জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাতাসের ঘনত্ব বাড়ছে এভারেস্টে, কমছে বরফের পুরুত্ব
হিমালয় পর্বতশ্রেনির সবচেয়ে উঁচু পর্বত মাউন্ট এভারেস্ট। ভূপৃষ্ঠে এটি সর্বোচ্চ স্থান হলেও, একে ঘিরে ধরেছে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব।
এভারেস্টের চূড়ার উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৯,০৩৫ ফুট। পৃথিবীতে একমাত্র এই পর্বতের চূড়া বায়ুমণ্ডলের স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার স্তরকে স্পর্শ করেছে। এত উচ্চতায় স্বাভাবিকভাবেই বাতাসের ঘনত্ব অত্যন্ত কম। ফলে পর্বতারোহীদের শ্বাসকষ্ট দেখা দেয় অক্সিজেনের অভাবে। হিমবাহগুলো মাইলের পর মাইল জুড়ে বিস্তৃত। কিন্তু, প্রকৃতির এ দুই অনবদ্য বৈশিষ্ট্য অনেক দ্রুত বদলে যাচ্ছে।
গত শুক্রবার (২০ নভেম্বর) আইসায়েন্স ও ওয়ান আর্থ জার্নালে প্রকাশিত নতুন দুটি গবেষণায় এসংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়।
গবেষকরা জানান, এভারেস্ট চূড়ার চারদিকে বাতাসের চাপ বাড়ছে। ফলে সেখানে বেড়েছে তুলনামূলক সহজে নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো অক্সিজেনের পরিমাণ। আর হিমবাহ গলছে নজিরবিহীন গতিতে। একারণেই বরফগলা হ্রদের সংখ্যাও বাড়ছে। এই পরিবর্তন পর্বতারোহী আর দক্ষিণ এশিয়ার বিপুল জনগোষ্ঠীর সকলকে কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত করবে।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির সদস্য বিজ্ঞানীরা গবেষণায় অংশ নেন। সংস্থার জলবায়ু বিজ্ঞানী এবং প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক নিবন্ধদ্বয়ের সহ-লেখক অরোরা এলমোর বলেন, ''হিমালয়ের অপেক্ষাকৃত নিম্নাঞ্চল নিয়ে অনেক গবেষণাই হয়েছে। সেই তুলনায় ৫ হাজার মিটারের (১৬ হাজার ৪০৪ ফুট) বেশি উচ্চতায় বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান হয়েছে খুব কম। এভারেস্ট ৮,৮৫০ মিটার, অর্থাৎ এখনও তিন কিলোমিটারের বেশি উচ্চতা নিয়ে আছে গবেষণায় ঘাটতি।''
পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্থান সম্পর্কে জানতে তাই গতবছর এলমোর একটি বৈজ্ঞানিক অভিযাত্রী দল পাঠান। এদলে ছিলেন মোট ৩৪ জন বিজ্ঞানী। তারা এভারেস্ট থেকে হিমবাহের বরফের নমুনা এবং আবহাওয়া তথ্য সংগ্রহ করে আনেন। তারা সেখানে পৃথিবীর সর্বোচ্চ আবহাওয়া কেন্দ্র স্থাপন করেই এসব কাজ করেছেন। ওই অভিযাত্রায় পাওয়া তথ্য দীর্ঘ এক বছর ধরে বিশ্লেষণের পর নতুন গবেষণা দুটি প্রকাশিত হয়।
আইসায়েন্সে প্রকাশিত নিবন্ধে এলমোর ও তার সহকর্মী বিজ্ঞানীরা ১৯৭০ সালের পর থেকে কীভাবে এভারেস্টের উপর বায়ুমণ্ডলের চাপ পরিবর্তন হয়েছে- তা তুলে ধরেন।
তারা জানান, প্রতিবছর প্রায় ৮০০ মানুষ এভারেস্ট আরোহণের চেষ্টা করেন। কিন্তু, ২১,৩২৫ ফুটের পর দেখা দেয় তীব্র অক্সিজেন সঙ্কট। এই বাধা এড়াতে অধিকাংশ মানুষ অক্সিজেন ভর্তি বোতল ব্যবহার করেন। কৃত্রিম অক্সিজেন সরবরাহ ছাড়া এভারেস্ট চূড়ায় পৌঁছাতে পারেন হাতেগোণা কিছু সংখ্যক অভিজ্ঞ পর্বতারোহী । কিন্তু, বাতাসের ঘনত্ব যেভাবে বাড়ছে, তাতে নিকট ভবিষ্যতে অক্সিজেন ট্যাঙ্ক ছাড়াই অধিকাংশ আরোহী সহজে চূড়ায় উঠতে পারবেন।
অর্থাৎ, উঁচুস্থানে অক্সিজেনের উপস্থিতি বাড়ার দিকে তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন। ''এর মূল কারণ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। তাপমাত্রা বাড়লে বাতাসের অণু দ্রুত গতিত ছোটাছুটি শুরু করে। এই অবস্থায় তারা পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা খায়, যেকারণে অতি উচ্চতায় বাতাসের চাপ বাড়ে। এভাবে যত বেশি চাপ সৃষ্টি হয়, তার অর্থ সেখানে বাতাসের কণা পরিমাণও ততোটাই বেশি। এভাবেই নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো অক্সিজেন পাওয়া যায়,'' ব্যাখ্যা করেন যুক্তরাজ্যের লগবোরো বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু বিজ্ঞানী এবং নিবন্ধের প্রধান লেখক টম ম্যাথিউস।
এভারেস্টে স্থাপিত আবহাওয়া কেন্দ্রের সাহায্যেই ম্যাথিউ ও তার দল বায়ুচাপের তথ্য সংগ্রহ করেন। ওই তথ্যের সাহায্যে ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর মিডিয়াম রেঞ্জ ওয়েদার ফোরকাস্টিং ১৯৭৯ থেকে ২০২০ সাল নাগাদ এভারেস্টে বায়ু ঘনত্ব বিষয়ক একটি কম্পিউটার মডেল তৈরি করে। আলোচিত সময়ে বাতাসে আসা পরিবর্তনকেই সেখানে তুলে ধরা হয়। সেই অনুসারে বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যতে কীভাবে তাপমাত্রা বাড়ার কারণে বায়ুচাপ বাড়বে- সেটাও নির্ণয় করেছেন।
হিমবাহগুলো গলতেই থাকবে ২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীর তাপমাত্রা শিল্পায়ন পূর্ব সময়ের চাইতে ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস বাড়লে। আর অধিক উচ্চতায় অক্সিজেন গ্রহণের মাত্রা ৫ শতাংশ বাড়বে, যা স্বাভাবিক পরিস্থিতি না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
- সূত্র: স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিন