অর্থনিষ্ঠা নয়, বরং কর্মনিষ্ঠার শিক্ষাই ছেলেকে দিয়েছেন ওয়ারেন বাফেট
বিশ্বের সেরা ধনী ওয়ারেন বাফেট। কিন্তু কোন বিষয়টা তাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে? সম্প্রতি তার ছেলে পিটার বাফেট জানালেন তিনি নিজের কাজকে সত্যিকার অর্থেই ভালোবাসেন ওয়ারেন। বার্কশায়ার হ্যাথওয়ে গ্রুপের প্রধান নির্বাহী ওয়ারেন কাজ করতে এতই ভালোবাসেন যে অবসর নেওয়ার পরও প্রতিদিন সকালে অফিসে এসে উপস্থিত হন তিনি।
পিটার বাফেট নিজে পেশায় একজন সংগীত পরিচালক এবং মানবাধিকার কর্মী। ২০২০ সালে বাবা নিয়ে লেখেন 'লাইফ ইজ হোয়াট ইউ মেক ইট'। এই বইয়ে পিটার কথা বলেছেন তার বাবা ওয়ারেন বাফেটের কাজের প্রতি নিষ্ঠা নিয়ে। কাজের প্রতি বাফেট পরিবারের নিষ্ঠা নিয়ে।
পিটার লিখেছেন, 'আমার বাবা আর এখন আমার কাছে কর্মনিষ্ঠার প্রথম ধাপ হলো নিজেকে চেনা। আসলে কোন কাজটা করতে আমার ভালো লাগে সেটা খুঁজে বের করা জরুরি। তাহলে কর্মক্ষেত্র নিয়ে অনীহা কাজ করবে না। একসময় কাজটাই হয়ে উঠবে ভালোলাগার জায়গা, কেননা সেটা আর বাধাধরা কোন জায়গা নয়।'
ছোটবেলায় পিটার দেখতেন তার বাবা ওয়ারেন বাড়িতে বসেই নিজের অনেক কাজ সারতেন। নিজের স্টাডিতে বসে ব্যালেন্স শিট মেলানো, কোম্পানির কাজকর্ম কেমন চলছে তার হিসাব মেলানোর কাজ করতেন তিনি ঘন্টার পর ঘন্টা। পিটার তার বইতে বলছেন, 'দীর্ঘ কাজের শেষে বাবা যখন স্টাডি থেকে বের হতেন তখন তাকে দেখে মনে হত শান্তির এক চাদর তাকে জড়িয়ে রেখেছে, যেন তার হাতের কাজের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছে তার অহম, সম্ভ্রম।'
পিটার বলেন, 'খেলোয়াড়রা যখন প্রচণ্ড শারীরিক পরিশ্রম করেন তখন তাদের মস্তিষ্কে এন্ডোরফাইন নামে হরমোন নিঃসরণ হয়। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় বাবা যখন নিজের কাজের ভেতর ডুবে থাকেন তখন তারও একই অনুভূতি হয়। এতবছর ধরে বাবাকে দেখে একটা বিষয় আমি উপলব্ধি করেছি- কাজের প্রতি নিষ্ঠা, সততা থাকতে হয়। শুধু উপরে উপরে করার জন্য না, বরং সত্যি সত্যি কাজের মধ্যে ডুবে যেতে জানতে হয়, যেন তা আমাদের আনন্দ দেয়'।
নিজের প্যাশন অনুসরণ করার বিষয়টা তো আমরা সবাই জানি। ওয়ারেন বাফেট কিন্তু এই উপদেশ অনুসরণের পক্ষে। ২০১২ সালে সিএনবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ওয়ারেন বলেছিলেন, ১২ বছর বয়সেই আমি আমার প্যাশনের জায়গাটা বুঝে গেছিলাম, সেদিক থেকে আমি অনেক ভাগ্যবান বলতে হবে। প্রথম চাকরিতেই প্যাশন খুঁজে পাওয়া কারও পক্ষে হয়তো সম্ভব নয়। তবু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আমি সবসময়েই বলি- মনে কর তোমাদের কাছে অঢেল টাকা-পয়সা আছে। তখন কোন চাকরিটা বেছে নিতে তোমরা? যদি সেই উত্তরটা জানা থাকে, তাহলে মনে করবে নিজের ভালোলাগার কাজটা খুঁজে পেয়েছ তোমরা।'
প্যাশন বিষয়টা বিতর্কের হয়ে দাঁড়িয়েছে কেননা, হয়তো কাজটা করতে আপনার ভালো লাগছে কিন্তু আসলেই সেই কাজ করে খাদ্য সংস্থান হচ্ছে কি না তা যাচাই করে দেখা হয়নি। তবে পিটার বলছেন, প্যাশন খুঁজে বের করার ভালো উপায় হচ্ছে নিজেকে প্রশ্ন করা- কোন সেই কাজ যাতে দিনরাত মুখ গুঁজে থাকলেও আপনি বিরক্ত হবেন না, একঘেয়ে লাগবে না।
'কর্মনিষ্ঠা' বনাম 'অর্থনিষ্ঠা'
পিটার লিখছেন, 'অনেকেই নিজেকে কর্মনিষ্ঠ মনে করেন, কাজের প্রতি 'প্যাশনেট' মনে করেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় তারা আসলে কাজটাকে ভালোবেসে কাজ করছেন না, বরং সেই কাজের বিনিময়ে যে মোটা অংকের বেতন আর সুবিধা পাচ্ছেন তার জন্য কাজটা করে যান। এই দুইয়ের মধ্যে তফাৎ আছে।'
কি সেই তফাৎ? নিজেকে প্রশ্ন করুন, বেতন বা সুযোগ-সুবিধাগুলো যদি বন্ধ হয়ে যায় তবুও কি আপনি এই কাজ করবেন? যেকোন সময় প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেতে পারে, তবুও?
পিটার বলেন, ওয়ারেন কখনো টাকা পাবেন তাই কাজ করেননি। যদিও টাকা এসেছে, কিত্নু সেটা ছিল উপরি পাওনা, বাইপ্রডাক্ট। 'বাবা যদি শুধুই টাকা পাবেন বলে কাজ করতেন, তাহলে একসময় সেটা হয়ে যেত একঘেয়ে রুটিন চাকরি। সেই কাজে আর আনন্দ পেতেন না তিনি।'
আর এজন্যই একটা টেকসই কর্মনিষ্ঠা গড়ে তোলার পক্ষে কথা বলেন পিতা-পুত্র দুজনেই। সামান্য বিনিময় আর পুরস্কারের কথা ভেবে নয় বরং প্যাশন আর লক্ষ্যের দিকে দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে যেতেই কাজ করতে হবে।
বাবা ওয়ারেন বাফেটের কাছ থেকে পিটার এই শিক্ষাটাই নিয়েছেন। 'দিনশেষে এই জিনিসগুলো কিন্তু কেউ আপনার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। আর সেটাই হবে আপনার সেরা পুরস্কার।'
সূত্র: সিএনবিসি