত। ইইউর শর্তারোপের পর সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধনসহ কর্মপরিকল্পনা তৈরির কাজ শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো। এতে নেতৃত্ব দিচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ইউপিআর বাস্তবায়ন বিষয়ে ঢাকায় একটি কর্মশালাও করবে ইইউ।
বাণিজ্য সুবিধার সঙ্গে প্রথমবারের মতো মানবাধিকার ইস্যুকে যুক্ত করার জন্য কিছু সাংবাদিক ও এনজিওকে দায়ী করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
তিনি বলেন, 'বিশ্বে ১৯৩টি দেশ আছে। সব দেশেই কিছু অকাম-কুকাম হচ্ছে। কিন্তু ওইসব দেশ নিয়ে কেউ কথা বলে না। এর কারণ হচ্ছে, ওইসব দেশের মানুষ এগুলো নিয়ে এতে ব্যস্ত থাকে না।'
তিনি বলেন, 'আমাদের দেশের কিছু সাংবাদিক এবং এনজিওগুলো সারাক্ষণ এসব নিয়ে মাথা ঘামায়। মাথা ঘামায়, কারণ তারা এজন্য বিদেশ থেকে অর্থ পায়। এসব নিয়ে তারা বিদেশিদের কাছে বারবার ধর্ণা দেয়, তাদেরকে ত্যক্ত করে। এ কারণেই বিদেশিরা এসব নিয়ে কথা বলে। আমরা যতো কম লাফালাফি করবো, ততোই মঙ্গল।'
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, মানবাধিকার, শ্রমিক অধিকার এবং বাকস্বাধীনতা সবই একের সঙ্গে অন্যটি সম্পর্কিত এবং বাংলাদেশ বিভিন্ন ইস্যুকে এই অধিকারগুলোর প্রেক্ষিতেই উপস্থাপন করে আসছে।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক লেবার সম্মেলনে মানবাধিকারসহ যে ইস্যুগুলো আলোচিত হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সেখানে গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে মানবাধিকার ইস্যুর কথা তারা কখনো তোলেনি।
'যেহেতু বাংলাদেশ স্বল্প আয়ের দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে তাই মানবাধিকার ইস্যুগুলো ধীরে ধীরে সামনে আসছে। আমরা আশাকরি জিএসপি সুবিধা চলমান রাখার জন্য সরকার নিশ্চয়ই এই ইস্যুকে গুরুত্ব দিয়ে দেখবে,' বলছিলেন শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এটি মোটেও অবাক হওয়ার মতো বিষয় নয় যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ, বিশেষত জিএসপি সুবিধার সম্প্রসারণের সম্ভাবনা, শ্রমের অধিকারের পাশাপাশি বাংলাদেশ ইউপিআরের আওতায় অন্যান্য প্রতিশ্রুতিগুলির সঙ্গে সংযুক্ত করেছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশকে বুঝতে হবে যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য ব্যবসায়িক সম্পর্ক যতটা গুরুত্বপূর্ণ, সাধারণভাবে মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক মান এবং বিশেষত শ্রম অধিকারের প্রতিপালনও তাদের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
'কেবল ইইউ দেশগুলিতে রপ্তানি সুবিধার জন্যই নয় বরং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে দেশের বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখার জন্যও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রত্যাশা গুরুত্ব সহকারে নেওয়া উচিত সরকারের,' বলেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।
শ্রম আইন ও বিধিমালা সংশোধনের কাজ চলছে
শ্রম অধিকার সম্পর্কিত ইইউর দেয়া ৯ দফা একশন প্ল্যান বাস্তবায়নে টাইমবাউন্ড পরিকল্পনা চলতি নভেম্বরের শেষে জানাতে হবে বাংলাদেশকে। এ নিয়ে গত ১ অক্টোবর বাণিজ্য, পররাষ্ট্র ও শ্রম সচিব সভা করেছেন।
শ্রমিক অধিকার রক্ষা সংক্রান্ত ইইউর দেয়া কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে শ্রম আইন ও বিধিমালা সংশোধনের কাজ চলছে বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন শ্রম সচিব কে এম আবদুস সালাম।
তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং মালিক ও শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধিদের নিয়ে ইইউর সুপারিশ অনুযায়ী কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ অব্যাহত আছে। সরকার শ্রমিক অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ইইউর ৯ দফা একশন প্ল্যানে ২০২৫ সালের মধ্যে শিশু শ্রম সম্পূর্ণ দূর করা, শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন ও সিবিএ করার সহজ সুযোগ দেয়া, এক কারখানার শ্রমিকদের অন্য কারখানার ট্রেড ইউনিয়নে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ দেয়া, শ্রম আদালতের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করার মতো শর্ত আছে।